কুয়ারি পাস অভিযান

অনেকদিন এর ইচ্ছার পূর্ণতা লাভ হলো, আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম প্রতিবছর এর মতো। গত পাঁচ বছর টানা হিমাচল প্রদেশ এ ট্রেক করে হাফিয়ে উঠেছিলাম ভাবলাম এবার উত্তরাখন্ড এ যাওয়া যাক কিন্তু ছুটি পেলাম এমন এক বেয়ারা মাসে যে (জানুয়ারীতে ) বেশি অপশন হাতে ছিল না, অগত্যা এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে কেদারকন্ঠ, ব্রহ্মতাল এসব এর নাম উঠে এলো। নাহ বড্ডো ভিড়, উইন্টার ট্রেক মানেই সবাই এইগুলোর নামই বলে, একটু অফবিট দরকার যেখানে অন্তত ভিড় হবে না, এমনিতেই সমতল ছেড়ে পাহাড়ে যাই একটু শান্তির খোঁজে আবার সেখানে গিয়েও ভিড় দেখবো? না না সেটা হচ্ছে না, তাই খোঁজ খোঁজ অবশেষে কুয়ারি পাস (Kuari Pass Trek) এর কথা মাথায় এলো। এমনিতে কুয়ারি পাস খুবই জনপ্রিয় একটা ট্রেক রুট। সারাবছর ভিড় লেগেই থাকে, কিন্তু সেটা ডিসেম্বর এর লাস্ট উইক থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত বেশি বরফ আর তাপমাত্রা বড্ডো বেশি হিমাঙ্ক এর নিচে থাকে বলে কেউ সাধারণত জানুয়ারীর পর ওদিক পানে যেতে চায় না। তাই কুয়ারি পাস এ ঠিক করলাম।

কুয়ারি পাস এর উপর… !!!

হাওড়া থেকে কুম্ভ এক্সপ্রেস ধরে হরিদ্বার পৌছালাম, ট্রেন লেট ছিল তাই পৌঁছে দালাল দের ভিড় ঠেলে ভালো হোটেল খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হলো তাই স্থির করলাম কালী কমলিতে গিয়ে থাকবো, তাই হলো। পরের দিন ভোর ৪টায় রওনা দিলাম যশীমঠ এর উদ্দেশ্যে। দুপুর নাগাদ পৌছালাম যসীমঠে। গিয়ে দেখি আমাদের গাইড আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বরফে চলার জুতো নিয়ে। পায়ের সাইজ অনুযায়ী জুতো ঠিক আছে কিনা চেক করে নিলাম। যাইহোক সেসব মিটলে পরের দিন কখন বেরোনো হবে সেটা ঠিক করে আর বাকি শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু কথা জিজ্ঞাসা করে বিদায় নিলো। আমরাও আশেপাশে একটু ঘুরে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।

খুল্লারা ক্যাম্প এর আশেপাশে

পরদিন সকালে গাড়ি হাজির, আমরাও তৈরী। গন্তব্য ঢাক গ্রাম। ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রামটি আমাদের শেষ গাড়ি চলার পথ, এর পর হাঁটা শুরু। ৪৫ মিনিট লাগলো সেখানে পৌঁছাতে, সেখানে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে শেষ বারের মতো জিনিসপত্র একবার স্যাকে গুছিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। গাইড এর পিছু পিছু প্রথম দিন এর গন্তব্য গুলিঙ। পথে পড়লো তুগাশি গ্রাম। গ্রাম এর ছোট ছোট বাচ্ছাদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে সন্ধে নাগাদ গুলিঙ পৌছালাম। প্রবল ঠাণ্ডার জেরে ক্যাম্প ফায়ার করলাম গুলিঙ এ। তারপর রুটি ভাত ডাল সহযোগে ডিনার শেষ করে টেন্ট এ ঘুমাতে গেলাম।

খুল্লারা থেকে কুয়ারির পথে

পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম খুল্লারার পথে, কিছুক্ষন এর মধ্যেই টের পেলাম আজকের হাঁটা সহজ হবে না কারণ পুরোটাই বরফ এ ঢাকা অর্থাৎ আজ কে দ্বিগুন দম খরচ করতে হবে। যাই হোক প্রথম দিকে সব ঠিক থাকলেও সময় আর রাস্তা যত এগোতে থাকলো বরফ এর গভীরতা ততো বাড়তে থাকলো আর পথচলার কষ্টের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো আশেপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য। পথচলার কষ্ট দূর করতে প্রকৃতি বোধহয় সবসময় এভাবেই নিজেকে মেলে ধরে। যাইহোক এভাবেই ক্যামেরার শাটার এর আঙ্গুল লাগিয়ে পথ চলতে চলতে বিকেল নাগাদ খুল্লারা পৌছালাম, আর পৌঁছাতেই শুরু হলো তুমুল স্নো ফলস। কোনোমতে টেন্ট এর ঢুকে নিজেকে গরম রাখার চেষ্টা করতে থাকলাম সকলে। ঘড়ির থার্মোমিটার তাপমাত্রা দেখালো অলরেডি -9°C এখনো সারারাত বাকি! গরম কফি আর স্যুপ এর মাধ্যমে নিজেদের কে গরম রেখে রাতে অল্প কিছু খাবার মুখে দিয়ে সকলে স্লিপিং ব্যাগ এর ভিতর আশ্রয় নিলাম ঘুম আসতে বেশ দেরি হলো বোধহয় অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণেই যাইহোক শেষ রাতে ঘুম হয়েছিল এটাই রক্ষা নাহলে পরের দিন পথচলা দুস্কর হয়ে যেত।

কুয়ারির পথে কষ্টকর চড়াই

ঘুম থেকে উঠে দেখি টেন্ট এর ভিতরের সিলিং আর ইনার এ বরফ জমে আছে সাথে আমাদের স্লিপিং ব্যাগ, রুকস্যাক, জ্যাকেট আর যা যা ছিল সবার উপর বরফ জমে আছে, তাজ্জব ব্যাপার! ভিতরে বরফ এলো কি করে? পরে বুঝলাম আসলে এগুলো আমাদের নিঃশাস প্রশাস এর ফলে হয়েছে,রাতে তাপমাত্রা অনেক নেমে গিয়েছিলো তার ফলে এটা হয়েছে। সকাল ৭টা নাগাদ সূর্যোদয় এর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে ওই ঠান্ডায় সবাই কোনোমতে নিজেদের তৈরী করলাম আজকের গন্তব্য সেই বিখ্যাত কুয়ারি পাস!

ডিম টোস্ট আর চা সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম অভিযান এর উপসংহার টানতে। আজকে পায়ে স্নো বুট আর গেটার এর পাশাপাশি ক্র্যাম্পন পড়তে হয়েছে ফলে পায়ের ওজন ও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আমাদের গ্রুপ এর আমার আর আমার লিডার এর অভিজ্ঞতা থাকলেও বাকিদের এইসব পরে বরফে হাঁটার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না ফলে তাঁদের একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু কিছু করার নেই কষ্টকে তো জয় করতেই হবে। তাই তারা সব কষ্ট নীরবে সহ্য করছিলো। প্রথম দিকে বরফ শক্ত থাকার ফলে চলতে অসুবিধে কম হচ্ছিলো কিন্তু যত বেলা বাড়তে থাকলো সূর্যের উত্তাপে বরফ যত গলতে থাকলো ততো পা ঢুকে যেতে থাকলো বরফে আর ততো পথ চলার কষ্ট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকলো। কিছু জায়গা এমন এলো যেখানে প্রায় ৫ফিট এর উপর বরফ জমে আছে, ওয়াকইং স্টিক পুরোটাই ঢুকে যাচ্ছে! অতি সন্তর্পনে সেইসব জায়গা পাস কাটিয়ে এগিয়ে চললাম পাস এর দিকে, এর যেন বরফ সমুদ্র! যেদিকে চোখ যায় শুধুই বরফ। ধীরে ধীরে এভাবে চলতে চলতে অবশেষে বেলা ২টা নাগাদ পাস এর উপর পৌছালাম!

কুয়ারি পাস এর পথে

চারিদিকের দৃশ্য দেখে মুহূর্তে যেন সব কষ্ট কোথায় উধাও হয়ে গেলো। উত্তরাখন্ড এর যত নামকরা পর্বতচূড়া আছে তার প্রায় সব ই দৃশ্যমান। এ যেন এক অন্য জগৎ এর উপস্হিত হয়েছি আমরা! শুরু হলো ক্যামেরার শাটার টেপার পালা, যত পারো মুহূর্তগুলো কে ক্যামেরা বন্দি করার চেষ্টা। সেলফি তোলার পালা। এরপর পাস এর উপর সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ডিম সেদ্ধ, রুটি, জ্যাম আর ক্যাডবেরি সহযোগে লাঞ্চ সারলাম। আরো কিছু মুহুর্ত কাটিয়ে এবার ফেরার পালা।

নিচে নেমে এলাম সেই একে পথে, ফেরার পথে খুল্লারা তে একরাত কাটিয়ে সেই বরফ পথ মাড়িয়ে গুলিঙ হয়ে তুগাশি গ্রাম হয়ে সেই ঢাক গ্রাম এর ফিরে এলাম সেখান থেকে গাড়ি করে যশীমঠ। সেখান থেকে হরিদ্বার আর তারপর দুন এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Kuari PassTrekkinguttarakhand