জল ও জঙ্গলের কাব্য

ছোট ঘটনাটি নিয়ে মুনিয়ার সঙ্গে লেগে গেল। আমি বললাম, বর্ষাতেই জঙ্গলবাড়ি যাওয়ার সেরা সময়। সে গা করছে না। উল্টো বলছে, ঘরেই খিচুড়ি করে দেবে। মেজাজ না খিঁচড়ে যায়? জঙ্গলবাড়িটা বেলাই বিলের ওপরে। কামাল ভাই খুব সাধ করে গড়ে তুলেছেন। বাঁশ-খড়ের সব ঘর। ঘরের তলায় পানি ছলছল করে। শ্যাওড়া গাছ আছে তাই পেত্নী থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিলে মাছও আছে তাই ভূতও থাকতে পারে। মুনিয়াকে বের করতে পারছি না। আমি তাই আগেরবারের স্মৃতির বাড়ি চলে গেলাম।

ভরা বর্ষা ছিল। আমি সদর দরজায় ঘা দিয়েছিলাম দুপুর ১২টা নাগাদ। টিনের দরজার মাথার ওপর একটা দড়ি ছিল। তা দিয়ে দিলে টান ভেতরে কোথাও ঘণ্টা বাজে। প্রথমে দূর থেকে একজন বলে, আসিইইইই…। তারপর কাছে এসে জানতে চাইল কাকে চাইছেন? আমি বললাম, কামাল ভাই আছেন? দরজা খুললে পাই মোড়াম বিছানো রাস্তা। দু’ধারে গাছের সারি। শত গজ হেঁটে যাওয়ার পর দেখি পুকুর। বেশ কয়েকজন মিলে কচুরিপানা সাফ করতে লেগেছে। কামাল ভাইকে আমি দেখিনি। খালি গায়ের ফর্সা একজন উঠে এসে বললেন, আমি কামাল। আমি বললাম, মাহবুব টিপু আপনার নাম বলেছে। তিনি মনে করতে পারলেন এবং জঙ্গলবাড়ির সব দরজা আমার জন্য খোলা হয়ে গেল। জল জঙ্গলের পোশাকি নাম ‘জল জঙ্গলের কাব্য’। জাম্বুরা, লিচু, কদমসহ অনেক গাছ আছে বাড়িটায়। আম গাছ তো আছেই। কয়েক একর জায়গাজুড়ে এ বাড়ি। একটা অংশ শুধু বন্য প্রাণীদের জন্য। শেয়াল, বনবিড়াল আছে। পাখিও আছে অনেকরকম। পুকুরের ধার ঘেঁষে গিয়ে ধ্যানমঞ্চে বসলাম। মঞ্চের পাটাতন কাঠের আর ছাউনি খড়ের। আশপাশে অনেকরকম বুনো গাছ-গাছালি। ফার্নগুলো দেখলে চেনা যায়, অন্যগুলো দেখেছি দেখেছি লাগে কিন্তু চেনা হয়ে ওঠে না। ধ্যানমঞ্চ থেকে খাবার ঘরের পাশ দিয়ে গেলাম বিলের পাড় পর্যন্ত। বিলের ওপর ঘরটা খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম বিদ্যা ভাইকে। বিদ্যা ভাই অনুমতি আনতে গেলেন কামাল ভাইয়ের।

এই ফাঁকে তালগাছ দিয়ে গড়া বেঞ্চিতে বসে পানি দেখতে থাকলাম। এখানে পানি স্বচ্ছ, কাকচক্ষুরূপ। পানিতে হেলেঞ্চা বিছানো। আমি দূরের তালগাছওয়ালা গ্রাম দেখি। ডানে দেখি পুবাইল ব্রিজ আর বাম দিকটা একদম ফাঁকা। বিদ্যা ভাই অনুমতি পেয়েছে। বাঁশ-বেড়ার মাচাঙ ঘরের ঝাঁপ খুলে দিল। ভেতরে আসবাব সব আধুনিক। বিলের দিকে ঝাঁপ খুলে দিতে একঝাঁক বাতাস এলো। আমি জুড়িয়ে গেলাম। ব্যাগপত্র রেখে নেমে গেলাম বিলে। ছিমছাম সাঁতার কেটে দ্বীপটায় গিয়ে উঠলাম। সেখানে একটা ডোঙা নাও ভেড়ানো ছিল। নাওটা সরু। তাল সামলানো যায় না। দু’বার পড়লাম পানিতে।

ঘণ্টাখানেক পানির সঙ্গে থাকাথাকি করে উঠে এলাম ডাঙায়। বিদ্যা ভাই জানালেন, খেতে বসব। আমি কাপড় পাল্টে খাবার ঘরে যাই। লাল চালের ভাত আর মেনি মাছ। শাক আর ডালও ছিল। নিজের বাড়ি লাগল সব মিলিয়ে। খাওয়া শেষ হলে বিল-ঘরের বিছানায় গা পেতে দিলাম। বাতাস বইল সুনসান। অমিতাভ ঘোষের হাংরি টাইড বইটা নিয়ে গিয়েছিলাম। পড়লাম দুই পৃষ্ঠা। তারপর ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।

বিকেলে উঠে দেখি নরম লাল আলো লুকোচুরি খেলছে হিজল গাছের পাতায়। আমি হেঁটে হেঁটে কাঠের সিঁড়িটায় গিয়ে বসলাম। পানিতেও আলোর ঝিলিমিলি। আমি বাকহারা। দেখতে দেখতে বিকেল গড়াল। সন্ধ্যাও নামল। আমি উঠলাম না। ঠায় চেয়ে রইলাম সম্মুখে নয়ন ঢেলে। বিদ্যা ভাই এসে না ডাকলে হয়তো রাত করে ফেলতাম। তিনি মুড়িমাখা খেতে ডাকলেন।

জল জঙ্গলে তখন থোকা থোকা অন্ধকার। আমি বুনো ঝোপে অন্ধকার হাতড়ে বেড়াই। জোনাকিও নেচে বেড়াচ্ছে ইতি-উতি। আমার অজ্ঞান হওয়া বাকি থাকে। মুড়ি খেয়ে নিয়ে হুশ ফিরিয়ে আনি। রাতটা এখানে নিঝুম, ঘোর ঘুট্টি। সব ছিমছাম। একলা হয়ে যাওয়ার জন্য এ মতো জায়গা আর পাইনি আমি। রাত আরও গভীর হলে সব চুপ মেরে যায়। আমি শ্যাওড়ার কোলে গিয়ে বসি। মাঝে মধ্যে অচিন পাখি ডাক ছেড়ে চলে যায়। রয়ে যায় রেশ।

Leave a Comment
Share