ভূস্বর্গ কাশ্মীর ভ্রমণের আদ্যোপান্ত

কাশ্মীর (Kashmir) সম্বন্ধে মুসলিম সম্রাট জাহাঙ্গির কথাটি না বললেই নয় “গার ফিরদাউস বার-রুয়ে যামিন আস্ত, হামি আস্ত, হামিন আস্ত, হামিন আস্ত” যার মানে “পৃথিবীর কোথাও স্বর্গ থাকলে তা এখানেই আছে, এখানেই আছে এবং এখানেই আছে”। পুরো কাশ্মীর তিন দেশে বিভক্ত। জাম্মু-কাশ্মীর (নর্থ ইন্ডিয়া), আজাদ কাশ্মীর (পাকিস্তান) ও আক্সাই চিন (চায়না-বিতর্কিত)। আমরা তাই প্রতিবেশি দেশের জাম্মু-কাশ্মীরকেই বেছে নিলাম এবং সাথে ১৫৭৭ সালে নির্মিত আম্রিতসার গোল্ডেন টেম্পল যার গম্বুজ ৭৫০ কেজির খাঁটি স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত।

পাহাড়ি নদীর ঢল, ঘোরার হ্রেষা ও ঠকাঠক শব্দ, সাদা তুলোর মত বরফ আর তাতে আচ্ছাদিত পাইন গাছ এবং সবুজ ঘাসের সমারহ এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্যে ভূস্বর্গের উদ্দেশ্যে দুই ভাই ২১ এপ্রিল ১৬ তে গরম গরম ভিসা পেয়ে ওই রাতেই বেনাপোলের লক্ষ্যে বাসে উঠলাম মালিবাগ থেকে (সোহাগ স্ক্যানিয়া ১২০০ টাকা ভাড়া)। বাসের দেরিতে পৌছাতে সময় লাগলো সকাল ৮ টা।

১ম দিন

তারপর বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনের টাকা পয়সা দেয়া নেয়ার তামাশা ঝুলে জিরো পয়েন্ট এ অজানা সময়ের লাইনে দাঁড়ালাম যেখানে পূর্ব থেকেই ছিল বাংলাদেশিদের লাইনে আগে যাবার জন্যে দালাল মামাদের পাতা ফাদ। উল্লেখ্য যে আমার মতে বেনাপোলে যারা যাবেন চেষ্টা করবেন এসি বাসের মায়া ত্যাগ করে একটু আগে রওনা হবার জন্যে। যাতে বর্ডার খুললে সবার আগের দিকে বর্ডার ক্রস করতে পারেন। তাতে কলকাতা যেতে সময় যেমন বাচবে পাশাপাশি ইন্ডিয়ার তাতকাল এর টিকেট পাবার সম্ভাবনাও বাড়বে। যাই হোক এরপর ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন এ গেলাম। তারা আমার ছোট ভাইকে চিরুনি তল্লাশি করে ৬০ রুপী পেতে সক্ষম হলেন আর বললেন এগুলা এখানেই রেখে যাও। কথাটা এমন ভাবে বললেন যেন টাকা পয়সা শুধুই অপ্রয়োজনীয় জিনিস যা কেবল ব্যাগ ভারী করে। বললেন এগুল নিয়ে যেতে পারবেনা। আমাকেও ধরল ডিএসেলার ক্যামেরা নেয়া নাকি নিষেধ। আমি বললাম আমি এর আগেও নিয়েছি আর আমার পাসপোর্ট এ ডিএসেলার এর কথা উল্লেখ করা আছে। যাই হোক ২০০ টাকা চেয়েছিল এবং হতাশ হতে হয়েছিল তাকে। (সবার অভিজ্ঞতা সমান নাও হতে পারে)

ইমিগ্রেশন এর লোক আপনাকে হাতেম তাই মনে করে বিভিন্ন ভাবে টাকা চাইলে ঘাবড়াবেন না। ফর্মালিটি পালন করে ইমিগ্রেশন নামক জেল থেকে মুক্ত হতে না হতেই মুদ্রা পরিবর্তন এর লোকজন এমন ভাবে বুঝালেন যে এখান থেকে টাকা না ভাঙ্গালে ইন্ডিয়ান হাজতখানায় আমার জায়গা হতে পারে।

তারপরও আমি এক জায়গায় ভাল রেট পেয়ে কিছু টাকা কে রুপি করে নিয়ে যাই কিন্তু ডলারটা আস্তই রাখলাম। এরপর ট্রেইন এর উদ্দেশ্যে বনগা স্টেশনের জন্যে টেম্পুতে উঠলাম যার ধারন ক্ষমতা ৫ জনের হলেও মিনিবাসের থেকে তাতে কম লোক উঠানো হয়নি। এই কর্ম তারা সাধন করেন ২৫ টাকার বিনিময়ে।

বনগাঁ পৌঁছে ট্রেনে করে শিয়ালদাহ নামলাম। উল্লেখ্য যে এখানে লোকাল ট্রেন এ বেশিক্ষণ বসা যায়না, আমাদের তো একজন বলেই উঠল *দাদা অনেক তো বসেছেন। এবার একটু উঠু…..ন* কিন্তু তার এই কথাতেও আমি অনড় থাকলাম ঘাড় ত্যাড়ার মতন। ট্রেন থেকে নেমে একটু সামনে হেটে গেলাম ফেয়ারলি প্যালেস নামক ভারতীয়দের মতে আনফেয়ারলি প্যালেসে তাতকাল টিকেট এর জন্যে এবং ব্যর্থ হলাম।

একে আনফেয়ারলি প্যালেস বলার কারন এর টিকেট এজেন্টরা আগেই হাতিয়ে নেয় তাদের মাধ্যমে। ব্যর্থদের তালিকায় নাম বারিয়ে গেলাম মারকুইস স্ট্রিটে এবং ট্রাভেল এজেন্টদের কল্যানে পরের দিনে রাত ১১.৫৫ এ হিমগিরি এক্সপ্রেস এর টিকেট নিলাম। একটা এসি রুম নিয়ে বেরিয়ে পরলাম ঘুরতে কলকাতা এবং মোবাইল সিম কিনতে। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল অল ইন্ডিয়া সিম জম্মু কাশ্মীরে কাজ করেনা। আর কাশ্মীরে সিম পাওয়া অনেক কঠিন এবং বলতে গেলে প্রায়ই অসম্ভব। এখানে অসম্ভবকে সম্ভব না করে জাম্মুর ট্যাক্সিওয়ালা কে আগেই বলে নিবেন এক্সট্রা সিম লাগবে। সাধারনত ওদের কাছে এক্সট্রা সিম থাকে। আপনার বন্ধুত্যপূর্ণ ব্যবহার এক্ষেত্রে ভুমিকা রাখবে।

২য় দিন

পরের দিন স্পট এ ঘুরার জন্যে নতুন জামা-প্যান্ট কিনতে শপিং এ বের হয়ে সন্ধায় টিকেট নিয়ে হিমগিরি এক্সপ্রেস এ চেপে বসলাম থ্রি টায়ার এসিতে (ভাড়া ছিল ২৫০০ একজনের)। আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল ট্রেন এ ইচ্ছা মত খাবার জিনিস একটু পরে পরে আসে। তাই একগাদা খাবার নেবার দরকার নেই। শুধু কিছু ফল কিনে নিতে পারেন নাস্তা করার জন্যে।

৩য় দিন

বলাই বাহুল্য যে ট্রেন এর ভিতরে কাটালাম। আর বোরিং সময় কাটাবার জন্যে ল্যাপটপ থাকলে তাতে বেশি করে মুভি নিতে ভুলবেন না যেগুলা সময়ের অভাবে দেখতে পারেন নি। যাবার সময় এমন কিছু বন্ধু বানাবেন যাদের কাছ থেকে আরও তথ্য নিতে পারেন। হিন্দি জানার কিছু ফজিলত পাবেন যেটা আমিও পেয়েছি।

৪র্থ দিন

ওইদিন দুপুর ১২.১৫ মিনিট এ জম্মু পৌঁছে একটু দিশেহারা মনে হল নিজেকে। পুলিসকে জিজ্ঞেস করে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এ গিয়ে হিন্দির ব্যবহারে একটা ট্যাক্সি নিলাম। বললেন ৬ দিনের ট্যুরে আমাদের চার্জ হবে ১৮ হাজার যা দরদামে শেষমেশ ১৫ হাজারে ঠেকল। ঠিক হল টাটা ইন্ডিকা এবং ওই ড্রাইভার আমাদের সবগুলো জায়গা ঘুরাবে। ২৯৮ কিঃমিঃ রাস্তা পারি দেয়া যে কঠিন, সাওয়ারি হিসেবে তা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। বুঝতে পারলাম দিল্লীর মতো কাশ্মীরও অনেক দূর। ১০০ কিঃমিঃ গিয়ে কিছুটা ক্লান্তি বোধ করায় আমরা রাতে মিনি কাশ্মীর খ্যাত জাম্মুর পাত্নিটপ থাকার সিদ্ধান্ত নেই। তাতেও সময় লাগল ৬ ঘন্টা। ভাড়া নিল ১০০০ রুপি (হোটেল এর মালিক আমার এফবিতে বন্ধু ছিল)। আমারও খুব ইচ্ছা ছিল রাতে থেকে যাবার, কারন ওখান থেকে প্যাহেলগাম এর রাস্তাটা নাকি এতই সুন্দর যা দিনের আলোতেই কেবল দেখা সম্ভব।

হলোও তাই। খুব সকালে উঠে না্শতা করে যেতে পথে পড়ল কাশ্মীরি ঈগল আর বুনফুলের বাহার আর পাহাড়ি উচু নিচু সাপের মত আকাবাকা খাঁড়া পথ এবং জওহর টানেল যা ৩ কিঃমিঃ বিস্ত্রিত। তার সাথে অজানা পথের লম্বা রাস্তা যার পাশেই আইসক্রিমের মত পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকা বরফ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্রাইভার আমাদের টাইটানিক ভিউ নামক অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গায় নামালেন। আমরা বাহারি রঙের কাশ্মীরি টুপি দেখতে পেলাম, কিনলামও। সেখানে দেখা কাশ্মীরি ঈগল আর বরফের পাহার দেখে নজর ফিরানো কঠিন। কিন্তু এক জায়গায় বেশিক্ষণ থেমে থাকলে যে মুসাফিরের হবার নয়। অতঃপর প্যাহেলগাম এরিয়াতে ঢুকতেই দুপাশে হলুদ সরিষার ফুলের মেলা আর তার বা পাশে শব্দ পেলাম পাহাড়ি অজানা গন্তব্যের কুলু কুলু ধ্বনির লিডার নদীর শব্দ যার মাঝে মনে হতেই পারে বিভিন্ন বড় পাথর যেন কেউ একে রেখেছে। গাড়ি থামিয়ে এমন দৃশ্যের পাশে চা না খেলে যে একবারেই নয়। তাই নেমে পরলাম চা খেতে আর কিছু ছবিকে ক্যামেরাবন্দি করতে। চা শেষে পুনরায় বেদুইনের যাত্রা আর গন্তব্য সেই প্যাহেলগাম।

আমার মতে প্যাহেলগাম কে মিনি বাংলাদেশ বললে তাতে ভুলের কিছু নেই। যাই হোক সে কথায় পরে আসি। চা খেয়ে আবার গতানুগতিক উদ্দেশ্যে প্যাহেলগাম এর জন্যে রওনা হলাম। এখন বাকি ১৬ কিলোমিটার। প্যাহেলগাম ঢুকতেই চোখ আটকে গেল দূর থেকে দেখা বরফি পাহাড়ের দিকে। একি কাণ্ড। এত গরম সহ্য করে এখানে এসে ঠান্ডায় জমে যাবার যোগাড়। যদি সম্রাট জাহাঙ্গির কাশ্মীর কে ভূস্বর্গ বলে থাকে তাহলে প্যাহেলগাম কে তার দরজা বলা যায়। তাই সেই সপ্নের দরজা দিয়ে ঢুকতেই পড়ল লোকাল মার্কেটের সামনে দিয়ে কিছু কিশোরের ঘোড়া নিয়ে আনাগোনা। সামনে পেরিয়ে যেতেই একটা ব্রিজ।

এই ব্রিজটিকে প্যাহেলগাম এ যেতে পুল-সিরাত বলতে ইচ্ছা হওয়া স্বাভাবিক মনে হতে পারে। ব্রিজ এ উঠে দেখলাম ডানে-বামে লিডার নদী আর তার সাথে অভিমানি শো শো শব্দ আরো তীব্র। আরো স্রোতস্বিনী। সেই নদিতে ঘোড়া নিয়ে এক ছোট্ট ছেলের ছুটে চলা দেখলাম। এমন দৃশ্য ছোটবেলায় দেখেছি কোন ছবিতে। ঘোড়া নিয়ে হিমালয় অঙ্গনে ঘোরার সাথে বেড়ে উঠা কিশরের ছবি। এ হয়ত বিশাল কোন কিছু নয় কিন্তু চিন্তা করলে এমন দৃশ্যের কথা যদি হয়ে থাকে হিমালয়ের পাদদেশে বয়ে যাওয়া নদীর উপর দিয়ে যেন কিশোর বেলার একটা সুন্দর মুহূর্তকে কেউ ছবি একে রেখেছে আর তা আমাদের কেবল অবলোকন মাত্র, তাহলে তা কেবল মুগ্ধতাই বলা যায়।

বেশি কালক্ষেপণ না করে ড্রাইভার কে বললাম “হাম লোগোকো লজ মে লেকে চালিয়ে, কিউ কি হামে লাগতা হ্যায় থোরা দের হোগায়ি” ড্রাইভার আমাদেরকে যে লজে নিল তার নাম্ও কাকতালীয় ভাবে “স্বর্গ প্যালেস”।

এবার আসি কেন কাশ্মীর কে মিনি বাংলাদেশ বলা হবেনা। আমরা যাবার পরে আমাদের কাছে ভাড়া চাওয়া হল ২ হাজার রুপী এবং তিনি তার কথায় সে একেবারেই অটল। উনি বললেন “ইসসে জ্যায়াদা কাম নেহি হ সাকতা কিউ কি ইয়ে হামারা সিজন কি বেস্ট টাইম হ্যায়” অগত্যা নিরাশ হয়ে ফিরতে হবে মনে হল। একটু নিচে নেমে আসার পথে এর আগে ঘুরে যাওয়া মালেক নামে কুমিল্লার এক ভাই এর কথা মনে এল। সোজা গিয়ে নতুন করে নিজের পরিচয় দিলাম যে আমি মোহাম্মাদ হামিদ এবং বাংলাদেশ থেকে এসেছি। শুনেই বললেন মুসলমান মানে আমাদের ভাই আর ক্রিকেট মানেই আমাদের কাছে বাংলাদেশ, আর বাংলাদেশ মানেই আমাদের প্রাণপ্রিয় সাকিব-আল-হাসান, এমনকি পাসপোর্ট এর কপিও রাখলেন না বললেন “জারুরাত নেহি”। তারপর আমার স্বভাবতই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার কে কাজে লাগিয়ে ১১০০ রুপিতে ঠিক করে ব্যাগেজ নিয়ে তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকে গেলাম।

রুমে ঢুঁকেই চক্ষু স্থির। এ যে দেখি ঘুরতে বাইরে যাবার দরকারই নেই। এত সুন্দর ভিউ যে লজ থেকে দেখা যেতে পারে এটা আমার চিন্তার বাইরেই ছিল। প্যাহেলগাম এর পুরো শহরটাই এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। লজের বারান্দায় বসে হিমালয় দেখতে দেখতে এক কাপ চা খাওয়ার কি যে খুব উচ্চ মানের মনরঞ্জন তা আর নাই বললাম। এখন বাজতে চলল বিকাল ৪টা। রুমে ঢুঁকেই বললাম “হামারে লিয়ে চিকেন লাগাইয়ে অর দাল” খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পরলাম ঘুরতে। প্যাহেলগাম এর মার্কেট পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গাড়ি পার্ক করে সামনে কিছুদূর যেতে না যেতেই বুঝলাম এই ঠাণ্ডায় বেশি পালোয়ান ভাব নিয়ে লাভ নেই। এমনি স্বাভাবিক কিন্তু হাওয়ার আনাগনা শুরু হলে নাটের গুরুও হার মানতে বাধ্য। সামনে এগিয়ে গিয়ে ওখানেরই একটা ক্লাবের পার্ক এ ঢুকবো তার আগে টিকেট কাউন্টার এ আমাদের জিজ্ঞেস করল যার উত্তর দিলাম যে আমরা বাংলাদেশ থেকে আসছি। উনি বললেন যাবার সময় টিকেট এর দাম দিয়েন। অতপর ভিতরে ঢুকেই প্রথমেই যেদিকে চোখ গেল তা হচ্ছে ঘাসের সাথে মিলে থাকা কিছু অপরুপ সাদা ফুল। এগুল কেউ লাগিয়েছে ?

বাগানে থাকা লোকটি উত্তর দিলে ভূস্বর্গে থাকা কিছু ফুল আল্লাহর দেওয়া কুদরত। সেই ফুল দিয়ে চার দিকে আচ্ছাদিত একটি কাঠের বেঞ্চ এ বসলাম। কিছুক্ষণ হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে বসে রইলাম যেন টাইম মেশিন দিয়ে কেউ সময়টিকে আটকে রেখেছে। সময়টা স্থবির। কিছু অবর্ণনীয় সৌন্দর্য অবলোকন শেষে ২০ রুপি টিকেটের দাম দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম লোকাল মার্কেট ঘুরতে। মার্কেট ঘুরে শালের বাহার দেখে মাথা ঘুরবার যোগাড়। আমাদের সামনে পাশ্মিনা, স্টল, কাশ্মীরি ট্র্যাডিশনাল ও উলের সহ নানান ধরনের শাল দেখাল। কোনটা রেখে কোনটা কিনব তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাত মনে হল ড্রাইভার আঙ্কেল আগেই বলে দিয়েছেন বেগানা খরচ বাচাতে চাইলে এখান থেকে কিছু না কিনতে। সে যাই হোক কিছু কিনি বা না কিনি দেখতে দোষের নেই বলাই বাহুল্য।

দেড়ি করে ঘুমালাম কিন্তু উঠলাম ভোরে। উঠে লবিতে গিয়ে বললাম এক কাপ চা দিতে। বলে বারান্দায় গিয়ে একটু জমিদারী কায়দায় রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসলাম। চা আসল। হঠাত আমি একটু অবাক হলাম। কালকে আমার দেখা পাহাড়ের গায়ে এত বরফ ছিলনা। বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করতে উত্তর দিল যে কাল রাতে তাপমাত্রা ছিল -৬, তাই রাতে বরফ পরেছে। তাতে পাহার বলতে পুরই বরফ। আচ্ছাদিত নয়। যেন বরফেরই তৈরি। চা উত্তর গোসল করে বললাম যে ঘোড়া নিয়ে আসতে। ঘোড়া চলে আসল। গতরাতেই কথা হয়েছিল ঘোরার ব্যাপারে। আর প্যাহেলগাম ঘুরতে ঘোড়ার যে বিকল্প একেবারেই নেই। ঘোড়ায় চরে রওনা দিলাম পাহারে চরার জন্যে।

ঘোড়া যখন উপরে ওঠার জন্যে ঠক ঠক শব্দ করা আরম্ভ করলে সেটা খুব মজাই লাগলো। কিন্তু যখন উপরে উঠতে ঘোড়া যে মই এ ওঠার কৌশল নিল তা দেখে আমার হার্ট ভয়ে বের হয়ে যাবার যোগাড়। কিন্তু ঘোড়া জানে তার কাজ কি আর কিভাবে কোথায় পা রেখে উঠতে হবে। যেতে যেতে পাহাড়ি অনেক সাদা সাদা ফুল দেখলাম যেন ছবির মত কেউ একে রেখেছে। কিন্তু কোমরের অবস্থা বারোটা। সেই সাথে আছে পরে যাবার ভয়। যেতে যেতে পৌঁছলাম কাশ্মীর ভ্যালীতে। এখান থেকে পুরো প্যাহেলগাম দেখা যায়। কিছু বাচ্চা, মহিলা, আর বুড় লোক ওখানে বসে ঠান্ডায় জবু থবু হয়ে বসে কাপছিল। তাদের বিনিয়োগ একটাই। খরগোশ নিয়ে বসে থাকা। যদি খরগোশ নিয়ে ছবি তুলতে হয় টাকা দিতে হবে। কিছু দিলামও। কিছু নিলামও। কেবল খরগোশের সাথে কিছু ছবি।

আবার ঘোড়ায় সাওায়ার হলাম। যাবার পথে চোখে পড়ল তীব্র গতিতে উপর থেকে আছড়ে পরা বরফ গলা ঠাণ্ডা ঝরনার। ঘোড়ায় চড়ার সময় বুঝলাম যে সে মালিকের কথাই কেবল অনুসরন করে। আর সব কথাও বুঝে। কিছুদুর সামনে যেতেই মনে হল এটা আমার ছবিতে দেখা কোন জায়গার ওয়ালপেপার। জায়গাটির নাম বাইসারান মিনি সুইজারল্যান্ড। ১৫ রুপি দিয়ে টিকেট নিয়ে ঢুকলাম গেট পেড়িয়ে। গেট বলতে কিছুই নয়। ভিতরে ঢুকে কিছুই করলাম না শুধু হিমালয় চুড়া আর তার ঢালে সগর্বে দারিয়ে থাকা পাইন গাছ দেখার জন্যে সাধু স্টাইলে সবুজ ঘাসের উপর বসে রইলাম। আমি কি সত্যি দেখছি নাকি ছবি। বুঝতেও কিছু সময় লেগে গেল। কিন্তু যাযাবর এক জায়গায় বসে থাকলে কিভাবে চলে।

বাজতে চলল সকাল ৯টা। পেটে দানাপানি এখন কিছুই পরেনি। পাশেই কিছু দোকান ছিল। আলু পরটা আর নুডলসের অর্ডার দিতেই শাল এর ফেরিওয়ালারা চলে আসলেন। একটা স্টল আর ২ টা শাল কিনে ফেললাম। গরম গরম নাস্তাটা যে মিনি সুইজারল্যান্ড এর মতো চোখ না ফেরাবার মত জায়গায় হবে ভেবে আসলেই ভাল লাগলো। নাস্তা শেষ করে কিছুদুর সামনে যেতেই কিছু ছবিকে বন্দি করে নিয়ে ফিরে চলার পুরনো প্রয়াস। ফেরার পথে তো আরও বিপদ। চরাই এর থেকে উতরাইতে বিপদের কাটা বেশিই মনে হয় দুলে থাকে। মনে হয় এই বুঝে গেলাম পরে। এত প্রশিক্ষিত ওস্তাদ মার্কা ঘোড়াও বুঝতে পারছেনা কোথায় পা রাখবে। নেমে হাফ ছেড়ে বাচলাম। আর প্রতি ঘোড়া টাকা দিলাম ১৫০০। সেই সাথে ঘোড়াওয়ালাকে ১০০ রুপি টিপস। প্যাহেলগাম এসে আইল্যান্ড পার্ক না ঘুরলে যে নিতান্তই বোকামি তার পরিচয় না দিয়ে ঢুকে পড়লাম। এবার লিডার নদীর মাঝে কিছু পাথরের উপর বসে রইলাম কিছুক্ষন। আর স্রোতের এ নদীর কথা কেবল একটাই। তার পথ চলার শো শো শব্দ। তবে অনেকক্ষণ বসে কিছু ছবি তুলে নিলাম। বলাই বাহুল্য যে ক্যামেরারও ক্ষমতা নেই সমান সৌন্দর্যের ছবিকে বন্দি করতে।

প্যাহেলগাম এসে মনে হল সৌন্দর্যের সীমা নেই, রাখেনি তাকে কেউ আটকে। সৌন্দর্য পুরো প্যাহেলগাম জুড়ে। ব্যাগ গুছিয়ে অতপর গন্তব্য ডাল লেক, সোনামার্গ, গুল্মারগ এর উদ্দেশ্য নিয়ে আবার বেদুইনের যাত্রা ।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ indiaKashmirstorytravel