কাশ্মীর গ্ৰেট লেকস – যেন রূপকথার দেশ

যাকে আমরা স্বপ্ন বলি, তাকে পাওয়ার ইচ্ছে হয়তো অন্তরের গভীরে লালন করি, কিন্তু যাকে পাওয়ার সাহস কখনও স্বপ্নেও আসে না, নিজের সামর্থ‍্যের সীমাবদ্ধতা হেতু যাকে চির অপ্রাপনীয় ভেবে দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, সে যদি স্বয়ং এসে বাহুডোরে ধরা দিয়ে পূর্ণতার অনুভবে জীবন মধুর করে তোলে, সেই আনন্দকে কোন উপমায় প্রকাশ করতে হয়, তা আমার অজানা। শুধু মন বলে, সেই আনন্দধারায় পরিপূর্ণ অবগাহন করে তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে। আর সেই একাত্মতার জন্যই হয়তো, কাশ্মীর গ্ৰেট লেকস ট্রেকের শেষে বাড়ি ফিরে এসে দিন কাটলেও ঘোর কাটে না। আমার হয়ে আমার সব কাজ যেন করে চলে অন্য কেউ, আর আমি শুধু ধ্যানমগ্ন হয়ে আস্বাদনে মাতি আনন্দরূপমৃতের। একসময় সেই নিরুপম সৌন্দর্যকে সাধ্যমতো অক্ষরবন্দি করে ফেলার আকুল প্রয়াস অন্তরে অনুভূত হয়। কিছু প্রাপ্তিকে হয়তো কখনোই অক্ষরমালায় কাঙ্ক্ষিত রূপে ফুটিয়ে তোলা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তবুও, ভালোলাগা বা ভালোবাসার ধর্মই তো প্রকাশ। আর যে পথে একবার পা দিলে তার প্রতিটি ধুলোকণার প্রতি পথিকের অকৃত্রিম ভালোবাসা তৈরি হয়, এ হল সেই পথ। তাই, সেই পথের প্রতি ভালোবাসা আপন স্বভাবধর্মেই বর্ণমালাকে সাজিয়ে চিত্রমালা বানিয়ে নেয়।

শ্রীনগরের গরম বিস্মিত করলেও গাড়ি যখন ডাল লেকের পাশ দিয়ে চলা শুরু করলো, সেই সারিবদ্ধ পপলার, ঘাটে ঘাটে সুসজ্জিত শিকারা, উন্নত শির প্রস্ফুটিত পদ্মবন, অন্দিন্দ‍্যসুন্দর কাশ্মীরি মানুষজন, সকলেই যেন পূর্ব পরিচিত সাদর সম্ভাষণে স্বাগত জানালো আমায়। কত প্রিয়, কত চেনা এই সুন্দর নগরী যেন আমায় হাসিমুখে বললো, যাও ইচ্ছেমতো ঘুরে এসো। ঘন্টা তিনেক পরে এসে পৌঁছালাম ছবির মতো সুন্দর, আমাদের প্রথম ক্যাম্পসাইট সিতকাডিতে। প্রায় ৭.৩০ টা পর্যন্ত দিনের আলো থাকায় দুচোখ ভরে আমরা সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের রূপমাধুরী উপভোগ করলাম।

শিতকাডি ক্যাম্পসাইট। বাঁদিকে সোনমার্গ ভ্যালি, আর ডানদিকের পাহাড়ের উপরে দেখা যাচ্ছে থাজ্জিয়াস গ্লেসিয়ার।

দূরের গ্লেসিয়ার, নীচে বয়ে চলা উচ্ছল নদী, ঢেউ খেলানো সবুজ উপত্যকায় আমাদের তাঁবু, স্থানীয় মেষপালক ও তাদের ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা, সদ্য আলাপ হওয়া মানুষজন আর আগামী কয়েকদিনের জন্য বুকে একরাশ উত্তেজনা – মনের মধ্যে কোলাজ সাজিয়ে স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে নদী আর বেলাভূমির খুনসুটি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরের বেলা পাশের টেন্টে ঘোড়ার লাথিতে ঘুম ভাঙা মহাশ্বেতার চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙলো। প্রথম রাত থেকে কাশ্মীরের ঘোড়াগুলো সেই যে ওকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া শুরু করলো, তা অক্ষুন্ন রইল পরের দিনগুলোতেও। ভোরের আকাশের কী অপরূপ শোভা তা বেরিয়ে এসে দেখে মোহিত হয়ে গেলাম। মেঘমুক্ত আকাশে অগুণতি তারার মেলা। তখনও বিন্দুমাত্র বুঝিনি আজ চলার পথেই বৃষ্টি পাব। সকালে এলাহি সব ব্রেকফাস্ট সাধ্যমতো খেয়ে হাঁটা শুরু হল নিচনাই-এর উদ্দেশ্যে। প্রথম দিনের হাঁটা, সবার সাথে আলাপ পরিচয় ধীরে ধীরে বাড়ছে, বাংলাদেশ থেকে আসা ছোট্ট তেহজীব সব্বার প্রিয় হয়ে উঠেছে অচিরেই, আমাদের টিম লিডার তমোঘ্ন ভীষণ যত্নে ও সহযোগিতায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের, রকমারি মজার গল্প ওর ঝুলিতে, ওয়াসিম না সাহস দিলে হয়তো আসাই হতো না আমার, পথের অপূর্ব সৌন্দর্য যত দুচোখ ধন্য করছে, ততই মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছি ওকে। ভেবেছিলাম অনেক লম্বা হাঁটা, আমার দ্বারা আদৌ হয়ে উঠবে কিনা কে জানে! সেই সংশয় নিরসন না হলেও কেন জানি না মন বলছে এই পথ আমাদের ফেরাবে না। এখানে আর পারব না বলে হাল ছেড়ে দেওয়া বুঝি অসম্ভব, এ যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে টেনে নিয়ে যাবে আমাদের শেষ পর্যন্ত।

যত উপরে উঠছি, বিভিন্ন বাঁক থেকে সোনমার্গকে দেখছি ধীরে ধীরে দূরে চলে যেতে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে হাঁটা শুরুর কিছু পর থেকেই। সবাই ঝলমলে রোদের দেখা পেতে চাইছি, তাই মেঘগুলো অভিমানে মুখ কালো করে নিচ্ছে, তখন হাঁ করে দেখছি সবুজ গালিচার উপর সেই গভীর নিবিড় কাজল কালো রূপের বিস্তার। সামনে পিছনে দুই কাশ্মীরি কিশোর আমাদের এই কদিন সঙ্গ দেবে। সাজ্জু ভাই আর কাকা। শান্ত অথচ প্রাণবন্ত এই দুটি মানুষের সাহচর্য আমাদের মতো সমতলী পথিকদের বড়ো পাওনা। কখনও বলে ‘চলো চলো’, কখনও অবস্থা সঙ্গীন বুঝে বলে, ‘আরামসে চলো’। আর আমরা কয়েক কদম করে হাঁটি আর বারবার থামি, কোন কথাটা মানা উচিত ঠিক করতে পারি না। বুকভরে দম নেওয়ার আগেই কানের কাছে ‘চলো চলো’ শোনার ভয়ে হাঁটা লাগাই। টিম লিডার ভাই জানায় টেবিল টপের পর জঙ্গলের রাস্তা কাদায় পিচ্ছিল হয়ে পড়লে নিচনাই ক্যাম্পে পৌঁছানো আমাদের পক্ষে কঠিন হবে। কারণ প্রথম দিনে বৃষ্টি ভিজে অতটা চলার পরে শরীর খারাপ হয়ে গেলে সেটা গ্ৰুপের পক্ষে সমস্যার হবে। সেক্ষেত্রে টেবিল টপে পৌঁছে বৃষ্টির অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বারোটার মধ্যে টেবিল টপে পৌঁছে গরম চা-ম‍্যাগি খেয়ে ধাতস্থ হয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা। পরপর অনেক গ্ৰুপ এসে জমা হয়। ভেতরে ভিড় বাড়ে বাইরে বৃষ্টিও বাড়ে। এরমধ্যে অন্য টিমের একজনের জুতো যায় হারিয়ে। অনেক টিম সামনে রওনা হয় বৃষ্টির মধ্যেই। তমোঘ্ন ভাই সিদ্ধান্ত নেয় এখানেই থেকে যাওয়ার। বিকেল নাগাদ বৃষ্টি থামে। উপত্যকায় দাঁড়িয়ে মন ভরে প্রত্যেকে রোদ মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি দেখতে থাকে। সুদীর্ঘ বিকেলে আড্ডা জমে গরম গরম আলুর চিপস আর চা সহযোগে। রাতের মেনুতে শেষ পাতে শাহী টুকরা সবার মন জিতে নেয়। পরদিন ভোরে ঝকঝকে আকাশ দেখে মন আহ্লাদিত হয়ে ওঠে। একটু রোদ উঠলেই জঙ্গলের কাদা খানিকটা শুকাবে।

প্রথমদিনের ক্যাম্পসাইট টেবিলটপ

আজ দেড় দিনের পথ চলে পৌঁছাতে হবে বিষানসার (Vishansar) ক্যাম্পসাইট। খুব দ্রুত তৈরি হয়ে সাতটার আগেই হাঁটা শুরু হল। প্রথম দিকের চড়াই উঠতে সবসময়ই খুব কষ্ট হয় আমার। জঙ্গলে ঢুকেই অনুভব করলাম কালকের সিদ্ধান্ত কতখানি সঠিক ছিল। অনেকে আছাড় খেলাম অনেকে পা হড়কে সামলে নিয়ে এগোতে থাকলাম একসঙ্গে। সিঞ্চন যে কোনো অবস্থাতেই যত্ন করে দৌড়ে দৌড়ে গ্ৰুপের ভিডিও বানিয়ে চলেছিল। অফুরন্ত প্রাণশক্তি ওর। নদীর ধার দিয়ে বোল্ডার পেরিয়ে যেতে যেতে সবাই খালি হয়ে আসা বোতল ভরে নিচ্ছিলাম। কাশ্মীরি মানুষের মতোই কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণতা দান করে কাশ্মীরের মনুষ্যেতর প্রাণীরা। সুবিস্তৃত পাহাড়, নীচ দিয়ে বয়ে চলা নদী, ইতস্তত চরে বেড়ানো একটি দুটি ঘোড়া আর ভেড়ার দল – এই সবকিছু নিয়ে কাশ্মীরের ছবির মত ল্যান্ডস্কেপ মনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। সবাই সবার সাহায্যে বোল্ডার টপকে নদী পার হয়ে ধীরে ধীরে পৌঁছালাম নিচনাই পাসের নিচে। যে সমস্ত দল আগের রাতে নিচনাই ক্যাম্পে ছিল, পাসে ওঠার রাস্তায় তাদের দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি আমরা। ধীরে ধীরে, থেমে থেমে, এই ট্রেকের প্রথম পাস অতিক্রমের পথে আমরা। উপরে উঠে ম্যাগি পয়েন্টে একটু বিশ্রাম। যেহেতু আজ লম্বা পথ হাঁটা তাই নিজেদের পিছিয়ে থাকা সময়টাকে ধরার জন্য সবাই সবার মনোরথ গতিতে হেঁটে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই হাজির ম্যাগি পয়েন্টে।

চা, কফি, ম্যাগি, জুস ইত্যাদির সাহায্যে ঝিমিয়ে পড়া শরীরটাতে একটু দম ভরে নেওয়া। আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু। টিমের সবাই একসাথে হলে তারপর আবার নামা শুরু। সুদীর্ঘ পথ নামতে হয় ভীষণ সতর্ক ভাবে। পা হড়কালেই সমস্যা। কখনও স্পিডে কখনও ধীরে, কখনও সামনে কখনও পিছনে, যে যার নিজস্ব ভঙ্গিতে চলার আনন্দে স্বর্গসম পথের অপার সৌন্দর্যকে আকণ্ঠ উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছি। মেয়েরা মাঝেমাঝেই ধুয়ো তুলছি ‘আর কত দূর’, তবুও তা যেন বলার জন্যই বলা। তেমন ক্লান্তি কারোর মধ্যে দেখা যায়না। ছোট্ট শিশুটিও প্রজাপতির মত খিলখিলিয়ে উড়ে চলেছে। এই পথ, তার অনন্ত মাধুরী যেন ম্যাজিকের মত সর্বক্লান্তিহরা। যতবার কাশ্মীরে এসেছি ততবারই কোনো অপার্থিব কারণে শরীর মনের সকল বিষাদ ধুয়ে নবজন্ম লাভ করে ফিরে গেছি। তাই নিজের অজান্তে এক গভীর বিশ্বাস হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে যে ভূ-স্বর্গের আকাশে বাতাসে অমৃতসুধার সঞ্জীবনী রেণুরা অপেক্ষায় থাকে আমাদের মত পিয়াসী পথিককে স্নেহচুম্বন দেবে বলে। তাই আপন খুশিতে মত্ত হয়ে মাঝপথে বাড়া বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে আমরা কয়জন ভুল করে ক্যাম্পসাইট পেরিয়ে চলে যাই আরও এগিয়ে। ফিরে আসতে আসতে আরও যাই ভিজে। কোনোরকমে তাঁবুতে ঢুকে খবরের কাগজ, শুকনো জামাকাপড়, গরম চা স্বস্তি এনে দেয়। উপরি পাওনা হল সুস্বাদু পাস্তা।

বিষাণসার ক্যাম্পসাইট

বৃষ্টি না থামলে হয়তো বাফার ডে কাল এখানেই কাটবে। জমিয়ে আড্ডা চলছে ডাইনিং টেন্টে। দীপায়নের জুতো ছিঁড়ে যাওয়ায় ও একটু ঝিমিয়ে। তেহজীব কচি গলায় মায়ের লেখা গান শুনিয়ে বিভোর করে দেয় আমাদের। “আমার মন লাগেনা শহরে….. তাইতো আইলাম পাহাড়ে। ” যত ওকে দেখছি ততই বিস্ময়ে ভালোলাগায় অভিভূত হচ্ছি। আট বছর বয়সে প্রায় তিরিশটি ট্রেকের অভিজ্ঞতা নিয়ে ও এসেছে কাশ্মীরে। রিকুর কথা মনে পড়ছিলো। হামতা পাসের পথে ওকে দেখে যেমন অবাক হয়েছিলাম, এবারে তেহজীবকে দেখে তেমনই ভালো লাগলো। সবাই সবার ঝুলি থেকে নানান গল্প শোনাচ্ছে। আটটার মধ্যে চলে আসছে রাতের খাবার। গরম গরম ভাত, রুটি, সবজি,পায়েস পরম তৃপ্তিতে খেয়ে যে যার টেন্টে ফিরে ঘুম। রাত্রে বৃষ্টি থামে না। সকাল অবধি আবহাওয়া দেখে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই, বাফার ডে কাটবে বিষাণসার ক্যাম্পসাইটেই। যদিও আমাদের ক্যাম্পটি ছিল মূল ক্যাম্পসাইটের বেশ খানিকটা আগে নদীর ধারে নিরিবিলি জায়গায়। আকাশ একটু পরিষ্কার হলে একদল ছবির সন্ধানে এগিয়ে যায় নদীর ওপারে ফুলের গালিচায়। আর একদল গতদিনের ভিজে রেনকোট, জুতো শুকোতে বসে। বলাই বাহুল্য আমি দ্বিতীয় দলের অভাগা। সময় অনন্ত, তাই ইতিউতি মার্মটরাও বেরিয়ে পড়ে ফটোগ্ৰাফারদের পোজ দিতে। বৃষ্টি ছেড়ে ছাড়ে না আমাদের। মাঝেমাঝেই আসে যায়। দুপুরে ওই বাদল দিনে পাহাড়ি উপত্যকায় টেন্টে বসে পাঁপড় ও আচার সহযোগে গরম গরম খিচুড়ি অমৃতোপম মনে হয়। খেয়ে দেয়ে বিষাণসার লেক দেখতে যাওয়ার জন্য সবাই তৈরি হই। আর্মি ক্যাম্পে সমস্ত ডকুমেন্ট তমোঘ্নরা আগেই জমা দিয়ে এসেছিল। তবু কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদের ছাড়া হয়। সামান্য হেঁটেই পৌঁছে যাই লেকের ধারে। স্বচ্ছ সুন্দর পবিত্র এই জল। কাছে গিয়ে আকুতি জানাই, চড়াই ভেঙে তার যে প্রকৃত রঙ প্রত্যক্ষ করতে এসেছি তার সুযোগ থেকে ঈশ্বর যেন বঞ্চিত না করেন। আরও কিছুটা উপরে কিষনসার লেক।

বিষাণসার লেক। এই জায়গা থেকে এতটা ওয়াইড ছবি তোলা সম্ভব নয়। চারটি পোট্রেট ছবি তুলে মার্জ করে পুরোটা নেওয়া হয়েছে।

তখনও জানিনা কাল যেতে পারবো কি না। মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আকুলতা নিয়ে বাঁদিকে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অবস্থান দেখে শ্লথ গতিতে ফিরে এলাম। এরপর শুধুই আলোচনা, শুধুই অপেক্ষা। উৎকণ্ঠিত প্রহর গোনা এক রোদ ঝলমলে সকালের জন্য। তখনও বৃষ্টি ভয় দেখায়, তখনও সে আসে যায়। বার্তা পাঠায় সঙ্গী স্থানীয় মানুষগুলির মুখে। কাকা, সাজ্জু ভাই, নুরানি ভাই সকলে এসে একে একে থমথমে মুখে বলে যায়, এই আবহাওয়া চললে কোনোমতেই গাদসার (Gadsar) পাস অতিক্রম করা ঘোড়ার পক্ষে অসম্ভব। শুধু তাই নয়, তারা এও বলে, যদি বৃষ্টি না থামে, সারারাত কনকনে ঠাণ্ডায় এই অবলা প্রাণীগুলি মৃতপ্রায় অবস্থায় গিয়ে পোঁছাবে। প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে প্রার্থনা জানাই আমাদের এতদিনের অধরা স্বপ্নটার সাফল্য-প্রাপ্তির জন্য, প্রার্থনা জানাই আমাদের টিমের তেরোজন সদস্যের জন্য, প্রার্থনা জানাই জীবনে নানাবিধ আপস করে একবুক আশা নিয়ে ওখানে এসে পৌঁছানো অসংখ্য পাহাড়-প্রেমী মানুষের জন্য, প্রার্থনা জানাই ঈশ্বরের পৃথিবীতে অবলা অবোধ তাঁবুর বাইরে ভিজতে থাকা প্রাণীগুলির জন্য। সারারাত আধো ঘুমে কান পেতে নদী ও বৃষ্টির আওয়াজ আলাদা করতে থাকি। ট্রেকের চতুর্থ রাতে একবুক অনিশ্চয়তা আর ঈশ্বরের উপর অগাধ আস্থা – এই দুই-এর দোলায় দুলতে দুলতে প্রতীক্ষায় থাকি এক আশ্চর্য সকালের।

দুরু দুরু বুকে মেঘের ঘোমটা সরার অপেক্ষা

অবশেষে ভোর হয়, পাশের স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে ত্রুপ্তি। একবুক উন্মাদনা নিয়ে উড়িষ্যা থেকে প্রথমবার পাহাড়ে হাঁটতে এসেছে সে একলাই। একই টেন্টে থাকছি আমরা। ঘুম ভেঙে থেকে একমনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে সে। শুনে আমূল শিহরিত হয়ে উপলব্ধি করি, মসজিদে নমাজের মতোই সম্মিলিতভাবে নতজানু হৃদয়ে প্রতিটি টেন্টে কাল সারারাত একটিই আকুতি পাহাড়ের দেবতার চরণে সকলে অর্পণ করেছি। ভয়ে ভয়ে টেন্টের চেন খুলে বাইরের আকাশে তাকাই আলোর প্রত্যাশা নিয়ে, আর তড়াক করে লাফিয়ে বেরিয়ে আসি। কোনো যাদুকর যেন অদৃশ্য থেকে ম্যাজিকের মতো যাদুদণ্ড বুলিয়ে মেঘেদের ফাঁকে ফাঁকে বিচ্ছুরিত করছে আশার কিরণ। সকলের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে আমরা যেন যুদ্ধে নেমেছি। মেঘ সরিয়ে, রোদ উঠিয়ে, পথের কাদা শুকিয়ে, ঘোড়ার নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চিন্ততা দিয়ে নিজেরা আজ গাদসার ক্যাম্পে পৌঁছাবই।

অনেক পরিকল্পনা চলতে থাকে আমাদের কাণ্ডারীদের মধ্যে। আশেপাশের অনেক টিম বাফার-ডে না থাকায় ফিরে যাওয়া মনস্থির করে। আকাশে নীলিমার পরিমাণ বাড়তে থাকে, মনের মধ্যেও মেঘ-রোদের লুকোচুরি খেলায় রোদের পাল্লা ভারী হয়। দলের সিদ্ধান্ত কানে আসে, আগে আমরা পাসের নীচ পর্যন্ত পৌঁছাব। যদি একটি দলও উপরে যায় তাহলে আমরা হব তাদের অনুগামী। অপার দোলাচল, একাগ্ৰ প্রার্থনা জয়ী হতে থাকে। ক্রমশঃ আদিগন্ত বিস্তৃত হয়ে রোদ্দুর ছড়ায়। দূরের গাদসার পাস আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে। কাদা শুকোতে যে রোদ প্রয়োজন, বাতাসে যদি সে ক্ষমতা থাকতো তাহলে কাল সারারাত এখানে সম্মিলিত ট্রেকারদের দীর্ঘশ্বাসের বাতাস সে কাজটি সম্পন্ন করে ফেলত। হাঁটা শুরু হয়, বিষনসারকে (Vishansar) অতিক্রম করে উঠতে থাকি কিষনসারের (Kishansar) পথে।

কিষনসার লেক

আকাশ পরিষ্কার হয়। উপরে উঠতে উঠতে থামি, দু’চোখ ভরে পান করতে থাকি নিচের লেকের রূপমাধুরী। ছবি দেখে উন্মত্তবৎ হয়ে তাকে চাক্ষুষ করতে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রতি মুহূর্তে সার্থক হয়, সার্থক হয় এই মানবজন্ম। অপূর্ব সুন্দর কিষনসার লেক পার হয়ে সবুজ ঢেউ খেলানো এক উপত্যকায় চলার পরে একসময় পৌঁছাই গাদসার (Gadsar) পাসের নীচে। উপরে উঠি, অপেক্ষায় থাকি আরও কত সুন্দর হয়ে, আরও কত শোভা বিস্তার করে এই স্বর্গীয় পথ আমাদের জীবনকে কৃতার্থ করবে। প্রচণ্ড হাঁপ ধরে। বারবার থামতে হয়। তারই মাঝে ঘোড়াদের ছেড়ে দিতে হয় পথ। শুধুই হাঁটা, উপরে ওঠা, বিশ্রাম নেওয়া, জল খাওয়া – এসবের মাঝে দুদণ্ড অবকাশ মেলে না। যে প্রবল ভালোলাগায় হৃদয় মথিত হয়ে চলেছে, যে প্রবল আবেগে মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাকে চলতে চলতেই উপভোগ করতে হয়। পান্নাসবুজ দুটি লেক মনমোহিনী হয়ে বিভিন্ন বাঁকে দৃশ্যমান হয়। যেন অপূর্ব লাস্যে হাতছানি দিয়ে নীচে ডাকে, উপরে উঠতে বাধা দেয়। তবু উঠি, তার অপরূপ বিভঙ্গকে আরও মধুর রূপে চাক্ষুষ করার জন্য তার হাতছানি উপেক্ষা করতেই হয়। অবশেষে পৌঁছে যাই গাদসার পাসে। এটি শুধু ট্রেকের দ্বিতীয় পাস অতিক্রম করা নয়, এ ছিল আমাদের সম্মিলিতভাবে এক দৈব আশীর্বাদে ধন্য হওয়ার মুহূর্ত। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে উপস্থিত সকলের সঙ্গে অদ্ভুত আত্মিক টান অনুভূত হয়। সুন্দরবনে বাঘ দেখতে পেয়ে কয়েক মুহূর্তেই লঞ্চে স্বল্পপরিচিত মানুষগুলির সঙ্গে যে একাত্মতা তৈরি হয়েছিল, কিছুটা তার সঙ্গে মিল টের পাই। সবাই খুশীতে হইহই করে ওঠে। দু-তিনদিনের পরিচয় আরও নিবিড় হয় এই আনন্দঘন পরিবেশে।

গাদসার পাসের উপর আমি আর তেহজীব। নীচে কিষাণসার আর বিষাণসার লেক।

তারপর নামার পালা। পাকদণ্ডি পথ ঘুরে ঘুরে নামতে থাকি। যমসার (Yamsar) লেক এবং আরেকটি নাম না জানা লেক দৃষ্টিগোচর হয়। এখনও বহু পথ হাঁটা বাকি। খিদেটা ক্রমশঃ বাড়ছে। লাঞ্চের জায়গা ঠিক হয়ে আছে নীচের ভ্যালিতে। যত দ্রুতই এগোতে থাকি না কেন, দূরের উপত্যকা দূরেই রয়ে যায়। তার মধ্যে শুরু হয়ে যায় অজস্র বেগুনি-হলুদ রঙবাহারি ফুলের সমারোহ। লাঞ্চের সময় আরও পিছিয়ে যায় ছবি তোলার চক্করে। সঙ্গীদের দেখতে পেয়ে অবশেষে ক্ষুধা নিবৃত্তি। ওখানেই সাক্ষাৎ হয় আমাদের ঘোড়াদের সাথে। তমোঘ্নর স্বস্তির নিঃশ্বাস দেখে টিম লিডারের গুরুদায়িত্বের কথা অনুভব করি। হিন্দোলকে দেখতে পাওয়া যায়না। সে নাকি এগিয়ে গেছে অন্য টিমের সঙ্গে। খেয়ে দেয়ে দুলকি চালে রওনা হই। প্রায় সমতল উপত্যকা। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে পথের দুই ধার। চোখে না দেখলে সেই পুষ্পিত উপত্যকার সুষমা বর্ণনা প্রায় অসাধ‍্য ব্যাপার। অপূর্ব ভালোলাগায় বিবশ হয়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো সম্মোহিত হয়ে সবাই সামনে এগোচ্ছি।

বলেছিলাম না ফুলের গালিচা

সিঞ্চন আর অভি একবার উপরে একবার নীচে দৌড়াদৌড়ি করে ছবি, ভিডিও মনের সুখে তুলেছে। বেশিরভাগ সময়েই তাই ওর স্টিক আমার হাতে। চলতে চলতে পথের বাঁদিকে গাদসার লেক। গ্লেসিয়ার থেকে জল চুঁইয়ে নেমে গভীরতম এই হ্রদ উৎপন্ন হয়েছে। এই অনির্বচনীয় সুন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে হৃদয়ে অনুভব করি এইসব মুহূর্তেই তো আসলে আমরা বাঁচি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন, ক্লান্তি, অবসাদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। নতুন করে আমাদের প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বসিত করে তোলে চিরন্তনী প্রকৃতি তার শাশ্বত মহিমায়। ছোট্ট তেহজীব অনেকখানি পথ বকমবকম গল্পে ভরিয়ে রাখে। ভারি মিষ্টি ও সার্থকনামা বাচ্চা সে। তার পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে কাশ্মীরে এসেছে তারা। তার বাবা-মায়ের মতো সব বাবা-মা বাচ্চাকে এইভাবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলায় উদ্যোগী হলে, চারপাশের পৃথিবী হয়তো অন‍্যরকম হত।

সকলে একসঙ্গে চলতে থাকি, চলতে চলতে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হই, ফুলের বন শেষ হয় না। বিকেল হয়ে আসে, পায়ে ক্লান্তি জমে। একটু এগিয়ে দেখি সব্বাই একসাথে ঘাসের উপর শুয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। একেবারে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি আমরাও। জায়গাটির অনেক নীচে রুপালি সুতোর মতো বয়ে চলেছে নদী। দূরের পাহাড়ের গায়ে মেঘ ও রোদের লুকোচুরি শুরু হয়েছে। যেদিকে তাকাই চোখের আরাম ও মনের প্রশান্তি, সবুজ গালিচার উপর শুয়ে থাকতে থাকতে সময়কে থামিয়ে দিতে বড়ো সাধ হয়। এত ভালোলাগা একসাথে হৃদয়কে কবে ভরিয়েছিল মনে পড়ে না। মনে হয়, সেই কত যুগ আগে থেকে এই পথের প্রান্তে বসে থাকা সব পথিকের মধ্যেই আমার আমিকে খুঁজে পাই। মনে হয়, আজ থেকে আরও বহুবছর পরে, এমনই এক আলোছায়াময় গোধূলি-সমানীত বিকেলে যখন কোনো পথিক এসে আবার দু’দণ্ড বসবে এমনি করে এই পথের পাশে, তখন তার মধ্যেও থাকব আমি। আবার দেখব, হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করব, অনুভব করব, আনত হয়ে সমগ্ৰ সত্তায় মিশিয়ে নেব এই পূণ্যভূমির প্রতিটি রেণুর স্পর্শ। শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবি, স্থানীয় মেষপালকদের বাচ্চারা লাজুক চোখে মিটিমিটি চায়। কচি হাতে লজেন্স পেলে গোলাপি গালে টোল ফেলে একমুখ হাসে। চলতে চলতে দম ফুরিয়ে আসে। পথ যেন আজ শেষই হয়না। প্রতিটা বাঁকে পৌঁছে ক্যাম্পসাইট খুঁজি। কোন চিহ্নই মেলে না। গত দুইদিনে এতখানি ক্লান্তি অনুভূত হয়নি। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আর্মি ক্যাম্পে জাতীয় পতাকা দেখে অন্যরকম আবেগ মনে দানা বাঁধে। তার পিছনেই উঁকি দেয় আমাদের ক্যাম্পসাইট।

স্বর্গীয় গাদসার লেক। এটা গভীরতম লেক ট্রেকরুটের মধ্যে।

প্রতিদিনের মতো সান্ধ্য আড্ডা জমে। তমোঘ্ন ভাই টেন্ট থেকে বেরিয়ে হঠাৎ ডাক দেয় ছবি তুলিয়ে দাদাকে, আমরাও বেরিয়ে আসি। সক্কলে দু’চোখ ভরে বিস্ময়ে থ হয়ে কোনো লেন্স ছাড়াই প্রত্যক্ষ করি আকাশগঙ্গার অপার্থিব বিস্তার। আজ পর্যন্ত খালি চোখে এত সুন্দর স্পষ্ট ছায়াপথ আমি আগে কোথাও দেখিনি। সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের নীচে দাঁড়িয়ে, গতরাতের অনিশ্চয়তার কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় মন আপ্লুত হয়ে আসে। অদৃশ্য থেকে সেই পরম শক্তিমান তাঁর অসীম করুণাধারা বর্ষণ না করলে তাঁকে এত রূপে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য নশ্বর মানুষ কীভাবে পাবে !

পরদিন সাতসার (Satsar) অর্থাৎ সাতটি লেক দেখার দিন। আজও আমরা রওনা দিয়েছি সকাল সকাল। নদী পার হয়ে কস্তুরী টপে ওঠা শুরু করেছি। পাকদণ্ডি পথ ঘুরেঘুরে উঠছি। প্রতিরাতের মতো কাল রাতেও ট্রেল সম্পর্কে সযত্নে বিবরণ দিয়েছিল আমাদের টিমলিডার। বারবার সতর্ক করেছিল এই রাস্তায় কেউ যেন শর্টকাট না নেয়। এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, প্রতিদিনের লম্বা পথের খুঁটিনাটি এমন ছবির মতো বর্ণনায় আমাদের সামনে আগের রাতে তুলে ধরা হত, যা রীতিমতো প্রশংসার দাবি রাখে। পরের দিন চলতে চলতে শোনা পথের বর্ণনা হুবহু মিলে যেতে দেখে বেশ অবাক হতাম। বুঝতাম, পাহাড়ি পথ আর নিজের কাজ – এই দুটি সম্পর্কে কতখানি যত্নবান ও আন্তরিক হলে এমন সুচারু ভাবে নেতৃত্বদান সম্ভব হয়। প্রতিদিন প্রথম চড়াইটুকু উঠতে আমার দম ফেটে যেত, আর এপথে রোজই চড়াই উৎরাই। চকলেট লজেন্স আর জল ধারাবাহিকভাবে গলা শুকিয়ে যাওয়া আটকাতো। অনেকটা উঠে আসার পর মেঘের আড়াল থেকে দুধসাদা নাঙ্গা পর্বত মুচকি হেসে সম্ভাষণ জানায়। পায়ের ব্যথা ভুলে মহাশ্বেতাও কলবলিয়ে ওঠে। অনেকেই বিশ্রাম নিতে বসে গেছে দেখে লোভ সামলানো যায় না। কিন্তু আমাদের বলা হয় আরও এগিয়ে যেতে। অবশেষে অপূর্ব এক উপত্যকাকে আরামের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে দেখে উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে যাই। কি অসাধারণ সুন্দর একটি জায়গা। ক্যালেন্ডারের মতো একদিকে ঘন নীল আকাশের নীচে ঢেউ খেলানো ঘন সবুজ উপত্যকা আর অন্যদিকে সেই নীলিমাকে স্পর্শ করে থাকা সুউচ্চ পর্বতমালা। ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে অনুভব করি, ভিতর থেকে সেই দুরন্ত বন্য মেয়েটি বেরিয়ে এসে গোটা প্রান্তর গোলাপি ওড়না উড়িয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় নেচে বেড়াচ্ছে, যার উপস্থিতি আমি টের পাই কেবল প্রকৃতি-মায়ের এমন নিবিড় সান্নিধ্যে এলেই।

সাতসারের আরেকটি লেক, কোনটি বেশি সুন্দর অনেক ভেবেও বুঝতে পারিনি।

প্রত্যেকে ভীষণ মাত্রায় ভালোলাগা উপভোগ করি। সেই ভালোলাগা ভাগ করে নিই টুকরো খাবার আর চকলেটের সাথে। একটু করে তৈরি হয় ভাই-বোন-বন্ধু নতুন কিছু সম্পর্ক। আর পুরনো সম্পর্কেরা হয় গভীর থেকে গভীরতর। এই পথ, এই পাহাড়, এই প্রকৃতির মাঝে এইভাবে সব ভুলে চলতে চলতে মনে হয়, নিত্য নতুন পথে, নতুন প্রত্যয় বুকে নিয়ে, বড়ো প্রিয়, পুরনো বন্ধুটির সঙ্গে, আজীবন হেঁটে চলার নামই তো জীবন। তাই অনেকক্ষণ বিশ্রামের পর আবার চলা শুরু হয়। বেশ খানিকটা সমতলের রাস্তা হেলে দুলে চলতে চলতে একের পর এক মনোমুগ্ধকর লেক শুরু হয়। আজকের রাস্তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। এইজন্যই বোধহয় সবাই বলে এই ট্রেকের সঙ্গে অন্য কোনো ট্রেকের তুলনা হয় না। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য মনকে পুলকিত করে। তাঁর চেয়ে বড়ো শিল্পী যে সত্যিই কেউ নেই, নব নব রূপে এই প্রত্যয় মনে দৃঢ় হয়। শ্রেষ্ঠ শিল্পীর তুলিতে আঁকা চিত্ররাজির সামনে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে তাই পূর্ণ সমর্পণের আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে জাগ্ৰত হয়।

চলতে চলতে হ্রদের পাশের পাথরে বসে আনমনে ভাবতে থাকি, বহুদিন ধরে এই পথে বহুবার কল্পনায় বিচরণ করেছি। এমনভাবে সেই কল্পনায় থাকা পথ আমাকে তার স্পর্শ দিয়ে আজ ধন্য করছে, আদৌ এই ট্রেক আমার দ্বারা সম্ভব হবে কি না সেই সংশয় প্রতিনিয়ত দ্বিধান্বিত করেছে। তাই একটি করে দিন পার করছি, নতুন কিছু সুন্দর দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছি, জীবন পাত্র কানায় কানায় ফেনিল উচ্ছ্বাসে ভরে যেতে দেখছি, আর ভাবছি জীবনে এই বুঝি তাঁর কাছে আত্মনিবেদনের শ্রেষ্ঠ সময়। গভীর উপলব্ধির জন্ম দেওয়ার মতো বিক্রমাদিত্যের পাথর যে ওখানে আরও অনেক ছিল, তা বহুদূরে লেকের কাছে একলা হয়ে বসে থাকা হিন্দোল, সিঞ্চন, বা দীপায়নকে দেখেও বুঝতে পারছিলাম। প্রকৃতির এমন অনির্বচনীয় রূপের সামনে নির্বাক, নিস্পন্দ, নীরব হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর হয়তো মানুষের কিছু করার থাকেনা। আমরা যে, কত ক্ষুদ্র কত তুচ্ছ সেই মহৎ অনুভবে দীক্ষিত হওয়ার জন্য বারবার তাই ফিরে যেতে হয় তার কাছে।

সহস্র তারায় ভূষিত আমার হোটেল। সাতসর ক্যাম্পসাইট।

খুবই কাছ থেকে দুটি লেক দেখে আবার কিছুটা চড়াই, কিছুটা নেমে আবার একটি অপরূপ লেক। লেকের নীল জল নীল দিগন্তে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সাতসারের সাতটি লেকের মধ্যে দুটি লেক শুকিয়ে গেছে। বাকি পাঁচটার মধ্যে তিনটি রাস্তাতেই পড়ে। আর সাতসার ক্যাম্পসাইট থেকে মিনিট পনেরো দূরে পাহাড়ের মাঝামাঝি বাকি দুটি লেক দেখতে যেতে হয়, সেগুলি ট্রেকের রাস্তায় পড়ে না। ক্যাম্পে পৌঁছে লাঞ্চের পর কয়েকজন দুটি লেক পরিক্রমার উদ্দেশ্যে এগোলেও আমরা কয়েকজন ক্যম্পেই রয়ে গেলাম। কিছুটা সেদিনের কুঁড়েমি আর কিছুটা পরের দিনের বোল্ডার অতিক্রম করে যাচ পাস (Zach) চড়ার টেনশনে পা-কে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। যদিও আমাদের থেকে যাওয়াটা সাংঘাতিক কিছু ঘটাতে চলেছে তখনও ভাবিনি। ট্রেকের অন্যতম সেরা সারপ্রাইজটা সামনে এলো ফুচকার বেশে। উচ্ছ্বাসে চক্ষু ছানাবড়া। এই উচ্চতায়, দুর্গম পাহাড়ে ট্রেক করতে এসে ফুচকা!! পশ্চিমবাংলা, উড়িষ্যা, বাংলাদেশ – সব এক টেন্টে বসে মনের আনন্দে এক বাটি পুদিনার জলে হাবুডুবু খেতে লাগলো। বহুকষ্টে, ভাগ করে খাওয়াই ধর্ম – এইসব বাণী দিয়ে সবাই সবার লোভ সামলে কিছু বাঁচিয়ে রাখা হল বাকীদের জন্য। তবু, যারা লেক ঘুরে কিছু পরে এসে পৌ‍ঁছাল, তারা নির্ঘাত ভাবছিল না জানি ভাগে কতগুলি কম পেলাম। সে রাতেও তারার দল আবার মুগ্ধ করে। শেষ পাতে গাজরের হালুয়া চেটেপুটে খেয়ে, পরের দিনের কঠিনতম পথের কথা চিন্তা করতে করতে শুয়ে পড়ি। অগণিত নক্ষত্র শোভিত আকাশের চাঁদোয়ার নীচে, পাহাড়ি নদীর কলধ্বনি, গাইডদের কাশ্মীরি ভাষায় গালগল্প, তাঁবুর বাইরে হ্রেষারব – নানাবিধ ধ্বনিতে আমোদিত সমগ্ৰ চরাচর ও রাত্রির আওয়াজ শুনতে শুনতে ক্লান্ত চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে।

সূর্য ওঠে এক নতুন দিনের সম্ভাবনা নিয়ে। আজ বোল্ডার জোন পার করা নিয়ে সকলেই কমবেশি চিন্তিত। আগের রাতে পাওয়া নির্দেশ মতো যে যার ব্যাগে স্টিক ঢুকিয়ে হাঁটা শুরু করি। নদী পার করার পরেই শুরু হয়ে যায় বোল্ডার জোন। কমবেশি বোল্ডার প্রায় রোজদিনই পেরোতে হলেও আজকের ব্যাপারটা অনেকখানি আলাদা। স্টিক নিয়ে এই রাস্তায় চলা মুশকিল। রাস্তা বলে আসলে কিছু নেই, শুধু বিভিন্ন আকারের পাথর। বেশিরভাগ জন লজ্জা না পেয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকি। অনেক পাথর পা রাখতেই টলমল করে, টিম লিডারের অভয় বাণীতে ভরসা রেখে এগোতে থাকি। দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়া নিষেধ, পিছনের জনের গতি ব্যাহত হতে পারে। তাই অনেক কষ্টে এগোতে এগোতে দম ফুরিয়ে এলেও কৌশল করে সকলকেই শ্বাস নেওয়ার সময়-সুযোগ বের করতে হয়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক এইভাবে এগোনোর পর বোঝা যায়, অন্যদিনের মতোই আজও আমাদের টিমের সার্বিক পারফরম্যান্স ভালো। সেই আনন্দে একটু বিশ্রাম নিয়ে জল, চকলেট খেয়ে সবাই পার করে ফেলি পুরো বোল্ডার জোন। বেশ খানিকটা বুগিয়াল ধরে হাঁটার পর যাচ (Zach) পাস চড়া শুরু হয়।

গ্লেসিয়ার থেকে গলে আসা হিমশীতল বারিধারা ও গঙ্গাবল লেক।

যতখানি কঠিন ভেবেছিলাম, ততখানি কঠিন লাগে না। হয়তো ঠিকঠাকভাবে সময়ের মধ্যে বোল্ডার পার করার আনন্দে কষ্টের ভার অনেকখানি লঘু হয়ে যায়। চলতে চলতে ট্রেকের শেষ পাস অতিক্রান্ত হয়ে যায় একসময়। পাসের উপরে জায়গা অন্যদিনের তুলনায় অপরিসর। দূরে দেখা যায় একজোড়া মনোমুগ্ধকর নীল হ্রদ। তার উপর ঘন নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত অজস্র সাদা মেঘের ঢেউ। বারবার তাদের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে গঙ্গাবল আর নন্দকোল লেক দুটি। গঙ্গাবল লেকটি এই ট্রেকরুটের বৃহত্তম লেক এবং একমাত্র লেক যেটার জলে নামার অনুমতি আছে। পাস থেকে নামা শুরু করে বুঝতে পারি আজকের নামাটা ওঠার থেকেও কঠিন লাগছে। খাড়াই পথ অতি সন্তর্পণে নামি। পায়ের তলায় ঝুরো পাথর, একটু গড়ালেই আছাড়। আর যখন তখন তারমধ্যে ঘোড়ার জন্য পথ ছেড়ে দিতে হয়। আর এদিকে প্রতি বাঁকে দুই লেকের অপরূপ হাতছানি। ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে যাই বারবার।

ছোটোবেলায় যতবার জ্যাক এ্যান্ড জিলের পাহাড় থেকে জল আনতে যাওয়ার কথা ভাবতাম, ততবার দাদুকে একই গল্প শোনাতে বলতাম – পাহাড় গুলো দেখতে কতটা উঁচু হয় আর ঝরনার জল খেতে কতখানি মিষ্টি হয়। আমার শৈশবে কল্পনাকে গল্প-কথায় উস্কে দেওয়া, অমৃতলোকে চলে যাওয়া দাদুর কথা মনে পড়ে পথের পাশে অসাধারণ এক ঝরনা দেখে। এমনিতেই এই কদিনে ঝরনার পাশ দিয়ে যেতে যেতে জল খেয়েছি অনেকবার। কিন্ত নামার সময় পথের ডানদিকের এই ঝরনার জলের স্বাদ এমন অতুলনীয় যে, মনে হয়, শৈশবের অপূর্ণ সাধ যেন এই অমৃতধারার স্পর্শে আজ পরিপূর্ণতা লাভ করলো।

অনেকখানি পথ নেমে সুন্দর এক ভ্যালিতে সবাই মিলে লাঞ্চ করতে বসি। আর একটা দিন, ট্রেক প্রায় শেষের দিকে। মন-মেজাজ বেশ ফুরফুরে সবার। হাসি-মজায় বেশ খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে গঙ্গাবলের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। নন্দকোলের রাস্তা থেকে একটু ঘুরে গঙ্গাবল দেখতে যেতে হয়। যেহেতু আমরা সময়ে পৌঁছে গেছি, তাই আমাদের গঙ্গাবল দেখে নন্দকোল ক্যাম্পসাইট যাওয়া স্থির হল। গঙ্গাবল পৌঁছনোর আগে ঢেউ খেলানো সবুজ উপত্যকা মনকে মোহিত করে দিল। এমনিতেই কাশ্মীরের সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে তার সবুজ অথবা শ্বেতশুভ্র উপত্যকার কথা সবার প্রথমে মনে আসে। এই ট্রেকে এসে সেই সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ রূপকে প্রত্যক্ষ করে হৃদয় ভালো লাগায় আপ্লুত হয়ে গেল। প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন রূপে নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি মনকে ভালোলাগার শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করালো। জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মিলিয়ে দিল এই পথ। কাশ্মীরের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট হরমুখের নিচে গ্লেসিয়ার পুষ্ট জলে তৈরি হয়েছে এখানকার বৃহত্তম হ্রদ গঙ্গাবলের। ডানদিকের আকাশে বেশ খানিকটা মেঘের উদয় হয়েছে।

যদিও আমরা নামবো বাঁদিকে। তাই বেশ খানিকটা সময় মাউন্ট হরমুখ দেখার আশায় অপেক্ষা করে নামা শুরু করলাম। ঠিক তখনই আকাশ সামান্য পরিষ্কার হয়ে হ্রদের জলে রংবদল দেখে মনে হল একমাত্র ঈশ্বরই পারেন তাঁর সুনিপুণ তুলিতে এই বিশাল ক্যানভাসে রংবাহার খেলিয়ে মানুষকে বিস্ময় বিমুগ্ধ করতে। ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে হাঁটা শুরু করি নন্দকোলের দিকে। চলতে চলতে নন্দকোল লেক যখন দৃশ্যগোচর হয়, কাকে ছেড়ে কাকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেব ভেবে আবারও অবাক হওয়ার পালা। এত সুন্দর নীল-সবুজ স্বচ্ছ জলের হ্রদ চোখে মায়ার পরশ বুলিয়ে দেয়। ওয়াসিমকে একলা হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত জলের দিকে চেয়ে থাকতে দেখি দুজনে। বুঝতে পারি সবাই নিজের অনুভবে প্রেম-প্রকৃতি ও ঈশ্বরকে মিলিয়ে নিয়ে কৃতজ্ঞতায় নতজানু হচ্ছে জীবনের প্রতি। পিছন থেকে না বলে সেই ছবি তোলার লোভ সামলানো যায় না। আজ ফটোগ্ৰাফাররাও পোজ দেবার মুডে। তাই আনাড়ি হাতে কিছু ছবিও তুলে ফেলি। অবশ্য কাশ্মীর এমনই জায়গা চতুর্দিক যার অপূর্ব সব ফ্রেম সাজানো। দূর থেকে নীচে দেখছি লেকের খুব কাছে বেশ কিছু টেন্ট ফেলা হয়েছে। যদিও আমাদের টেন্ট ফেলা হয়েছে বেশ খানিকটা দূরে নদীর গায়ে।

যাচ পাসের উপর থেকে দেখা গঙ্গাবল আর নন্দকোল লেক।

এখানে বলে রাখি গ্লেসিয়ার থেকে সৃষ্ট নন্দকোল লেক থেকে একটা খরস্রোতা নদীর জন্ম হয়েছে। হেলেদুলে নামতে নামতে দূর থেকে চোখে পড়ে সবাই সরু একটা কাঠের গুঁড়ির উপর দিয়ে নদী পার হচ্ছে। ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। হামতা পাসের কথা মনে পড়ে যায়। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাই। ও পাড়ে পৌঁছে যাওয়া গ্ৰুপ মেম্বারদের উৎসাহে মনোবল বাড়িয়ে মনে মনে ঈশ্বরকে ডেকে উত্তাল নদীটা পার হয়ে যাই। আমাদের টেন্টে পৌঁছাতে একটু উপরে উঠতে হয়। আরও অনেক টেন্ট রয়েছে আশেপাশে। ঝকঝকে আকাশ, পাশেই উচ্ছল নদী। অনেকেই আনন্দে স্নান করছে দেখে আমরাও ভালো করে হাত-পা ভিজিয়ে নিই। মায়ের দেওয়া নারকেল নাড়ু আর মুড়ি-চানাচুর সবাই মিলে পরিতৃপ্তি করে খাই।

সন্ধের আগেই আকাশ বদলে যায়। ধীরে ধীরে ঘন কালো মেঘ নেমে এসে দিগন্ত ছুঁয়ে দেয়। শুরু হয় ঝমঝমে বৃষ্টি। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির অভিজ্ঞতা এই পথে কমবেশি হওয়ায় প্রথমে সেভাবে কেউ চিন্তিত হই না। কিন্তু ঘন্টা-দুয়েক একটানা মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে। সকলে ডাইনিং-টেন্টে অন্ধকারে বসে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনি। বেশ ঠান্ডা লাগে। হঠাৎই টের পাই তাঁবুর নীচ দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে এলোপাথাড়ি হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে তাঁবু। সকলে একমনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করতে থাকি। এর মধ্যে সিঞ্চন বলে ওঠে, সারারাত এই বৃষ্টি চললে কি হবে কে জানে। ভেবেই আতঙ্কে হাড় হিম হয়ে যায়। পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষের ভাবনার গতিপথ কি ভাবে আমূল পরিবর্তিত হয় সেই মুহূর্তে তা টের পাই। লেকের পাড়ে যে তাঁবুগুলোকে দেখে ঈর্ষার উদ্রেক হয়েছিল, তাদের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা অনুভব করি। ভারী বৃষ্টিতে লেক বা নদীতে জল বেড়ে গেলে কি বিপদ হতে পারে তা ওখানে কারোরই অজানা ছিল না। ছোটো থেকে বাড়িতে বা বন্ধুমহলে সবচেয়ে ভীতু বলে পরিচিত আমার মনের অবস্থা ঐ পরিস্থিতিতে কেমন হয় তা সহজেই অনুমেয়। অনেকখানি বিস্ময় তখনও অপেক্ষা করে। ওই ঘন অন্ধকারে, ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে আমরা যখন প্রহর গুনছি, তখনও একইরকম উজ্জ্বল হাসি মুখে নিয়ে ছাতা হাতে কাকা এসে জানায়, ‘ডিনার রেডি হ্যায়’।

একটু বিশ্রাম নন্দকোল লেকের কাছে।

আদৌ বৃষ্টি থামবে কি না, না থামলে কী কী হতে পারে সেইসব ভয়াবহ আলোচনার মাঝে খাবারের জন্য এই ডাক যেন সম্বিৎ ফিরিয়ে দেয়। যেন ওই হাসি মুখের আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি-মা সস্নেহে মনে করিয়ে দেন – সব স্বাভাবিক আছে। শুধু ভাত-রুটি-সবজি নয়, পরম যত্নে শেষদিনের ক্যাম্পসাইটে নিজের হাতে সুজির কেক বানিয়ে আমাদের খাওয়ায় ক্লাস টেনে পড়া সেই ঝকঝকে কিশোর। ছোট্ট তেহজীবকে দিয়ে সেই কেক কাটা হয়। আজ আমাদের এই ট্রেকের শেষ ক্যাম্পসাইট। মাত্র ছয়দিনে কীভাবে সকলের মধ্যে গভীর আত্মিক যোগ স্থাপিত হয়েছে, তা বলার নয়। সকলের সম্মিলিত প্রার্থনায় ঈশ্বর সাড়া দেন। যে বৃষ্টিকে সঙ্গী করে, একরাশ অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে সকলে শুতে যাই, যে বৃষ্টির আওয়াজ ও কয়েক হাত দূরের উত্তাল নদীর গর্জন শুনতে শুনতে চোখ বুজি, সেই রাত শেষ হয় ঝকঝকে তারা-ভরা এক ভোর দিয়ে। যে হরমুখ পর্বতশৃঙ্গ কাল অনেক অপেক্ষার পরেও মেঘে ঢাকা ছিল, আজ তার উপর গলানো সোনার রঙের সূর্যকিরণ আমাদের অভিভূত করে। তমোঘ্নর তৎপরতায় দ্রুত তৈরি হয়ে আমরা সব টিমের আগে চলা শুরু করি। আজ সুদীর্ঘ পথ নীচে নেমে নারানাগ পৌঁছাতে হবে। ঘোড়ার পায়ে পায়ে পথের কাদা বেড়ে যাওয়ার আগেই তাই আমরা তাড়াতাড়ি রওনা দিই। একটু চড়াই উঠে দেখি পুব আকাশে লাল হয়ে সূর্য উঠেছে।

গঙ্গাবল লেক

জীবনের কোনো বড়ো বাধা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আসা সুখের মতোই সেই সূর্যের আলো নরম, সুগন্ধী উষ্ণতায় স্বাগতম জানায় আমাদের প্রত্যেককে। পথের কাদায় সেই উত্তাপের ছোঁয়া যেন আমাদের বুঝিয়ে দেয়, এভাবেই পায়ের তলার জমিকে নরম করে আমাদের কষ্ট লাঘব করার জন্যই প্রকৃতি-মা কাল রাতের এত আয়োজন সাজিয়েছিলেন। ক্ষুদ্র মানুষ আমরা, চর্মচক্ষে সামনে যতটুকু ভালো-মন্দ দেখি, তাই নিয়ে সুখ-দুঃখের হিসেব কষি। তাঁর লীলা, বিশ্বপ্রকৃতি জুড়ে সুগভীর পটপরিবর্তন কোন বৃহত্তর ভালো-মন্দের দ্যোতনায় বিন্যস্ত, তাকে উপলব্ধি করার সাধ্য কি আমাদের আছে! তাই, এরপরের নদী পার হওয়া, আর্মি ক্যাম্পে হাজিরা, ধাবায় চা-ম্যাগি খাওয়া, নারানাগ পৌঁছানো, আপেল বাগান পরিক্রমা, জনবহুল শ্রীনগর, মুঘল দরবার, ওয়াজওয়ান, ডাল-লেক, কাশ্মীরি বন্ধু, এয়ারপোর্ট, বাড়ি, অফিস – সমস্তকিছু আমার হয়ে আমার অবশ আচ্ছন্ন ভিন্ন এক সত্তা সমাপন করে । আর আমি শুধু এক সমুদ্র-হৃদয় মুগ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা নিয়ে ওখানেই থেকে যাই। ঐ সবুজ পাহাড়, ঐ উচ্ছল নদী, ঐ ঢেউ খেলে যাওয়া উপত্যকার প্রান্তে পাইন বনের সারি, ঐ সোনালী সূর্যোদয়, ঐ ঘন নিবিড় মেঘের দল, ঐ ঝমঝমে বৃষ্টি – এই সবকিছুর স্পর্শে আমাকে আজন্ম ঋণী করা আমার প্রকৃতি-মায়ের কোল আমাকে আর ফিরতে দেয় না। আমি সেই অপার স্নেহধারায় ভিজতে ভিজতে পাশ ফিরি আর মুহুর্মুহু নতজানু হই।

প্রয়োজনীয় তথ্য

  • ট্রেকটি করার জন্য মাঝারি মানের সক্ষমতা প্রয়োজন।
  • অতি অবশ্যই বাফার ডে রাখতে হবে।
  • এই রুটে অভিজ্ঞতা আছে এরকম ট্রেক লিডার সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে। আমাদের ক্ষেত্রে তমোঘ্ন ঘোষ ছিলেন ট্রেক লিডার।
  • জুলাইয়ের শুরু থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত যাওয়া যায়। তবে মোটামুটি ভাবে আগষ্ট মাস সবথেকে ভালো মনে করা হয়। আমাদের তারিখ ছিল আগষ্টের ১৪-২১, ২০২২।
ট্রেকের সময়কাল আগস্ট মাসের ১৪ থেকে ২১, ২০২২
ছবি ঋণ : Avijit Goldar
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ KashmirkglTrekking