অন্য পথে কেদারনাথ হাইক

30th May 2009

কেদারনাথ নাম শুনলেই মনটা কেমন করে না? যারা একবার কেদারনাথ গিয়েছেন তাদের মনে হয় যেন বার বার কেদার ডাকছে, আবার কবে যাবো? আর যারা কেদারনাথ যাননি তারা ভাবছেন এই পূজোর ছুটিতে যদি কেদারনাথ যেতে পারতাম!

বর্তমানে শোনপ্রয়াগ থেকে হাঁটতে হয়। এখান থেকে গৌরীকুণ্ড চার কিমি। গৌরীকুণ্ড থেকে সাড়ে ছয় কিমি দূরে ভীমবলি, সেখান থেকে আট কিমি দূরে লিঞ্চোলি, লিঞ্চোলি থেকে কেদারনাথ পাঁচ কিমি অর্থাৎ আগে যেটা চোদ্দ কিমি ছিল বর্তমানে সাড়ে তেইশ কিমি হাটতে হয়।

এছাড়াও ঘুত্তু থেকে হাটা শুরু করুন মাওয়ালী পাস cross করে পৌছে যাবেন কেদারনাথ মন্দিরে। আরো একটা ট্রেক রুট আছে বদ্রীনাথ থেকে নীলকন্ঠ পাস cross করুন পানপাতিয়া গ্লেসিয়ার হয়ে পৌছে যাবেন কেদারনাথ মন্দিরে।

আমরা একটু অন্য পথে যাবো। শীতকালে কেদারনাথ মন্দিরের মূর্তিগুলিকে ছয় মাসের জন্য ঊখিমঠে নিয়ে গিয়ে পূজা করা হয়। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল কেদারখণ্ড; তাই এখানে শিবকে কেদারনাথ অর্থাৎ কেদারখণ্ডের অধিপতি নামে পূজা করা হয়। ঊখিমঠ (ওখিমাথও লেখা) ভারতের উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার একটি ছোট শহর এবং হিন্দু তীর্থস্থান, এটি ১৩১১ মিটার উচ্চতায় এবং রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ৪১ কিমি দূরে অবস্থিত। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ঊষা(ভানাসুরের কন্যা) এবং অনিরুদ্ধ(ভগবান কৃষ্ণের নাতি) এর বিবাহ এখানে হয়েছিল। ঊষা নামে এই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছিল উশমথ, বর্তমানে ঊখিমঠ নামে পরিচিত। আমরা কথায় কথায় বলি না “মান্ধাতা আমোল থেকে” সেই রাজা মান্ধাতা এখানে ভগবান শিবকে তপস্যা করেছিলেন।

ঊখিমঠ

শীতকালে ভগবান কেদারনাথের উৎসব ডোলি কেদারনাথ থেকে এই স্থানে নিয়ে আসা হয়। ঊখিমঠে রয়েছে আরও অনেক প্রাচীন মন্দির। পবিত্র শহরটি মূলত কেদারনাথের প্রধান পুরোহিতদের রাওয়াল নামে পরিচিত। ঊখিমঠের সাথে কেদারনাথের এক নিবিড় সম্পর্ক আছে, তাই আমরা যাবো ঊখিমঠ থেকে কেদারনাথ। অন্য পথে কেদার, আমরা ১০ জন ঠিক করলাম ঊখিমঠ থেকে কেদারনাথ যাবো।

এটা বলছি 2009 সালের মে মাসের 30 তারিখের কথা। দুন এক্সপ্রেস ধরে হরিদ্বার সেখান থেকে বাসে করে গেলাম ঊখীমঠ। ঊখীমঠে আমাদের গাইড দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একটা হোটেলে উঠলাম, তারপর সব রেশান কিনে প্যক করে রেডি। আজ 2nd June 2009 সকালে ঊখীমঠ মন্দির দর্শন করে ছোট গাড়ী ধরে রওনা হলাম 12 কিমি দূরে ওনিওনা গ্রাম, তখন এই পর্যন্তই গাড়ি যেত। এখন রাশি গ্রাম পর্যন্ত গাড়ি চলে যায়। খুব সুন্দর ছোট্ট গ্রাম ওনিওনা, পাহাড়ের ঢালে ঝুম চাষ হওয়ায় দারুন লাগছে দেখতে। গাড়ি থেকে নেবে হাঁটা শুরু করলাম, দুই ঘন্টার রাস্তা রাশি গ্রাম। রোদের জন্য সবাই একেবারে ঘেমে নেয়ে গেছি। আজ থাকবো রাশি গ্রামে। সস্তার একটা ঘর সহজেই পেয়ে গেলাম। গ্রামে বাইরের লোক বলতে শুধু আমরা। দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। শেষে এলাম মন্দিরে। এই মন্দিরের নাম রাকেশ্বরীর মন্দির। একদম পাড়ার মধ্যে ছোট মন্দির। কেউ নেই শুধুই আমরা, গ্রামের একজন বয়স্ক লোক বললেন জুতো খুলে ঢুকবেন, ব্যস এর থেকে বেশি কোন নিয়ম নেই। নিজেই নিজের ইচ্ছে মতো পুজো করো। একটা বিশেষত্ব চোখে পরলো, সেটা হল এখানকার যজ্ঞের আগুন কখনো নেবে না। 6 ইঞ্চি মোটা পাথর দিয়ে 4 ফুট বাই 4 ফুটের যজ্ঞের জায়গা। সেখানে একটা মোটা গাছের গুঁড়ি ঢিমে আগুনে ধোঁয়া বেরচ্ছে। তাই মন্দিরের সিলিং কালো হয়ে গেছে। মন্দিরের ভেতর ধোঁয়ায় ভর্তি। আমার ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে, তাই বেশিক্ষন থাকতে পারিনি।

রাশি গ্রাম

আজ 3rd June 2009

সকালে সব গুছিয়ে মন্দিরে গেলাম, সেজদা আর অরবিন্দদা মন্দিরে পূজো দিলেন। রুটি আলুর তরকারি খেয়ে বেরিয়ে পরলাম, ঘড়িতে তখন সকাল ৮ টা ১০ হাটা শুরু। এই রাশি গ্রামের মানুষ খুব আন্তরিক, একদিনের আলাপ মনেই হল না। যাবার আগে একজন বয়স্ক মহিলা বল্লেন, “সাবধানে যাবে।” গ্রাম ছাড়িয়ে বেড়তেই চড়াই শুরু। একটু এগোতে চোখে পরলো দুটো ছোট শিশু নিজের জমিতে চাষ করছে। লাঙ্গল টানার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে ছোট ছেলেটি আর মেয়েটা লাঙ্গল ধরে আছে, ওরা ভাই বোন এই জমিতে চাষ করে। ওদের ৪ টে লজেন্স দিয়ে টাটা করে আবার হাঁটা শুরু। বড্ড গরম তার উপর চড়াই রাস্তা তাই একটা বড় গাছের ছায়ায় সবাই বসলাম। একটু জল সাথে আড্ডা। আমরা আস্তে হাঁটি তাই আজ খুব বেশী হাঁটাও নেই, চারদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছি বড় বড় রডড্রেনড্রন গাছে লাল লাল ফুলে ভরে, কত্তো নাম না জানা পাখি তাদের মিষ্টি ডাক শহর ছেড়ে নির্জনতাকে আরো নিবিড় করে টানে। রাস্তার দুদিকে সবুজ ঘাসের ঢাল ছোট বড় মাঝারি গাছ সুন্দর করে সাজানো। আবার ঘন্টাখানেক চলার পর সবুজ ঘাসের উপর গরাগরি, মনটা কেমন শিশু শিশু হয়ে ওঠে। এই ভাবে আড্ডা আর হাঁটা প্রায় ৪ ঘন্টা ১৫ মিঃ পর পৌঁছলাম বাজারকোঠি। না আছে বাজার না আছে কোঠি তাও যে কে নাম দিল এই জায়গাটার নাম বাজারকোঠি কে জানে!! তবে ক্যম্প সাইটটা দারুন, সবুজ ঘাসের ঢাল যেন নরম কার্পেট পাতা পিছনে পাহাড় উঠে গেছে বড় বড় গাছ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। চা নিয়ে বসে আলোচনা শুরু হলো।

এবার আমাদের সবার সাথে আলাপ করে নিন।

  1. অরবিন্দ ভরদ্দাজ
  2. তপন দাস ( সেজদা )
  3. রুদ্র নারায়ন সাহা
  4. সুজয় ভট্টাচার্য্য
  5. জীবন সাহা
  6. অঞ্জন ভট্টাচার্য্য
  7. তপন সাহা
  8. আশীষ গুইন
  9. চঞ্চল রক্ষিত
  10. আমি মৈনাক কর্মকার

এই ট্রেকে আমায় টিম লিডার করা হয়েছে। আমাদের ট্রেকে যে কোন সিদ্ধান্ত আমরা সবাই মিলেই নিয়ে থাকি তাই লিডারের তেমন গুরত্ব নেই। চঞ্চল রক্ষিত এই প্রথম ট্রেক করছে, কাজেই সবাই ওর প্রতি যত্নবান। আবার ট্রেকের কথায় আসি বাজারকোঠিতে জলের খুব অভাব। প্রায় ২ কি.মি. দূর থেকে জল আনতে হল তাও কাদাগোলা নোংরা জল। কিসে করে জল আনলো জানেন? বড় প্লাষ্টিক ক্যরি ব্যাগ। ঐ জলই ফুটিয় ঠান্ডা করে আমরা খেলাম, আর রান্না হল। না কোন ছবি তোলা হয় নি। রাতে ৮ নাগাদ খেলাম তারপর আবার আড্ডা দিয়ে ঘুম।

4th June 2009

ভোর বেলা ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। টেন্টের বাইরে বেরতেই একটা দারুন দৃশ্য চোখে পরলো। পূর্বদিকে পাহাড়ের পিছন থেকে সূর্যের আলোর ছটা আকাশ জুরে এক কথায় মন ভালো করা সকাল। নিজের সব কিছু গুছিয়ে টেন্ট তুলছি হঠাৎ চোখে পরলো পাহাড়ী বিছে ঠিক টেন্টের বাঁদিকের কোনে। প্রথমে বুকটা ধরাস করে উঠলেও, পরে দেখলাম সে মৃত। সব গুছিয়ে বেড়তে ৭ টা বেজে গেল। নীল আকাশ সবুজ পাহাড় বড় বড় গাছে কচি পাতায় রোদ পরে এক অসাধারন দৃশ্য। ভালো লাগলেও বেশিক্ষন বসে উপভোগ করবেন তার উপায় নেই। আজ অনেকটা পথ হাঁটা। চলার শুরুতেই চড়াই বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে মিঠে রোদ এসে পরছে আমাদের গায়ে। একটানা চড়াই ওঠার পর ছোট একটা সবুজ মাঠ তার উপর সরু পায়ে চলা পথ, দু দিকে পাহাড়ের ঢাল উঠে গেছে। আবার চড়াই উঠতে উঠতে এক সময় পৌঁছলাম কানাড়া খড়ক। বড় একটা পাথরের ওভার হ্যঙ। সেখানেই আমাদের সবাই বিশ্রাম করছে। এক চা বিরতি। এখানে ভেড়াওয়ালা থাকে তাই জায়গাটা সুন্দর করে পরিস্কার করা।

পাতুরী ক্যাম্প সাইট

৩০ মিঃ এর বিশ্রাম আবার চড়াই তবে এবার পাথরের উপর দিয়ে চলা, একটু এগতে দেখলাম দুদিকে পাথরের দেওয়াল আর তিন ফুট চওড়া পথ। ৪০ ফুট এভাবে চলার পর আবার রডড্রেনড্রনের জঙ্গলে পরলাম। এখানে রডড্রেনড্রন গাছের উচ্চতা ৬ ফুটের মতো। বুঝতে পারলাম অনেকটা উঠে এসেছি। তবে বেশ কিছু বড় বড় চীর গাছ তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়। ঘড়িতে ২:১৫ পৌছলাম পাতুরী। সরু ছোট একটা রিজের উপর Camp site চারিদিক সবুজ। টেন্ট লাগিয়ে চায়ে মুখ দেব বৃষ্টি শুরু। সবাই টেন্টে ঢুকে গেল, একটু পর বৃষ্টি থামলো। সবাই বেরিয়ে এলাম যে যার কাজে লেগে গেল। আজ পরিস্কার জল পেলাম তাই সবাই নিজের নিজের বোতল ভরতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। আমি গেলাম রান্না ঘরে। আজ রাতের মেনু লোভনীয় লুচি আর ছোলার ডাল। সন্ধ্যা নাবার আগে পশ্চিম আকাশে আলোর খেলা চলছে কালো মেঘের বুক চীরে আলোর একটা বিম। অনেকটা নাটকের স্পট লাইটের মতো।অনেক গুলো ছবি তুল্লাম । রাত ৮ টা নাগাদ খাওয়া শেষ হল। শেষ পাতে হলদিরামের কাজু বরফি আহাঃ, এটা অরবিন্দ দা নিয়ে এসেছে। Good Night ঘুমতে গেলাম।

5th June 2009

ঝকঝকে আলোর সকাল। সকালে আমাদের তাড়া একটু বেশী থাকে। সবাই ফ্রেশ হয়ে মাল গুছিয়ে রেডি। আজ হাঁটা শুরু করতে ৮ টা বেজে গেল। ১০০ মিটারের মতো হালকা চড়াই পেরিয়ে ছোট একটা সমতল জায়গা তারপর সামনে টানা চড়াই প্রায় ৬০ ডিগ্রী ঢালে উঠতে হবে, থোকা থোকা বড় বড় ঘাস আর পাথর। একে একে সবাই উঠছে শেষে আমি আর আশিষ গুইন। হঠাৎ দেখি একটা ছোট ৮ ইঞ্চি সাইজের বোল্ডার কারুর পায়ের চাপে গড়িয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমি পাথরের দিকে চোখ রেখে আশিষকে চেঁচিয়ে বল্লাম,”বোল্ডার বোল্ডার” কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়, আশিষ কানে একেবারেই শুনতে পায় না ও লিফ রিডিং করে কথা বোঝে। কাজেই আশিষ আমার কথা শুনতেই পায়নি। আমি বোল্ডার দেখে বাঁ দিকে সরে গেলাম আশিষ আমার থেকে ১০ ফুট নীচে, ও মাথা তুলে উপরে তাকাতেই দেখে বোল্ডার ওর বুকের কাছে। দু হাত সামনে বাড়িয়ে কোন মতে আটকালো বোল্ডারটাকে আর কাৎ হয়ে পরলো।

আমি Sack ফেলে দৌড়ে ওর কাছে গেলাম দেখি হাতে হালকা চোট লেগেছে, পাথরের খোচায় একটা আঙ্গুল কেটেছে তবে আঘাত গুরুতর নয়। আশীষ বল্লো , “আমার Camera টা ঠিক আছে, কিছু হয়নি।”একটু জল চোখে মুখে দিয়ে দেখলাম ও ঠিক আছে। আবার চলা শুরু, ঐ খারাই ঢালে ওঠার পর দেখলাম একটু সমতল ঘাসের ঢাল সেখানে সবাই একটু বিশ্রাম নিলাম আবার হাঁটা শুরু। ১ ঘন্টা চলার পর দেখি আরো খাড়াই প্রায় climbing করার মতো করে চার হাত পায়ে উঠছি। এই ভাবে বেশ কিছুটা ওঠার পর দেখি আর ঐ রকম চার হাত পায়ে উঠতে হবে না। আমরা উত্তর পশ্চিম কোন বরাবর যাবো , এখানে আর কোন গাছের দেখা পেলাম না। পাহাড়ের কোল দিয়ে আড়াআড়ি চলেছি (Traverse করে )। টানা ২ ঘন্টা হাঁটার পর বিশ্রাম। জলের সাথে Glucon-d গুলে খেলাম তারপর আবার আড়াআড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠছি, এক সময় দেখি আমাদের সবাই ব্যস্ত কেউ টেন্ট লাগাচ্ছে কেউ চায়ের বন্দোবস্ত করছে। এই Camp Site এর নাম থৌলী। বিকেল ৪ টে ২০তে পৌছলাম থৌলী (উচ্চতা ১২৮০০ ফুট )বিকেল ৬:৪৫ আকাশ কালো হয়ে গেল, শুরু হল ঝোড়ো হাওয়া । সবাই টেন্টের ভিতরে। টেন্টের পোল ধরে বসে আছি, যাতে টেন্ট না পরে যায়। এবার শুরু হল মুশল ধারায় বৃষ্টি।

৫ মিনিটের মতো বৃষ্টির পর সাবুদানার মতো বরফ পরা শুরু করলো। আমাদের টেন্টে আমি রুদ্রদা টুটুদা। বরফের মধ্যেই বেরিয়ে টেন্টের দড়ি গুলো টান করে বড় বড় পাথরের সাথে বাঁধলাম। কিছুক্ষন পর দেখি টেন্টের outer লুজ হয়ে গেছে। আবার বেরলাম দেখি আমি যে পাথরে বেঁধে ছিলাম সেটা তুলে নিয়ে পাশের টেন্টের দড়ি বাঁধা। এটা জীবনদার কাজ, জীবনদা বেড়িয়ে ছিল ওদের টেন্ট ঝাড়তে তখনই পাথর চুরি। ৮টা নাগাদ সব শান্ত হল, খেয়ে জম্পেশ ঘুম।

6th June 2009

সকালে পরিষ্কার আকাশ দেখে মনেই হল না কাল সন্ধ্যায় ঐ রকম ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। চৌখাম্বা পিক একদম হাতের কাছেই। চৌখাম্বা ছাড়াও থৌলী থেকে দেখা যায় পার্বতি শৃঙ্গ, পার্বতি গলি, কাচনী খাল, ঘিউবিনায়ক পাস, বুড়া মদমহেশ্বর এ ছাড়াও অনেক পর্বত শৃঙ্গ, আমি সব শৃঙ্গের নাম জানি না , জানলে বলতাম। থৌলী জায়গাটা এক কথায় অসাধারন। আমাদের দলের সবাই বাইরে দাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে শৃঙ্গ গুলোকে চিনে নেবার চেষ্টা করছি। তপা সবাইকে চা দিয়ে গেল। রান্নাঘরের লোকজন packed lunch রেডি করতে ব্যস্ত। খুব সুন্দর একটা সকাল। আচ্ছা আমরা পাহাড়ে যাই কেন? শুধু পিঠে sack নিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটবো বলে। এই যে চারদিকে চেনা অচেনা পিক, সবুজ বিস্তীর্ণ ভ্যলি, উপর থেকে নীচে তাকিয়ে বুড়া মদমহেশ্বর দেখা, এই গুলোর জন্যই এতো খরচ করে, পরিশ্রম করে ট্রেকে আসি। আর এই সাত দশ দিন ধরে প্রকৃতিকে যে ভাবে কাছে পাই নিবিড় করে সেটা সারা জীবন স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে যায়। পাহাড়কে অনেক রকম ভাবে দেখা যায়, কেউ দেখে দূর থেকে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে থেকে আবার কেউ কেউ তার কোলের কাছ ঘেঁষে পাহাড়কে বুকে জড়িয়ে ধরে।

এই ধরুন আমি ২০০৯ সালের কথা আপনাদের বলছি তো, অথচ আজ ২০২০ তে আমার মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা। আমার পুরো জায়গাটা চোখের সামনে। দেখলেন, এই গল্প করতে বসলেই দেরি হয়ে যায়, আজ বেড়তে সত্যিই দেরি হয়ে গেল। সারে আটটা বাজে চলুন হাঁটা শুরু করি। আজ কিন্তু অনেকটা হাঁটা । পাহাড়ের গা বেয়ে আড়াআড়ি উপরে ওঠা। এখানে নির্দিষ্ট কোন পথ নেই। কোথাও ঘাস কোথাও বোল্ডার, যার যেখানে খুশী পা ফেলুন শুধু মনে রাখবেন সাবধানে দেখে এগোতে হবে। আপনি কি হাঁপিয়ে গেলেন তাহলে একটু দাঁড়িয়ে আশপাশটা দেখুন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিন আবার চলুন সামনে আরোও চড়াই একটু এগিয়ে গিয়ে কোথাও বসবো। প্রায় দুঘন্টা একটানা চলার পর একটা সমতল জায়গা পেয়ে সবাই বসলাম। ছোট সমতল ঘাসের জমি, সেজদা তো উপুর হয়ে শুয়ে মাথা নীচু করে পাহাড়কে হয়তো বলছে,”এই শেষ, আর আসবো না।”

জীবনদা জলের বোতল বের করলো সাথে সাথেই অরবিন্দদা,” গ্লুকোন-ডি।” তপা বিস্কুটে চীজ লাগিয়ে দিচ্ছে। চঞ্চল,”তপাদা আর এক সেট।” আশীষ কোমরে হাত দিয়ে চৌখাম্বা দেখছে। টুটুদা, “ওদিকে তাকিয়ে থাকলে হবে, খেতে হবে না।” ১৫ মিনিট বসা হয়ে গেছে চলো চলো। এবারের চড়াইটাকে চড়াই না বলে খাড়াই বলাই ভালো। সবাই এগিয়ে গেল, পোর্টাররা আরো আগে, দেখি একটা টিলার মতো তার উপর দিয়ে যেতে হবে। নীচ থেকে ছবি তুলে রওনা হলাম। উঠতে যখন হবেই আর বসা ঠিক না। চলুন কোন চাপ নেই চারহাত পায়ে উঠবো। উঠতে উঠতে এক ঘন্টা পনের মিনিটের মাথায় পৌছলাম বিনায়ক টপ। এই “টপ” শব্দটা যখনই শুনবেন, মনে রাখবেন টানা চড়াই। এবার তপা আর অরবিন্দদা পূজো করলো বিনায়ক বাবার। আমরা প্রসাদ খেলাম কাজু বরফি। আমারটা খাওয়ার পর আশিষের থেকে একটু ভেঙে নিতেই, আশীষ বললো,”রুদ্র এটা কি হল… । এই তপা আমায় একটা দে।”

আসলে আমাদের এই ধরনের হাসি মজা চলতেই থাকে। আপনি নিশ্চয় চড়াইয়ের কষ্টটা ভুলে গেছেন। এখানে একটা গ্রুপ ছবি হল আবার হাঁটা শুরু। সাবধানে আসবেন পাহাড়ের খারাই ঢালে আড়াআড়ি চলতে হবে, বরফ আর বোল্ডার মিলেমিশে একাকার। ভয় করলে ডান হাত দিয়ে পাথর আঁকড়ে ধরুন তারপর বাঁ পা ফেলুন, এবার বাঁ হাত দিয়ে পাথর আকরে ধরুন, ডান পা এগিয়ে আনুন। আরে না না, আপনাকে হাঁটা শেখাচ্ছি না। আমি ভয় পেলে যা করি তাই বলছি। আরো ঘন্টাখানেক চলার পর পৌছলাম দোয়ারা পাস (১৩৫০০ ফুট)। এখান থেকে পশ্চিম দিকে নেবে যাবো। বড় বড় বোল্ডারের উপর দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরই ঘাসের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নাবতে শুরু করি আবার বোল্ডার শুরু, এই জায়গাটার নাম নাকি শিলাসমুদ্র। বোল্ডার টপকে নেমে এলাম একটা বুগিয়ালে। সবাই বসলাম ছরিয়ে ছিটিয়ে। খুব খিদে পেয়েছে তাই ম্যগি আর চা। ১:২০ তে ঢুকে ছিলাম এখানে খেয়ে উঠতে উঠতে ২:৩০ বেজে গেল। বুগিয়ালের উপর দিয়ে হাঁটা খুবই মজার, কিন্তু সেই মজা বেশিক্ষন রইলো না। শুরু হলো বৃষ্টি, গহেরী বুগিয়াল (13220 ft ) ছারিয়ে ঘাসের ঢাল ধরে উপরে উঠে এসে ছোট একটা জায়গায় টেন্ট লাগালাম বৃষ্টির মধ্যেই। সবাই খুব ক্লান্ত তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুম।

7th June 2009

আজ সকালে উঠলাম ভোর ৫ টায়। আকাশ নীল একটুও মেঘ নেই। গতকাল আমাদের যাবার কথা ছিল মান্দানি, কিন্তু এত লম্বা রাস্তা তার উপর বৃষ্টি তাই থেকে গেছিলাম এই গহেরী বুগিয়ালের শেষ প্রান্তে। আজ আমাদের গাইড সুন্দর সিং ফিরে যাবে, ওর আর একটা টিম আসবে তাই, এখান থেকে আমাদের পথ দেখাবে দেবেন্দর। সকালে সুন্দর সিং কে ভাত খাওয়ানো হল, সাথে রুটি তরকারী pack করে দিয়ে দেওয়া হল পথে খাবে। সুন্দর সিং ওর পথ ধরলো আর আমরা আমাদের পথে এগোলাম। আজ খুব কম হাঁটা, পথটাও দারুন। চোখের সামনে বিশালী শৃঙ্গ তার ডান দিকে মান্দানি শৃঙ্গ। ছোট ছোট পাহাড়ের ঢিপি। ঘাসের রং কোথাও হলুদ কোথাও হলকা সবুজ কোথাও ডিপ সবুজ। ছোট ছোট হাম্পের উপর দিয়ে চলতে একটু কষ্ট হয় বটে কিন্তু আনন্দ বেশ, ক্রমশ বিশালী শৃঙ্গ হাতের নাগালে চলে আসছে। হালকা উৎরাই পথে নাবছি হঠাৎ চোখে পরলো রডড্রেনডন গাছের ঝোপ। গোটা দশ পনের গাছ এক জায়গায় দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে আর কোথাও কোন গাছ নেই। চলে এলাম মন্দানী ময়দানের মুখে, ছোট একটা জলের ধারা বয়ে চলেছে। যেহেতু জুন মাস তাই জল খুবই কম আর খুবই ঠান্ডা, একে একে সবাই পেড়িয়ে গেল।

চোখের সামনে বিশালী শৃঙ্গ তার ডান দিকে মান্দানি শৃঙ্গ।

আমি দেবেন্দরের কাছে বায়না করলাম , আমি জলে পা দেবো না খুব ঠান্ডা। আমি অবশ্য ইয়ার্কি করেই বলেছিলাম কথাটা আর ও আমার কিছু বোঝার আগেই সাথে সাথে আমায় কাঁধে তুলে হাঁটা শুরু, জলের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে বলে,”এবার নাবিয়ে দেব?” আমি বল্লাম,” না না জুতো ভিজে যাবে। “যাই হোক পাড়ে পৌঁছে একটু এগিয়ে টেন্ট লাগালাম। ১২ টা বাজে আজকের মত হাঁটা শেষ পৌঁছে গেলাম মান্দানি, এদিকে দেবেন্দর দেখি স্নান করছে। খুব ঠান্ডা জল তবুও স্নান করলো পূজো দেবে বলে। মান্দানীতে পাথর সাজিয়ে ছোট একটা মন্দির আছে। আমাদের কাছে লজেন্স ছিল আর ফুল বলতে ছিল রডোবেনড্রোন গাছের ফুল তাই দিয়েই দেবেন্দর পুজো করলো…উপকরণ অতি সামান্য কিন্তু মনের ভক্তি আসল সেটাই অনুভব করলাম। সবুজ ময়দান এদিক ওদিক ছোট বোল্ডার অল্প কয়েকটা ছড়ানো পাশে ছোট্ট একটা নালার জলের শব্দ, উত্তর দিকে বিশালী ও উত্তর পূর্ব দিকে মান্দানী শৃঙ্গ একেবারে হাতের নাগালে।

জানেন দারুন লাগছিল বিকেলটা, আমরা জুন মাসে এসেছি তাই ফুল দেখতে পাই নি কিন্তু আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে এলে প্রচুর ফুলে ফুলে ভরে থাকে….তখন এই জায়গা vally of flower থেকে কোন অংশে কম নয়। বিশাল বড় ভ্যালি যেন সবুজ কার্পেট পাতা…মনে হয় বাচ্চাদের মত হুটপাটি করে খেলে বেড়াই… কাছেই একটা বড় গ্লেসিয়ার তাই খুব ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল, এই রকম জায়গায় সময় কখন বয়ে যায় বোঝাই যায় না। সবাই টেন্টে বসে সামনের দরজা খুলে আড্ডা শুরু হলো। সূর্য পাহাড়ের আড়ালে যেতেই জোরে ঠান্ডা হাওয়া শুরু হলো, তপা চা নিয়ে এলো সঙ্গে পকোরা, আজ সন্ধ্যার আড্ডা টেন্টের ভিতরেই চলবে। রাতের আকাশে তারার আলো এত্তো সুন্দর না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না…প্রচন্ড ঠান্ডা তাই তখন আর ছবি তুলতে ইচ্ছে করছিল না, আর তখন ট্রাই পডও ছিলনা ড্রামে রেখে ছবি তুলতাম তো। এখন ঘুমতে যাই কাল ভোরে উঠতে হবে।

মান্দানী শৃঙ্গের মাথায় প্রথম আলো

8th June 2009

আজ সকালে তপার চিৎকারে ঘুম ভাঙলো। তপা রুদ্রদাকে বলছে,”এই ভাবে হয় নাকি?” রুদ্রদা,”কি হল বল।”তপা, “৫ টা বাজে এতক্ষন কেউ ঘুমায় নাকি? ওঠো ওঠো বাইরে এসো।” সকাল ৫:৩০ তপা হাতে চা ধরিয়ে দিল, বাইরে এলাম… ঠান্ডা হাওয়া বইছে…উত্তরপূর্ব দিকে মান্দানী শৃঙ্গে তখনও আলো পরে নি। পূর্ব দিকে পাহাড় থাকায় সূর্যের আলো Camp site এ পরতে দেরি আছে। মান্দানী শৃঙ্গের মাথায় প্রথম আলো পরলো….অসাধারণ দৃশ্য… দুচোখ সার্থক হলো… সকালটা শুরু হলো। এবার তৈরী হয়ে বেরতে হবে। আজ হাঁটা শুরু হল ৭ টা ১০ নাগাদ। কিছুটা সমতল ঘাসের উপর হেঁটে চড়াই শুরু। অল্প চড়াই তারপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চাড়াই ১০:৩০ নাগাদ জঙ্গল শেষ হল কিন্তু চড়াই শেষ হল না। ছোট ছোট ঝোপ ঘাসের উপর নানা রঙের ফুল, একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চড়াই। আচ্ছা এত চড়াই কেন? আসলে উঠছি তো উপরে…চড়াই তো হবেই। হঠাৎ কোথা থেকে একদলা মেঘ এসে সূর্য ঢেকে দিল। দেড়টা নাগাদ বৃষ্টি এলো, প্রথমে ঘাসের ঢালে ছাতা মাথায় বসে ছিলাম। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই আরো কিছুটা উপরে উঠে একটা বড় পাথরের নীচে আশ্রয় নিলাম। খুব জোর বৃষ্টি হল কিছুক্ষন তারপর থেমেও গেল, আবার হাঁটা শুরু করি। সামনেই উপরে একটা বড় বোল্ডার দেখিয়ে দেবেন্দর বললো ঐ বোল্ডারটার পাশ দিয়ে যেতে হবে। এখন কারো মুখে কোন কথা নেই শুধু নিশ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ। মেঘলা থাকায় উপর থেকে নিচের দিকে কিছুই দেখতে পারিনি। এবার বড় বড় বোল্ডারের মধ্যে দিয়ে সাবধানে নেবে আসি। বিকেল ৫ টা নাগাদ পৌঁছাই ভান্ডারা Camp Site এ (12600ফুট), প্রায় দশ ঘন্টা আজ হেটেছি মাঝে বৃষ্টি, তাই সবাই ক্লান্ত তার উপর সন্ধ্যায় আবার বৃষ্টি তাই আজ আর আড্ডা জমলো না। তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুম।

মেঘ এসে সূর্য ঢেকে দিল।

9th June 2009

গত কাল Camp Site এর ছবি তুলিনি তাই সকালের প্রথম কাজ Camp Site এর ছবি তোলা। চকচকে রোদে টেন্ট শুকিয়ে নেওয়া হল। আকাশ পরিস্কার বা ঘুম ভালো হয়েছে ঠিক কি কারন জানি না কিন্তু সবার মুখে খুব হাসি। আমি জীবনদাকে জিজ্ঞেস করলাম,”কি ব্যপার বলো তো…সবার মনে এতো আনন্দ কিসের…যেন ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ…!!” জীবনদা ,”বুঝলি না… সব সালা ফাইসা গ্যসে এখনে আইসা, যেই দিক যাইবে সেই দিকেই চড়াই, কেউ পালাইতে পারুম না…”বলতে বলতে কি হাসি। এখন ৯ টা বাজে, সকাল সকাল গোবিন্দ ভোগ চালের ফ্যনা ভাত ডিম সিদ্ধ মাখন খেয়ে নিয়েছি। আবার শুরু চড়াই, তবে আজ হাঁটা কম আর আজও একটা পাস ক্রস করতে হবে। পাস মানে তো চড়াই থাকবেই। বড় বড় বোল্ডার টপকে পৌঁছলাম সবুজ ঘাসের ঢালে, কিছুটা সোজা গিয়ে ডানদিকে পাহাড়ের খাঁজে ঢুকে টানা ঘাস আর বোল্ডারের খাড়াই পথ পেরিয়ে সিমতোলি ধার বা সিমতোলি পাস, এখানে অনেকক্ষন বসলাম। চোখের সামনে বিশালী শৃঙ্গ তার থেকে নেমে এসেছে কালীগঙ্গা নদী, উপর থেকে দেখতে দারুন লাগছে। বেশ কিছুটা বোল্ডারের উপর হাঁটার পর, ঘাসের ঢাল বেয়ে নিচে নামা শুরু করি, বেশী সময় লাগলো না দুপুর ২:২৫ পৌঁছে গেলাম বুগিয়ালে। ঘন সবুজ কার্পেটে মোরা খাম বুগিয়াল দেখে যেন চোখের আরাম, একটু এগিয়ে টেন্ট লাগানো হল। এই জায়গাটার নাম বলজোতিয়া(১২২০০ ফুট)। সামনেই বিশালী হিমবাহ, তার থেকেই নেমে এসেছে কালীগঙ্গা নদী। বিশাল বড় একটা সবুজ মাঠ একদম সমতল।

সিমতোলি ধার বা সিমতোলি পাস

ট্রেকে এতো সুন্দর Camp site খুব কম পেয়েছি। ৪টে নাগাদ বেড়িয়ে পরলাম কালীগঙ্গার কাছে। বেশ কিছুক্ষন ওখানেই বসে রইলাম। হিমবাহের ঠান্ডা হাওয়া সরাসরি আমাদের গায়ে লাগছে, আস্তে আস্তে ঠান্ডা বারতে লাগলো, ৬ টা নাগাদ আগুন জ্বালিয়ে জমে গেল আড্ডা। আজ Camp Fire কিন্তু নিরামিষ খাবারই খেতে হল। ডিম শেষ হয়ে গেছে আর কোন ভেড়াওয়ালাও নেই। এই ট্রেকে টেন্টে থাকার আজই শেষ রাত। যদিও হাঁটা বাকি দু দিন। শুতে রাত ১০টা বেজে গেল।

10th June 2009

দেবেন্দরের ডাকে ঘুম ভাঙলো। সকালে টেন্টের ভিতরে বসে চা পাওয়ার মজাই আলাদা। আজ সবাই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে গেল। টেন্ট পুরো শুকিয়ে pack করা হল। সব বাসন, স্টোভ গুছিয়ে নেওয়া হল কারন এগুলোর আর দরকার হবে না। আজকের ট্রেকটা খুবই কষ্টকর এটা আমরা সবাই জানি। গতকাল বিকেলেই দেখেছি কোন রুট ধরে উঠবো। সকাল ৬:২০ হাঁটা শুরু করলাম, গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরী সেতু কালীগঙ্গার উপরে বেশ চওড়া তাই সহজেই পার হয়ে এলাম। নীল আকাশ ঘাস পাথরের খাড়াই পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। ৫ মিঃ হেঁটেই হাঁপিয়ে যাচ্ছি একটু দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা, মঝে মধ্যেই চার হাত পায়ে উঠতে হচ্ছে। ১০পা উঠছি রেস্ট আবার ৫ পা উঠছি রেস্ট এই ভাবেই আস্তে আস্তে উপরে ওঠা প্রায় প্রাণান্তকর অবস্থা। সকাল সাড়ে নটা একটা ঢালে বসলাম এবার টিফিন করে নি। রুটি আর তরকারী, রুটি তো চামড়ার মতো শক্ত হয়ে গেছে তাইই দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে জাবর কাটার মত খেলাম, কি আর হবে ট্রেকে এইগুলো একটু মেনে নিতে হয়…আমরা তো প্রকৃতিপ্রেমী, কষ্ট না করলে প্রকৃতি ধরা দেবে কেন আমাদের কাছে…?? আবার হামাগুড়ি দিয়ে ওঠা শুরু করি। মনে মনে বলছি কখন শেষ হবে এই চড়াই।

কালীগঙ্গা নদী

চঞ্চলের এটাই প্রথম ট্রেক, আমি টুটুদা রুদ্র ৩ জন আলোচনা করলাম,”এটা কারো প্রথম ট্রেক হওয়া ঠিক না।” টুটুদা বল্লো ,”ও আর আইবেনা।” একটু দাড়িয়ে আবার উঠি ……….অবশেষে ১১:৫০ হাতনি পাসের উপরে আমরা। সরু একটা রিজের ওপর বসার একটুও জায়গা নেই। কোনো রকমে ঢালের গায়ে যে যেখানে পারছে বসে পরেছে , মুখে কারো কোনো কথা নেই, চোখে পরলো নদীর পারে সরু সুতোর মতো রাস্তা, ঐ পথ ধরেই লোকে কেদার যায়। পাসের মাথায় বেশীক্ষন বসি নি কারন আকাশ কেমন মেঘলা হয়ে আসছে। তাই পূজো দিয়েই নামা শুরু করি। হাতনী পাস কে টাটা করে নামা শুরু, সবাইকে বলা হল খুব সাবধানে কারন পাথরের উপর বরফ পরে আছে। আগের লোকের পায়ের ছাপ দেখে পা ফেলবে সবাই। বরফের উপর থেকে নামছি আকাশ কালো একটু পরেই বরফ পরা শুরু। কখনো পাথর কখনো বরফ এই ভাবে এসে একটা সমতল জায়গায় বসলাম। এখান থেকে পুরো কেদারনাথ শহর দেখা যায়।

অসাধারন সেই দৃশ্য, মনে হল যেন পাখির চোখ দিয়ে কেদারনাথ দর্শন হলো। এখানে এসে সবাই সবাই কে জরিয়ে ধরলাম। সবার মনের মধ্যে আনন্দ, সেই রাশি থেকে হাঁটা শুরু করেছিলাম আর আজ কেদারনাথ পৌঁছবো। এখন ১টা ৪০ তপা সবাইকে কেক দিল অরবিন্দদা কিসমিস দিল খেয়ে নিচে নাবা শুরু। নাবার নির্দিষ্ট কোন পথ নেই বড় বড় বোল্ডার আপনার যেখান থেকে মনে হয় নাবতে থাকুন। আবার বরফ পরা শুরু। জীবনদাকে বল্লাম, ” আমরা আসছি তাই পুষ্প বৃষ্টি বরফ আকারে পরছে।” আমরা এসে দাড়ালাম ভৈরব মন্দিরের কাছে। যারা কেদারনাথ গেছেন অনেকেই হয়তো এই ভৈরব মন্দির দর্শন করেন নি। কেদারনাথ মন্দির থেকে ডান দিকে দেড় কি.মি. উপরে উঠলেই এই মন্দির একটু খাড়াই পথ উঠতে এক ঘন্টা লাগে তবে এখান থেকে এই ছোট্ট জনবসতি আর কেদারনাথকে অন্য রূপে দেখতে পাবেন।

একে একে সবাই এলো আবার চলা শুরু করলাম বিকেল ৪টে ১০ পৌঁছলাম কেদারনাথ। BSNL এর টাওয়ারের পাশে একটা বড় হল ঘরে আমরা জায়গা পেলাম। মাল নামিয়ে সোজা রওনা হলাম মন্দিরে। আগে একটা ছবি তুলে মন্দিরের চারপাশ ঘুরলাম। হিমালয়ের বুকে আমার দেখা সব থেকে সুন্দর মন্দির। এত সুন্দর জায়গায় এই মন্দিরের অবস্থান, মন্দিরের সামনে দাড়ালে আপনি মন্দিরের Background এ অনেক বরফের শৃঙ্গ দেখতে পারবেন কেদারনাথ শৃঙ্গ কেদার ডোম শৃঙ্গ ভার্তেকুন্ডা শৃঙ্গ আরো অনেক। সিড়ির ধাপ চরে মন্দিরের চাতালে উঠে আসুন। সিড়ির ধাপ গুলো বেশ উচু, ৭ ধাপে ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি উঠতে হল। ৩ ইঞ্চি পাইপ দিয়ে ৬ ফুট/ ৮ ফুটের গেট, ৮ মিলিমিটার রড দিয়ে তার উপর আর্চের মতো করা, অনেক ঘন্টা ঝুলছে। ২০০৮ সালে একটা TVতে একটা বিজ্ঞাপন হত কেদারনাথ মন্দিরের গেটের সামনে দাড়িয়ে ফোন করে মন্দিরের ঘন্টার শব্দ শোনাতো বাড়ির লোককে। আমি ও তাই করলাম। ঐ গেট থেকে ২০ ফুট এগিয়ে আসুন দেখবেন ৮ফুট/৪ফুট একটা পাথর ৩ফুট উচু তার উপর বসে আছে নন্দী (ষাঢ়) মন্দিরের দিকে মুখ করে। মন্দিরের দৈর্ঘ ৩৬ ফুট প্রস্থ ৭২ ফুট উচ্চতা প্রায় ৫২ থেকে ৫৪ ফুট। মন্দিরের গেটের দুপাশে ৫ ফুটের দুটো কুলুঙ্গির মধ্যে কালো পাথরের তৈরী দুটো মূর্তি আছে এরাই মন্দিরের রক্ষী। মন্দিরের গেটের উপরের অংশ ত্রিভুজ আকৃতির কারন টিনের দোচালা ছাউনি দেওয়া। গেটের উপরের দিকে সোডিয়াম ভ্যপার লাইট লাগানো চাতালে যাতে আলো পরে। অবাক হয়ে চারপাশের কারুকার্য দেখছিলাম।

অবশেষে ১১:৫০ হাতনি পাসের উপরে আমরা।

মন্দিরের কারুকার্য সত্যি দেখবার মত, আরও অবাক হতে হয় কারণ বছরের ছয় মাস বরফে ঢাকা থাকে এই এলাকা তার উপর যেখানে হাঁটা ছাড়া কোনো পথ নেই কত শত শত বছর আগে কত দুর্গম পথ পেরিয়ে এই মন্দির এবং তার ভিতরের কারুকার্য যারা করেছেন বাবা কেদারনাথের সাথে সাথে সেই সব শিল্পীদেরও প্রণাম জানাই। মন্দিরের সামনে অনেক খাবারের দোকান তারা আবার প্লাস্টিক টানিয়েছে। অনেকটা হাতিবাগানের ফুটপাথের মতো। অনেক ধর্মশালা আর প্রচুর ভক্তের ভীড়। আমাদের পোর্টার গাইড কোথায় চলে গেল খুঁজে পেলাম না। ৭ নাগাদ ওরা এলো একদম ফ্রেশ হয়ে। এক একজনকে তো চেনাই যায় না। ঝাক্কাস ড্রেস চুল দাড়ি কেটে ফুল বাবু।

11 th June 2009

সকালে গিয়ে আবার মন্দিরটা দেখে আসলাম। ঠিক হল মন্দিরের সামনে খাবার হোটেল থেকে পরোটা খেয়ে হাঁটা শুরু করবো। এখানেই দেবেন্দরকে সব টাকা হিসেব করে বুঝিয়ে দিলো রুদ্রদা । সকাল ৭ মন্দিরের সামনে সাংঘাতিক ভীড়। জীবনদা বল্লো,” চল চল সামনে দোকান আছে ঐখানে খাবি।” আমরাও এগিয়ে গেলাম কিন্তু কোনো খাবারের দোকান নেই, একজন চা করছিল তার কাছেই চা বিস্কুট খেয়ে নিচে নাবতে শুরু করলাম আর হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার “জয় কেদার….জয় কেদার”। রাস্তায় প্রচুর মানুষ সবাই চলেছে কেদারনাথ দর্শন করতে। নানা রকমের অভিজ্ঞতা হল এই মানুষগুলোর সাথে কথা বলে। বেশীর ভাগ মানুষই অবাঙালী। সোজা রামওয়ারায় এসে কিছু খেয়ে এক টানে নেমে এলাম গৌরীকুন্ড। খুব ঘিঞ্জি জায়গা কোনরকমে এক গ্লাস চা খেয়ে একটা গাড়ী ধরে সোজা গুপ্তকাশী। এখানটা কিছুটা হলেও ফাঁকা তীর্থযাত্রীদের ভীড় নেই একটা হোটেলে উঠলাম। আমাদের অন্য পথে কেদার ট্রেক এখানেই শেষ হল।

সবাই সুস্থ। এই ট্রেকের সফলতার মূল কান্ডারী সুন্দর সিং ও দেবেন্দর। আমাদের টিমের সবার সহযোগিতায় আজ আমরা এতো সুন্দর একটা ট্রেক সফল ভাবে করতে পারলাম। এখান থেকে আপনারা সোজা চলে যান হরিদ্বার, ওখানে আশপাশটা ঘুরে সন্ধ্যায় গঙ্গা আরতি দেখে তারপর ট্রেন ধরে বাড়ী চলে যান। আমাদের RETURN TICKET কিন্তু ১৩ ই জুনের। টাটা আবার দেখা হবে।

Leave a Comment
Share