একটু আয়েশ করে কোলকাতা, দিল্লী, আগ্রা, শিমলা, কুল্লু, মানালী, রোহথাং পাস ভ্রমন

আমাদের এই ট্যুরটি করি গত বছর ২০১৬ এর সেপ্টেম্বরে কুরবানী ঈদের ছুটিতে। আমরা কোলকাতা-দিল্লী-কোলকাতা এবং কোলকাতা-ঢাকা রিটার্ন টিকেট আমাদের ট্যুরের প্রায় ৩ মাস আগে করে রাখি।

সময়ঃ ১০ দিন

গ্রুপ মেম্বারঃ ৫ জন

১ম দিনঃ

আগের দিন রাত ১১ টার দিকে আমাদের ঢাকা-কোলকাতা বাস রয়েল কোচ ছাড়ে কল্যানপুর থেকে। শুরু হলো স্বপ্নের উদ্দেশ্যে যাত্রা। যাত্রা ভালোই যাচ্ছিলো যদিনা পথে পাটুরিয়া ফেরীঘাট নামক যন্ত্রনাময় জায়গাটা না থাকতো। আমরা ফেরীঘাটে পৌছাই রাত ১.৩০টার দিকে কিন্তু আমরা ফেরীতে উঠতে পারি ভোর ৫টার দিকে।  ফেরী পার হতে মোটামুটি ৬.০০ টা বেজে যায়। আমরা সাথে কিছু হালকা খাবার নিয়ে নিয়েছিলাম। সেগুলো দিয়েই সকালের নাস্তা সেরে নেই। শুরু হলো আবার স্বপ্নযাত্রা। এবার বাধ শাধলো বেনাপোল ল্যন্ডপোর্ট। এখানে আপনি মোটামুটি প্রতি পাসপোর্টে ১০০-১৫০ টাকা দিলেই বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের সিল আপনি পেয়ে যাবেন কিছুক্ষনের মধ্যেই। এখন আসলো বর্ডার পার হবার পালা। কিন্তু কে জানতো সেখানেও আপনার জন্য আরেকটু ভোগান্তি অপেক্ষ্যা করছে। সেটা হলো আপনি যদি ব্যাবসায়ী হন তাহলে কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু যদি আপনি চাকুরিজীবী হন তাহলে বর্ডার পুলিশ আপনার কাছে আপনার অফিসের NOC চাইবে। যদি দিতে পারেন তাহলে সমস্যা নাই, যদি না দেখাতে পারেন ভোগান্তির শুরু তখনই। আমি আমার ভিসা এপ্লিকেশনের সাথে আসল কপি টা দিয়ে দিয়েছিলাম এবং কোনো ফটোকপিও রাখিনাই। তখনই তারা আমাকে পেয়ে বসলো। আমি কোনমতে ২০০টাকা তাদের হাতে দিয়ে পার পেয়ে যাই। ইন্ডিয়ার পার্টে ঝামেলা তুলনামূলক কম। আপনি লাইনে দারিয়ে যাবেন এবং সিস্টেমেটিক ভাবেই আপনি ইন্ডিয়ার বর্ডার ক্রস করতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনি সাথে শুধু টাকা অথবা ডলার বর্ডার ক্রস করে আমরা আমাদের সাথে বহন করা বেশীরভাগ টাকা রুপী করে নেই। আমাওরা যেহেতু এখন নিউমার্কেট এরিয়া তে যাচ্ছি না, তাই টাকা এখান থেকেই রুপী করে নেই। কিন্তু আপনি যদি নিউমার্কেট আগে যান, তাহলে আর করা দরকার নাই। সেখানে আপনি ভালো রেট পাবেন। এগুলো করতে করতে আমাদের প্রায় ১.৩০ টা বেজে যায়। এখন কথা হচ্ছে এগুলো করতে করতে আপনি যে পরিমান ক্লান্ত হবেন তাতে আপনি বাসেই যাবেন নাকি প্রাইভেট ট্যাক্সি নিয়ে যাবেন সেটা আপনাকে আবার ভাবতে হবে। যেহেতু আমরা ৫ জন ছিলাম আমরা একটা প্রাইভেট ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম। উদ্দেশ্য এয়ারপোর্টের কাছে একটি হোটেলে যেয়ে একটু ফ্রেশ আর বিশ্রাম নেয়া।আমরা একটা ট্যাক্সি দরদাম করে ১৮০০ রুপিতে পেয়ে যাই পেট্রাপোল থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। ড্রাইভারকে বলি এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটা হোটেলে নিয়ে যেতে।আমাদের ২.২০ মিনিটের মতো লাগে। সেখানে আমরা ২টা রুম নেই ১২০০ রুপি করে। আমাদের কোলকাতা-দিল্লী ফ্লাইট ছিলো স্থানীয় সময় রাত ৮টায়। এই হোটেল প্যাকেজে এয়ারপোর্ট ট্রান্সপোর্ট ছিলো। আমরা ৭টার আগেই এয়ারপোর্ট পৌছে যাই এবং এয়ারপোর্টের সকল প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। প্লেনে আপনার ২.১০ মিনিট লাগবে দিল্লী ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টে পৌছাতে। যেহেতু আমরা অনেক রাতে দিল্লী পৌছাই, তাই আমরা বুকিং.কম থেকে দিল্লী জামে মসজিদ এলাকায় আগেই একটা হোটেল বুক করে রাখি। রুম প্রতি আমাদের ভাড়া পরে ২৫০০ রুপি। জামে মসজিদ এলাকা পছন্দ করার কারন হচ্ছে মুস্লিম এরিয়া এবং খাবারদাবার। এয়ারপোর্ট থেকে আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি আমাদের হোটেলের ঠিকানায় চলে যাই। হোটেলে যেয়ে ফ্রেশ হবার পরে শরীরে আর একফোটা শক্তি অবশিষ্ট নাই। হোটেলেই খাবার আনিয়ে আমরা খেয়ে নেই এবং এক মুহুর্ত দেরী না করে শুয়ে পরি।

২য় দিনঃ

ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরীই হয়ে যায়। ৮.৩০ টার দিকে আমরা বের হয়ে জামে মসজিদ এলাকার হোটেলে নাশতা করে নেই। এরপর এদিক ওদিক একটু হাটাহাটি করি। ঘোড়াঘূরির মধ্যেই আমরা একটা ট্রাভেল এজেন্সির সাথে কথা বলি একটা গাড়ি ভাড়া করার জন্য। সৌভাগ্যবশত আমাদের এই ট্রিপের সবচাইতে দামী এবং প্রয়োজনীয় জিনিষটা পেয়ে যাই, সেটা হলো আমাদের ড্রাইভার রাজেশ। কেনো দামী বলেছি সেই কথায় পরে আসছি। রাজেশের সাথে আমাদের চুক্তি হলো সে আমাদের দিল্লী- আগ্রা- শিমলা-কুল্লু মানালী- দিল্লী- রোহথাং পাস ঘুড়াবে, টাকা দিতে হবে ৩২০০০ রুপী। শুরু হলো আমাদের মূল যাত্রা, উদ্দেশ্য আগ্রা-তাজমহল । তাজমহল পৌছাতে আমাদের প্রায় ৩ ঘন্টা লেগে যায়। পথে আমরা কয়েক জায়গায় আমরা স্টপেজ দেই। যেতে যেতে দেখি রাস্তার দুধারের সৌন্দর্য । আমাদের তাজমহল দেখার জন্য আর তর সইছিলোনা। টিকিট কাউন্টারে যেয়ে দেখি ভারতীয়দের জন্য অনেক কম, সার্কদেশভুক্ত নাগরিকদের জন্য ৫৫০রুপী আর অন্যান্য দেশের মানুষ হইলে আরো অনেক বেশী।

তাজমহল

আমরা সবাই মটামুটি ভালোই হিন্দী বলতে পারতাম, চাইলে আমরা ভারতীয়দের টিকেট কাটতে পারতাম। বাট নিজেকে ভারতীয় পরিচয় দিতে একটু যেনো কেমন লাগছিলো, তাই আসল টিকিট কেটে ফেললাম। মনে রাখবেন, সার্কভুক্ত নাগরিকদের এই টিকিট সাথে এক বোতল পানি এবং তাজমহলের ভেতরে জুতার উপরে ব্যাবহার করার জন্য এক ধরনের মাস্ক। যেহেতু তাজমহল একটি সমাধি, সেহেতু অবশ্যই এখানের পবিত্রতা রক্ষা করবেন। তাজমহলে ঢোকার আগে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিষ যেমন- পাসপোর্ট , মোবাইল, সেলফি স্টিক, ক্যামেরা ছাড়া আর কিছু সাথে নিবেন না। চেকিং এর সময় অন্যকিছু থাকলে ওরা রেখে দেয় এমনকি চুইংগাম ও। চেকিং পারি দিয়ে যখন আমরা তাজমহলের দেখা পেলাম, আমরা জাস্ট কিছুক্ষন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আর ভাবছিলাম একটা ইমারত কিভাবে মানুষের দৃষ্টি কেরে নিতে পারে। এজন্যই এটা বিশ্বের অন্যতম আশচর্যের একটি। তাজমহলের আরো একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো যমুনা নদীর পারের ঠান্ডা বাতাস যা আপনাকে বিমোহিত করবেই। পুরো এলাকাটায় এতো গরম, কিন্তু যেই আপনি যমুনা নদীর পাশটায় যাবেন আপনার প্রানটা জুড়িয়ে যাবে ঠান্ডা বাতাসে। এখানে আমরা ঘণ্টা দেড়েক ঘোরাঘুরি করি। সেখান থেকে বের হয়ে আপনার উদ্দেশ্য হতে পারে আগ্রা ফোর্ট। আমরা অবশ্য সময়ের অভাবে সেখানে যেতে পারিনাই। এটা এখনো আমার একটা আফোসোস। আমরা তাজমহল থেকে বের হয়ে আগ্রার কেএফসি তে ঢুকি দুপুরের খাবারের জন্য যদিও সুময় তখন দুপুর বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। লাঞ্চ শেষ করে আমরা গড়িতে চড়ে আবার রওণা করি দিল্লীর উদ্দেশ্যে। আসার পথে আপনারা অবশ্যই আগ্রার বিখ্যাত মিষ্টান্ন বা পিঠা কিনে নিবেন। দিল্লী পৌছাতে আমাদের প্রায় দশটা বেজে যায়। দিল্লী পৌছে আমরা একটা ধাবা থেকে হালকা কিছু খাবার খাই এবং কিছু শুকনা খাবার কিনে নেই যেহেতু আমরা একটা বড় জার্নি শুরু করতে যাচ্ছি। রাত ১১টার দিকে আমরা শুরু করি আমাদের যাত্রা, এবার উদ্দেশ্য হারিয়ানা চন্ডীগড় হয়ে শিমলা। আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো। অন্ধকার রাস্তায় তেমন কিছু দেখা হয়নাই। রাত ৩টার দিকে আমরা পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী হারিয়ানার একটা বিলাসবহুল ধাবাতে যাত্রাবিরতি দেই। রাজেশ ড্রাইভারকে নেয়ার সুবিধাটা ছিলো এখানেই। সে এই পুরো ট্রিপের সবগুলো ডেস্টিনেশন সম্পর্কে এতো ভালো জানতো যে সবকিছু তার একদম মুখস্ত। কোথায় ধাবা, কোথায় থামতে হবে, কোথায় কখন যেতে হবে, কোথা থেকে কোথাকার পাশ সংগ্রহ করতে হবে, এই সব কিছুই। হারিয়ানার ধাবা থেকে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম স্বপ্ন নগরীর পথে। পাঞ্জাব থেকে আমরা যখন হিমাচল প্রদেশের গেট দিয়ে ঢুকলাম, হঠাত কেমন কোত্থেকে যেনো একটা ঠান্ডা বাতাস এসে আমাদের জানান দিয়ে গেলো আমরা কিন্তু হিমাচল প্রদেশে ঢুকে গেছি। মোটামুটি ভোর ৫.৩০ টার দিকে আমরা শিমলার একটি হোটেলে যেয়ে থামি। দরদাম করে আমরা ২ টা রুম ২৫০০ রুপী তে পেয়ে যাই। এই সময় শিমলার তাপমাত্রা ছিলো ৭ ডিগ্রী। ঠান্ডায় মোটামুটি ভাবে আমরা জমে যাচ্ছিলাম। হোটেলে চেক-ইন করে ফ্রেশ হয়ে কোনো রকমে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুম দেই।

৩য় দিনঃ

ঘুম থেকে মোটামুটি ১১টার দিকে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমরা শিমলা শহর ঘুরতে বের হয়ে যাই। মল রোডে যেয়ে একটা হোটেলে নাস্তা সেরে কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আমরা কুফরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। পাহাড়ের কোল ঘেষে থাকা শিমলা শহরের সৌন্দর্যে আমরা বিমোহিত হতে থেকি। আমাদের মোটামুটি ঘন্টাখানেক লাগে কুফরী পৌছাতে। কুফরী জায়গাটা মোটামুটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০০ ফিট উচ্চতায়। আমরা Kufri Fun World এ গিয়েছিলাম। পুরো দিন উপভোগ করার জন্য এটি একটি বিনোদন পার্ক। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আপনাকে এই জায়গায় যেতে হলে ঘোড়া ভাড়া করতে হবে। এই ঘোড়ার পিঠের জার্নিটাই আপনাকে অনেক আনন্দ দিবে। এই পার্ক পরিবারের জন্য একটি স্মরণীয় দিন একটি চমত্কার গন্তব্য, বিভিন্ন রাইড, পুল এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ go-kart ট্র্যাক দিয়ে পাবেন আপনি। আমরা এখানে প্রথম বারের মতো আপেল গাছের দেখা পাই। কুফরীতে বেশকিছু মনোমুগ্ধকর সময় কাটিয়ে আমরা মোটামুটি বিকেল ৫টার দিকে আবার যাত্রা শুরু করি, এবার উদ্দেশ্য কুল্লু-মানালী। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো রাতেই কুল্লু পূছে সেখানে বিশ্রাম নিবো, কিন্তু পাহাড়ি আঁকাবাকা পথ টানা দুইদিন ধরে জার্নি করার কারনে আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং আমরা সিদ্ধান্ত নেই আমরা পথেই একটি হোটেলে রাতে বিশ্রাম নিবো। অবশেষে সুন্দরনগর নামক একটা জায়গায় আমরা একটি এপার্টমেন্ট টাইপের হোটেলে ২টা রুম ৪০০০ রুপীতে নিয়ে যাই। রাতে সেই এপার্টমেন্ট এর খাবার আনিয়ে খেয়ে নেই।

আপেল গাছ

৪র্থ দিনঃ

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমরা কুল্লুর উদ্দেশ্যে রওনা করি। পথে একটা দোকান থকে কছু ব্রেড আর কলা নিয়ে নেই নাশতা করার জন্য। শিমলা থেকে কুল্লু যাবার রাস্তাটাই একটা দেখার মতো জায়গা। রাস্তার দুই ধারে বড় বড় পাহাড় আর বিয়াস নদীর স্রোতধারা আপনাকে বিমোহিত করতে বাধ্য। সুন্দরনগর থেকে মোটামুটি ২৫ কিলোমিটার পথ পেরোলেই আপনি পৌছে যাবেন মান্ডি। আমদের সাথে গাড়ি থাকার একটা অন্যতম উপকারিতা ছিলো যে আমরা বিভিন্ন জায়গায় নেমে সেখানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছি। মোটামুটি দুপুর ১.০০ টার দিকে আমরা কুল্লু পৌছাই। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাফটিং করা। আমি আপনাকে গ্যরান্টি দিতে পারি, এই রাফটিংটাই হবে আপনার জিবলে সবচেয়ে এক্সাইটিং এবং মেমোরেবল জার্নি। আমি আপনাকে বলেও বোঝতে পারবোনা রাফটিং আপনাকে কি পরিমান আনন্দ আর এক্সাইট্মেন্ট দিবে। এখানে রাফটিং এর ৩ টা প্যাকেজ আছে। আমরা রিজার্ভ করে নিতে চেয়েছিলাম বলে ওরা আমাদেরকে ৩ কিমি= ২০০০( যেটা আসলে কিছুই মনে হবেনা আপনার কাছে) , ৭ কিমি=৩৫০০ এবং ১২ কিমি= ৫৫০০ রুপি চাইলো এবং আপনি যদি পুরো রাফটিংটা ভিডিও করতে চান সেজন্য আপনাকে একট্রা ৮০০ রুমি গুনতে হবে। টাকা পয়সার কথা চিন্তা না করেই আমরা ৫ জন ৭কিমি’র প্যাকেজ আর ভিডিও প্যাকেজ নিয়ে নিলাম। বিশ্বাস করেন, ৭কিমি মনে হলো সেকেন্ডের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো যদিও আমাদের প্রায় ২০ মিনিটের মতো লেগেছিলো। রাফটিং শেষ করে একটু ফটোসেশন সেরে আমরা জামাকাপড় বদলে সেখানের একটা হোটেলে খাওয়া দাওয়া শেষ করি। এখানে আপনি বেশকিছু দকান পাবেন যেখানে আপনি মোটামুটু সুলভ দামে শীতের কাপড় চোপড় কনেকাটা করতে পারবেন । আমরাও কিছু শপিং করে নিলাম এবং মানলীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কুল্লু থেকে মানালী ৬৯ কিমি দুরত্বে। মানালী পৌছতে আমাদের প্রায় ৫টা বেজে যায়। মানালী পৌছে আমাদের প্রধান কাজ থাকে ২টা প্রথমটা হচ্ছে একটা হোটেল নেয়া এবং পরের দিন রোহথাং পাস যাওয়ার পার্মিট পাশ জোগার করা। রাজেশের কল্যানে আমরা একটা কটেজ এ ২ টা রুম পেয়ে গেলাম ২৭০০ রুপীতে। আর রোহথাং পাস যাওয়ার পারমিট রাজেশ জোগাড় করে ফেললো ১২০০ রুপীতে। মনে রাখবেন রোহথায় পাস এর পারমিট আপনাকে অনেকেই দিতে চাইবে, এমনকি আপনাকে হোটেল থেকেও বলবে। বাট ওরা অনেক বেশী চাইবে। চেষ্টা করবেন দামাদামি করে নেয়ার জন্য। সেটা আপনি যেখান থেকেই নেন। আমরা রাজেশের কাছে ১২০০ রুপী পেয়েছিলাম যা সবচেয়ে কম ছিলো। সেদিন রাতে মানালী মল রোডে গেল্মা একটু ঘোরাফেরা করলাম। মানালীতে রাতের বেলা মটামুটু ভালোই শীত পরে। আমরা সেপ্টেম্বরে গিয়েছিলাম, তখন দিনের বেলা মোটামুটি ১০ ডিগ্রী এবং রাতের বেলা সেটা ৫ ডিগ্রীতে নেমে যেতো। যেহেতু আমরা অনেক ক্লান্তও ছিলাম, তাই বেশী দেরী না করে একটা হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে আমরা কটেজে চলে আসলাম এবং ঘুমিয়ে পরলাম, যেহেতু আমাদের পরের দিন খুব সকাল বেলা বের হতে হবে রোহথাং পাসের উদ্দেশ্যে।

৫ম দিনঃ

কুয়াশায় ঢাকা ভোরে আমরা রওনা দিলাম রোহথাং পাস এর উদ্দেশ্যে, সময় তখন সকাল ৬.৩০। আমার কাছে রোহথাং পাস যাওয়ার রাস্তাটাই সবচেয়ে এক্সাইটিং আর ভয়ঙ্কর লেগেছে। সরু পাহাড়ী রাস্তা ঘেষে আমরা শুধু উপরেই উঠছি আর উঠছি। যদিও নিচের দিকে তাকালে অনেক ভয় লাগছিলো, আবার অনেক আশ্চর্যও হচ্ছিলাম আল্লাহর দেয়া অপরুপ সৃষ্টি দেখে। মানালী থেকে রোহথাং পাস ৫৫কিমি। যেতে লাগে প্রায় ২.৩০ ঘন্টা। পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ী চালানো অনেক কঠিন। সেক্ষেত্রে যদি ভালো ড্রাইভার না হয় আপনার পুরো জার্নিটাই নষ্ট হয়ে যাবে। সেদিন দিয়ে আমরা অনেক ভাগ্যবান ছিলাম যে আমরা একটা ভালো ড্রাইভার প্লাস গাইড পেয়েছিলাম। পথের মাঝখানে আমরা একটা হোটেল পাই, সেখানে সকালের নাস্তা করে নেই। রোহথাং পাস পৌছে আমাদের তো চোখ ছানাবাড়া। আল্লাহ কি সৃষ্টি করে রেখেছেন…!!! আমরা শুধু দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম। কিন্তু রোহথাং পাসে আপনার অনেক শ্বাসকস্ট হবে। তাই চেষ্টা করবেন আস্তে আস্তে দম নিয়ে নিয়ে হাঠতে। এখানে আপনি মানালীর ট্রেডিশনাল ড্রেস পাবেন। ১০০ রুপী করে ভাড়া নিয়ে আপনি সেখানে ছবি তুলে নিতে পারে। আমরা মটামূটি ঘন্টা খানেক সেখানে থেকে যখন তীব্র ঠান্ডা আর বাতাসে টিকতে পারছিলামনা, তখন ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। আপনি পথে সোলাং ভ্যালী পরবে, চাইলে আপনি সোলাং ভ্যালীতে পেরাগ্লাইডীং করতে পারেন। ১০ মিনিটের জন্য আপনাকে গুনতে হবে কমপক্ষে ২৫০০-৩০০০ রুপী। আমরা মটামুটি দুপুরের মধ্যেই মানালী ফিরে আসি এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজেদের মতো করে হোটেলেই সময় কাটাই। সন্ধায় আবার মল রোডে যাই, কিছু শপিং করি। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে কটেজে ফিরে আসি।

রোহথাং পাস

৬ষ্ঠ দিনঃ

এইদিন টা ছিলো আমাদের এই ট্যুরের সবচেয়ে কষ্টের দিন।একেতো মানালী ছেড়ে একদমই মন চাচ্ছিলোনা, তার মধ্যে সকালে মানালী থেকে রওনা দিতে হবে দিল্লীর উদ্দেশ্যে যা প্রায় ১৫ ঘন্টার জার্নি। কিছুই করার নাই। আমরা সকাল ৮.৩০ এর দিকে শুরু করলাম।আসার পথে আমরা বেশকিছু আপেল কিনে নেই। যা আমাদের রাস্তায় অনেক কাজে দেয়। মোটামুটি দিল্লী পৌছাতে পৌছাতে আমাদের রাত ১২.৩০ টা বেজে গেলো। আমাদের যেহেতু কোনো হোটেল বুকিং করা ছিলোনা, আমরা দিল্লী রেল স্টেশন এলাকায় ২ টি রুম নিয়ে নেই ২০০০ রুপীতে। এভাবেই আমাদের ৬ষ্ঠ দিন শেষ হয়।

৭ম দিনঃ

এদিন আমরা প্ল্যান করি দিল্লী ট্যুরের জন্য। আমরা মটামুটি ভাবে কিছু জায়গা সিলেক্ট করি। আমরা প্রথমে যাই লালকেল্লা। লালকেল্লা আপনাকে মনে করিয়ে দিবে এবং বুঝিয়ে দিবে মুঘলরা আসলে কি ছিলো। এখানে আমাদের ঘুরতে প্রায় ১.৩০ ঘন্টা চলে যায়। লালকেল্লা ঢোকার রাস্তায় একটা ছোটখাট মার্কেট পাবেন যেখানে থেকে আপনি অনেক গিফট আইটেম শপিং করতে পারবেন। লালকেল্লা থেকে বের হয়ে আমরা দুপুরের খাবারের জন্য মেকডোনাল্ডস এ গেলাম। লাঞ্চ শেষে আমরা গেলাম নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে, সেখানে খুব বেশী দেরী না করে আমরা চলে গেল্মা রাষ্ট্রপতি ভবন আর ইন্ডীয়া গেট দেখতে। ঈণ্ডীয়া গেটে নেমে সেখানে রাংদে বাসান্তী স্টাইলে কিছু ছবি তুলে চলে গেলাম কুতুব মিনার দেখতে। সত্যি কথা বলতে আমার কাছে কুতুব মিনার জায়গাটাই সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো। আমরা সেখানে মটামুটি সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় কাটালাম । আমাদের রাত ১০টায় দিল্লী- কোলকাতা ফ্লাইট ছিলো। অতঃপর আমরা একটা হোটেলে রাজেশ কে নিয়ে রাতে খাবার খেয়ে রাজেশ আমাদেরকে ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিল। আমরা ওকে ওর পাওনা বুঝিয়ে থাঙ্কস দিয়ে আমরা এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে যেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করে প্লেনের জন্য ওয়েট করতে থাকলাম। আমাদের কোলকাতা পৌছাতে ১২.২০ বেজে যায়। আমরা এয়ারপোর্টে বসে একটা প্ল্যান করি যে আমরা রাতটা এয়ারপোর্টে কাটিয়ে ভোরবেলা কোলকাতা নিঊমার্কেটে যেয়ে হোটেল নিবো। যেই কথা সেই কাজ। আমরা ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। কিন্তু অপেক্ষা করতে যেয়ে বুঝলাম, এভাবে সময় কাটানোটা কতো কঠিন। কিন্তু কিছু করার নেই কোনো রকমে আমরা ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করি, অবশেষে ভোর হয়ে গেলে একটা ট্যাক্সি করে সেখানে যেয়ে একটা হোটেল বুকিং করি রুম প্রতি ১৭০০ রুপি। আমরা এতোটাই ক্লান্ত ছিলাম কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দেই।

৮ম দিনঃ

দুপুর ১২টায় দিকে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে একটা মুস্লিম হোটেল পেয়ে যাই, সেখানে গরুর মাংশ য়ার ডাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খাই। আহা…কি শান্তি। তারপরে চলে যাই নিউ মার্কেটে, উদ্দেশ্য শপিং করা। সন্ধ্যার দিকে আমরা স্ট্রীট ফুড খাই। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে সময় কাটাই। কোলকাতা গেলে আরেকটি মাস্ট গো প্লেস হচ্ছে কফি হাউজ। সেখানেও আমরা কিছু সময় কাটাই। এভাবেই আমাদের ৮ম দিন পার করি। কোলকাতায় যেয়ে আপনি যদি শ্রীলেদারসে গিয়ে জুতা না কিনেন, তাহলে আমি বলবো আপনি মস্ত বড় একটা জিনিষ থেকে বঞ্চিত হলেন। অবশ্যই শ্রীলেদার, বিগ বাজার এ যাবেন।

৯ম দিনঃ

এইদিন আমাদের উদ্দেশ্য কোলকাতা ঘোরা। আমরা ১১ টার দিকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে তাতে ভিক্টরিয়া মেমরিয়াল, সাইন্স সিটি, ফোর্ট ঊইলিয়াম, হাওড়া ব্রীজ ঘুরি। রাতে বেলা আবার কিছু শপিং।

১০ম দিনঃ

অবশেষে একটা মনে রাখার মত ট্যুর শেষ করে বাড়ী ফেরার পালা। সকালে উঠেই কোলকাতা নিউ মার্কেট থেকে চকলেট কিনে নিয়ে আসি। এবং লাগেজ গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে পরি। দুপুর ২টায় আমাদের রিটার্ন ফ্লাইট ছিলো রিজেন্ট এয়ারে। ৩৫ মিনিটের জার্নি শেষে আমরা প্রানের বাংলাদেশে পৌছে একটা শান্তির নিঃশ্বাস নেই। আসলেই দেশের চেয়ে শান্তির জায়গা আর কিছুতেই কোনো জায়গা হতে পারেনা। এভাবেই আমদের জিবনের একটি অন্যতম ট্যুরের যবনিকা ঘটে।

এবার আসি খরচে

আমি এখানে আমাদের পাচজনের টোটাল ট্যুর খরচের বিবরন দিচ্ছি।

  • ঢাকা- পেট্রাপোল (যদিও আমরা কোলকাতা পর্যন্ত টিকেট করেছিলাম) = ৫*১৮০০ = ৫৪০০ টাকা
  • কোলকাতা- দিল্লী- কোলকাতাঃ ৫*৯০০০ = ৪৫০০০ টাকা
  • কোলকাতা- ঢাকাঃ ৫*৭৫০০ = ৩৭৫০০ টাকা
  • পেট্রাপোল টু এয়ারপোর্টঃ ট্যাক্সি ১৮০০ রুপি
  • রাজেশঃ ট্যাক্সি ৩২০০০ রুপি
  • হোটেলঃ সব জায়গার হোটেলে আমাদের টোটাল খরচ পরে = ৩১১০০ রুপি
  • বিভিন্ন পারমিট + টিকেট + রাফটিং + কুফরি পার্কে ঘোড়া = ১১৯৫০ রুপি
  • খাওয়া-দাওয়া + কোলকাতায় বিভিন্ন ট্যাক্সিঃ ২৫০০০ রুপি

টোটাল খরচঃ ৮৭৯০০ টাকা + ১০১৮৫০ রুপি (১,২০,১৮৩ টাকা) = ২,০৮,০৮৩ টাকা (৫জন) = ৪১৬১৬ টাকা জন প্রতি।

বিঃদ্রঃ ঘুরতে যেয়ে যতটুকু সম্ভব সময় কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। বিমান টিকেট চেষ্টা করবেন ২-৩ মাস আগে কাটতে। উল্লেখিত টিকিট প্রাইস সবসময় আপডাউন করে। আপনারা চাইলে দিল্লী যেয়ে রাজেশের গাড়ী নিতে পারেন। রাজেশের নাম্বারঃ +৯১ ৮৩৭৭০৩১২৪১

Leave a Comment
Share