চন্দ্রালোকে সমুদ্রস্নান

পূর্ণিমার আলোয় সমুদ্রে গা ভেজানোর ইচ্ছেটা বহুদিনের। সময় আর সুযোগের অভাবে ইচ্ছেটার বাস্তবায়ন হয় নাই। এই আশ্বিনের পূর্ণিমা তিথিতে সুযোগটা বুঝি আমার হাতে এসে ধরা দিলো। উড়নচণ্ডী আমি পথ চলতে চলতে আশ্বিনের এই পূর্ণিমা তিথিতে সাগরকন্যার বুকে পৌঁছে গেলাম। এবার আমার স্বপ্ন পূরণ হবার পালা। শুনেছি, আশ্বিনে পূর্ণিমায় না’কি বঙ্গোপসাগরের মোহনা অঞ্চলে ইলিশের চলাচল বৃদ্ধি পায়। কপাল ভালো থাকলে, স্বপ্ন পূরণের সাথে সাথে একটা ইলিশ উৎসব পেয়ে যেতে পারি আমার এই যাত্রায়।

১লা আশ্বিন, বেলা দ্বিপ্রহর

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পূর্ব পরিচিত ইলিশ শিকারি “সোহাগ মাঝিকে” নিজ চেষ্টায় খুঁজে বের করলাম। বছরখানেক আগে তারই ১৫ফিটের ছোট্ট ডিঙি নৌকায় চড়ে ইলিশ শিকারের জন্য চার ঘণ্টা সমুদ্রে ভেসেছিলাম। দুর্দান্ত ছিল আমার রোমাঞ্চকর সেই অভিজ্ঞতাটা। পূর্ণিমা তিথিতে আজ আবার একই ঘটনা পুনরাবৃত্তির আশায়। বেলা ১টা নাগাদ ৩জন পেশাদার ইলিশ শিকারীর সাথে আমি সমুদ্রে ভেসে পরলাম।

রৌদ্রের তেজে যেন শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে সমুদ্রের পানিতে রোদের প্রতিফলন উত্তাপটাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামুদ্রিক ঢেউয়ের সাথে লড়াই করে মহীসোপানের দিকে এগিয়ে চলছে আমাদের ছোট্ট ডিঙি নৌকা। আজ আমরা ইলিশ শিকারের জন্য পেতে রাখা ক্ষতিগ্রস্ত একটি জাল প্রতিস্থাপন করবো এবং ৩০০ফিট দৈর্ঘ্যের ৫১টি জালে ইলিশের অনুসন্ধান করবো। সমুদ্রে সর্বমোট ৫২টি জাল পাতা আছে সোহাগ মাঝির। ইলিশের এই ভরা মৌসুমে প্রতিটি জালেই অনুসন্ধান চালাতে হবে। প্রতিটি জালই যেন, সম্ভাবনার একেকটি ভাণ্ড।

এক নাগারে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চলার পর আমরা ১ম জালের নিকট পৌছালাম। ১ম জালেই আমরা ৪টি ইলিশ আমাদের নৌকায় তুলে নিলাম। গড়ে এদের ওজন ৭০০গ্রাম থেকে ১কেজি পর্যন্ত হবে। হাতের উপর জ্যান্ত ইলিশ নিতে পেরে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। আমার হাতে আমাদের জাতীয় মাছ, তাও আবার জীবিত অবস্থায়। বেশ শক্তিশালী মাছ এগুলো। হাতের উপর মিনিট তিনেক লড়াই করার পর নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলো ইলিশগুলো।

সমস্ত জালগুলোতে অনুসন্ধান চালাতে আমাদের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লেগে গেলো। সূর্য ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে লালিমা আভা নিয়ে ডুবতে বসেছে। এখান থেকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতটাকে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। পূব আকাশে আশ্বিন পূর্ণিমার ভরা চাঁদ গোলাকার থালার মত হাসছে। আমাদের ইলিশ শিকার আজকের মত শেষ। এবার আমাদের কূলে ফিরতে হবে। সব মিলিয়ে আমাদের নৌকায় প্রায় ৫০কেজির মত ইলিশ উঠেছে, আজকের অভিযানে। নৌকাটিকে উত্তর দিকে ঘুরিয়ে দ্রুত উপকূলের দিকে এগুতে লাগলাম। অন্ধকার নামাতে হাতের ডান পাশে পূব আকাশে উদিত পূর্ণিমার চাঁদের আলো আরও স্পষ্ট হচ্ছে। খোলা সমুদ্রে জলের উপরে চাঁদের আলোটা যেন, বিশাল আকারের একটা হাইওয়ে, যে হাইওয়ে ধরে চাঁদ থেকে আলো নেমে আসছে খোলা সমুদ্রে। সত্যি অসাধারণ একটা দৃশ্য। এদৃশ্য দেখার জন্য পূর্ণিমার আলোয় খোলা সমুদ্রে ভাসতে হয়। নিজেকে “লাইফ অফ পাই” মুভির স্থানে মনে হচ্ছিলো।

কিংবা “আর্নেস্ট হেমিংওয়ের” “দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি” গল্পের নায়ক বুড়ো “সান্তিয়াগো” হতে পারলেও মন্দ হতো না। গল্প তো জীবন ও প্রকৃতি থেকেই আসে, তাই না? সবাই চায় নিজেকে গল্পের নায়কের স্থানে দেখতে। আমিও এর ব্যাতিক্রম নই।

সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ আমরা আমাদের নৌকা নিয়ে ইলিশ সমেত কুয়াকাটা সৈকতে ফিরে এলাম। কি মাছ, দেখার জন্য উৎসুক পর্যটকের ভিড় লেগেছে আমাদের নৌকা ঘিরে।

পূর্ণিমা তিথিতে “চন্দ্রালোকে সমুদ্রস্নানের” সাথে সাথে ইলিশ খাবো না, তা কি হয়? সোহাগ মাঝির নিকট হতে বৃহদাকার প্রতিটি ১কেজি ওজনবিশিষ্ট ২টি ইলিশ কিনে নিলাম। রুমে ফিরেই ইলিশ ভাঁজায় ব্যাস্ত হয়ে পরলাম। আমার দলের অন্য সব সদস্যগণ আমার উড়নচণ্ডীপনায় বিরক্ত না হয়ে পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করে আমাকে সাহায্য করা শুরু করলো। আজ পূর্ণিমায় আমরা আপন হাতে ধৃত ইলিশ খেয়ে জোছনাস্নানে মাতবো, এর চাইতে আনন্দ এই মুহূর্তে আর কিই’বা হতে পারে?

রাত ১১টা নাগাদ টাটকা ইলিশ ভাঁজা আমাদের সকলের সামনে উপস্থিত। উৎসুক আমার দলের সকল সদস্যগণ বেশ আয়েশ করে ইলিশ খাচ্ছে আর পূর্ণিমার চাঁদ দেখছে। দুর্দান্ত স্বাদের ইলিশ। যে একবার খাবে, জীবনেও তার স্বাদ ভুলবে না। আমি নিজেও এর চাইতে স্বাদের ইলিশ খেয়েছি বলে মনে হয় না।

সার্বিক দিক বিবেচনাপূর্বক আমার প্রত্যাশাটা একটু বেশিই। খাওয়া দাওয়া সেরে রাত্র দ্বিপ্রহরে চাঁদের আলোয় আমি সমুদ্রস্নানে নেমে গেলাম।

আহ, কি অসাধারণ একটা মুহূর্ত। এতকাল যার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। সমুদ্রের জলে অনবরত জলকেলি করে চলেছি। চাঁদের আলোয় সেই জল প্রতিফলিত হচ্ছে। দ্যুতি ছরাচ্ছে তার আভা। চন্দ্রালোকের সাথে সমুদ্র করে চলেছে নিরন্তর গর্জন। বুঝতে পারছি, জোয়ার আসছে, বাড়ছে রাত। চাঁদ এখন মাথার উপরে। হ্যাঁ ,পূর্ণিমার জোছনা ভরা চাঁদনী রাত।

সমুদ্র এবং চাঁদ, এই দুইয়ের সাথে অনবদ্য এক নিবির বন্ধন। এদের বিশ্রাম নেই, ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই, নেই ক্ষুধাও। সৌন্দর্য বিলিয়ে দেয়াটাই যাদের স্বার্থকতা।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ kahinikuakatastroytravelvromon