কেদারকন্ঠ স্নো ট্রেক

প্রতিবারই পাহাড় চড়ার সময় ভাবি, নাহ এই শেষ, আর ট্রেকিং এ আসবো না। আর পাহাড় থেকে নেমে আবার প্ল্যান শুরু হয় আবার কোথায় যাওয়া যায়। অনেক প্ল্যান ক্যান্সেল হওয়ার পর এই কেদারকন্ঠ/কেদারকান্থা স্নো ট্রেকটাই (Kedarkantha Trek) সহায় সম্বল ছিল। দুজন আরো যাবে বললো আমিও রাজি,ভাবটা আমার এমন ছিল,আমি তো আছি কোন অসুবিধা হবেনা, বাস্তবে যদিও তারা না থাকলে আমিই মুশকিলে পড়তাম। ফেব্রুয়ারীর এই সময়টায় দেরাদুনের ট্রেনলাইন বন্ধ থাকে। বসকে খুশি করতে যতটা কম ছুটি নেওয়া যায় তার জন্য ট্রেনের বদলে প্লেনের টিকেট কাটলাম। যদিও তাতে আমার সস্তা পড়ল।

৬ ই ফেব্রুয়ারি, দিল্লি থেকে বাসে করে নামলাম দেরাদুন এস.বি.টি বাসস্ট্যান্ড ভোর পাঁচটায়। দু’ঘণ্টা পর ট্রেকিংগ্রুপের টেম্পো ট্রাভেলার এলো, কলকাতার থেকে আসা আরো দশজন এলো, তেরোজন মিলে হইহই করে ছূটে চললাম Sankri। দুপর তিনটেতে হোটেল এ ঢুকে স্যাকটা ঘরে জমা করে বেড়িয়ে পড়লাম আশপাশ দেখতে। ছোট একফালি ব্যস্ত জনপ, ট্রেকাররা আসছে যাচ্ছ, ছোট একটা চায়ের দোকানে গরম ম্যাগি আর দুধ চা খেয়ে ট্রেক লিডারের থেকে ব্রিফিং নিয়ে, নিজের ডে-প্যাকটা গুছিয়ে, কোন ব্যাগটা অফলোড হবে সেসবের ব্যবস্থা করে তাড়াতাড়ি খেয়ে আজ ঘুম।

৭ই ফেব্রুয়ারি, আজ আমাদের হাঁটা শুরু, যাবো ‘যুরা কা তালাব’, তালাবটি যদিও বরফে জমাট বেধে মাঠ হয়ে গেছে কিন্তু অপুর্ব শোভা তার, যদিও খুব আপহিল নয় তাই ওপরে উঠতে খুব অসুবিধা হয়নি। মাঝে একটি শপে জুতোয় স্পাইকার্স দুটো পরে নিতে হল, সামনে শুরু হবে বরফের রাস্তা। কয়েক ঘন্টায় পৌছে গেলাম আমাদের আজকের ক্যাম্প। তালাব থেকে একটু উঁচুতে আমাদের ক্যাম্প পড়েছিল। পৌঁছে চা খেয়ে পিঠে রোদ মেখে কিছুক্ষণ বসে লাঞ্চ। তারপর শুরু হলো এদিক ওদিক একটু ঘুরে দেখা, ছবি তোলা। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো, যে যেখানে ছিল জড়ো হলো ক্যাম্পসাইটে, আড্ডা শুরু হলো, টেন্টে ঢোকা বারণ, চা পকোড়া এলো, আড্ডা কন্টিনিউ, এলো রাতের খাবার, অবশেষে টেন্টে ঢোকা গেল। স্লিপিংব্যাগটা খুলে, মোবাইল পাওয়ার ব্যাঙ্ক, ক্যামেরার ব্যাটারি সব নিয়ে ঢুকে পড়লাম তাতে। পিঠের নিচে মুচমুচে বরফ অনুভব করা যাচ্ছিল। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম আসতে সময় লাগলো না।

৮ই ফেব্রুয়ারি, আজ আমাদের যাওয়া কেদারকান্থা কিংবা কেদারকন্ঠ বেস ক্যাম্প। অনেকটা রাস্তা নয় বলে যাত্রা শুরু হলো ঠিক নটায়, পথ আগের দিনের থেকে কঠিন, যতটা ঠাণ্ডা ভেবেছিলাম অতটা লাগছিলনা হাঁটার কষ্ট, নয়ন ভুলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য শরীরের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল। চলার পথে সাথে ছিল স্বর্গারোহিনী, বান্দরপুছ, কালানাগ আর রাংলানা, সদর্পে দাড়িয়ে আছে। ক্যাম্প কিছুটা দূরে তখনও, দেখা মিললো শ্বেতশুভ্র কেদারকন্ঠ পিক, সে এক অপূর্ব দৃশ্য, যদিও জানা ছিলনা তখনো যে ওখানেই কাল ভোরে উঠতে হবে সূর্যোদয় দেখতে। ক্যম্পে পৌঁছে স্যাকটা নিজের টেন্টে রেখে এসে বসলাম বরফের ওপর পাতা ম্যাটের ওপর গিয়্যে বসলাম, সামনে বিশাল পর্বতমালা ক্যানভাসের মতন চোখের সামনে। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফে মোড়া ভ্যালি আর পাইন গাছের সাড়ি। একবারের জন্যও মন হয়নি ক্যাম্পে ঢুকে বসার,কোন ক্লান্তি ছুঁতে পারেনি, এইটুকু সময় হাতে তারপর তো আর পাবোনা এসব তাই যতটা পারা যায় নিয়েনি। লাঞ্চ ওই ম্যাটের ওপরে রোদ্দুর নিয়ে করলাম। তারপর একটু ওপরে উঠলাম দেখে আসতে কাল কোথা দিয়ে যাওয়া হবে। চারিদিক লাল করে সূর্যাস্ত হচ্ছে, মনটা একটু ভার, শেষ হয়ে যাচ্ছে স্বপনের মুহূর্তগুলো। আজ ডিনার করে সময়ের দরকষাকষি করে ঠিক হলো আমরা আজ ভোর রাত্তিরে বের হবো সূর্যোদয় দেখতে।

৯ই ফেব্রুয়ারি, ২.৩০ এ টেন্টে টোকা রেডি হয়ে বেরোবার জন্য, গরম দালিয়ার গরম ক্ষীর খেয়ে মাথায় হেডল্যাম্পস বসিয়ে আমাদের ওঠা শুরু হলো। কোনদিনও ঘুটঘুটে অন্ধকারে এতো ঠান্ডায় হাঁটিনি আগে, স্বীকার করছি খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে কিন্তু ডানদিকে ছিল সেই নাছোড়বান্দা চাঁদ, মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল হেডল্যাম্প তা নিভিয়ে চাঁদের আলোর ওপর ভর দিয়ে হাঁটি, মাঝেমঝে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে অন্য গ্রুপের ট্রেকাররা অবলীলায়, একটা টি-স্টল পাওয়া গেল যেটা দেখেই ক্লান্তি চেপে বসলো, বসতেই হবে একবার, একটু গরম চা। এতে যারা আমার পেছনে ছিল তারা আগে হয়ে গেল, কুছ পরোওয়া নেহি হো যায়েগা। ডানদিকে পূর্ণচন্দ্র বাদিকে পর্বতমালা সূর্যের কিঞ্চিৎ ছটায় স্পষ্ট হচ্ছে আরো, লোকাল গাইড তাড়া দিচ্ছেন ম্যাডামজি ওর জলদি চালিয়ে সূর্য উঠ যায়েগা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গতি বাড়িয়েও মনে হচ্ছে সব কম পরছে। এতটাই খাঁড়াই যে মনে হচ্ছিল কুইট করি, এত কঠিন হবে ওপরে ওঠা ভাবিনি আবার চোখের সামনে সব ফর্সা হয়ে যাচ্ছে যখনতখন তিণি উদয় হবেন আরো জলদি না উঠলে মোহিণী রূপ মিস হয়ে যাবে। অনেকেই আর ওপরে উঠছেনা আর, নিচ থেকেই দেখবে, ছোট পাথর দেখে সেখানেই বসে যাচ্ছে সবাই, কিন্তু সবাই আমাদের খুব উৎসাহিতও করছে ওপরে ওঠার জন্য।

জেদ চেপে গেছিল, যেন সূর্যের সাথে চ্যালেঞ্জ কে আগে উঠবে। অক্সিজেন খুব কম, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। যত এগোচ্ছি পিক আরো দূরে সরে যাচ্ছে। ছবি তোলার মতন ফ্রেম কিন্ত গ্লাভসটা খোলার যো নেই। অবশেষে সাম্মিট, আমিও উঠলাম তিনিও তড়িঘড়ি করে উঠছেন সাথে পাল্লা দিয়ে বরফের হাওয়া। আলোয় সমস্ত দিক প্লাবিত, দুধ সাদা ভ্যালি আইসক্রিম বারের মতন লাগছে, আগে নিজে দেখেনি আত্মাভরে তারপর ছবি তোলা যাবে। পাহাড়কে পিছনে রেখে সবাই পোজ দিয়ে ছবি তোলা শুরু করলো আমার পাহাড় থেকে মুখ ঘোরাতে ইচ্ছা করছেনা। ওপরে ত্রিশূল দিয়ে একটা ঘেরা জায়গা আছে। অনেক্ক্ষণ ওখানে কাটিয়েও আরো অনেক্ক্ষণ থাকার অপূর্ণ ইচ্ছা নিয়ে এবার নিচে নেমে আসতে হবে। নামাটা একটু আলাদা, বলা যায় different and more exciting। গাইড বললো স্লাইড করে নিচে নামবো আজ আমরা। গাইড ডেমো দেওয়ার মতন আগে নামলেন, দারুণ লাগলো দেখে, আমিও ঠাকুরের নাম নিয়ে বসে পরলাম বরফের ওপর, পেছনে বডিটা দিয়ে ভেসে গেলাম। নেশা লেগে গেল, পুরো রাস্তায় খালি স্লাইড করার সুযোগ খুঁজেছি, পেয়েছিও।

বেস ক্যাম্প অবধি নেমে আসা সহজ মোটেই বলছিনা, ডাউনহিল তাও আবার বরফে মোড়া, তাও আমরা মনোরম ভিউ উপভোগ করতে করতে নেমেছি, গাছে উঠে বরফের ওপর ঝাঁপ দেওয়া, ছবি তোলা, টি-স্টলে ম্যাগি চা খেয়ে অহংকারীর মতন বেস ক্যাম্পে নামলাম, লাঞ্চের সময়, আমরা আজই জুরা কা তালাবে নেমে যাবো। আমরা ক্যাম্প-সাম্মিট-ক্যাম্পে আট ঘন্টা নিয়েছিলাম।

এখনেই লেখা শেষ করলাম, কারণ একই পথে আমরা ডিউনহিল দিয়ে সাংকরি নেমে এলাম। ডিউনহিল বলে একে অবজ্ঞা করবেন না। বরফে মোড়ানো ট্রেইল আর কোন ধরনের বরফের ওপর পা দিলে হড়কে যাবো না সেটা বুঝে বুঝে নামতে হয়, এদিক ওদিক হলেই খুব বিপদ! সবাইকে অনুরোধ করবো একবার যাবেন, আর বরফেই যাবেন, নইলে এই রূপ পাবেন না।

Leave a Comment
Share