২-১২-২০১২
সকাল ১২:৩০ এর ট্রেন। ব্যাকপ্যাক কাধে আর হাতে টিকিট নিয়ে প্লাটফর্মে দাড়িয়ে আছি। বসার কোন স্থান নেই। মানুষ আর মানুষ। হেলে দুলে ট্রনটা আসলো ১২:৪০ এ।ঠেলে ঠুলে উঠে বসলাম নির্দিষ্ট সিটে। ট্রেনের নাম “আস্রম এক্সপ্রেস”। এটা মনে হয় এহমেদাবাদ পর্যন্ত যায়। আমি নেমে যাবো জয়পুরে। দিল্লী শহরটাকে পেছনে ফেলে আমাদের ট্রেন এগিয়ে চলল। ধীরে ধীরে ব্যস্ত, নোংরা শহুরে পথঘাট ফেলে আমরা পাহাড়ি রেল ট্রেকে চলতে লাগলাম।
ট্রেনের ভেতর বিশেষ করার কিছু নেই। আমি ভারতের নই বাইরের ছেলে বুঝে সহ যাত্রিরা গল্প করতে এগিয়ে এলো, গল্প , চা আর জানালা দিয়ে বাইরে দেখা চলতে লাগলো। জয়পুরে যখন এলাম তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত। ট্রেন আনেক লেট। ষ্টেশন থেকে নেমেই হাটা শুরু করলাম। একটা মোড়ে এসে মনে হলো রাস্তা ভুল করলাম কিনা। গত বছরইতো এলাম এখানে, তখন তো এত্ত বিশাল ফ্লাইওভার ছিলনা। যা হোক, একটু এগুতেই পেলাম হোটেল কান্তিচন্দ্র প্ল্যালেস। গত বছর এখানেই উঠেছিলাম। দারুন একটা হোটেল। কম খরচ আর সামনে মনরম একটা বাগান। হোটেলটার এত্ত তারিফ করলাম কিন্তু সেদিন ওই হোটেলে থাকতে পারিনি। কি নাকি “আরসি” নাই বাংলাদেশী রাখা যাবেনা। এত্ত বুঝালাম যে গত বছর এখানেই ছিলাম , লাভ হলো না। অতপর আবার হোটেল খোজায় লেগে গেলাম। হাটতে হাটতে হটাত নতুন হওয়া ফ্লাই ওভার ব্রিজের পাশেই পেয়ে গেলাম একটা হোটেল। কাগজ পত্রের ঝামেলাই গেলনা, সোজা রুমের চাবি ধরিয়ে দিল। রুমে গিয়ে ঘুম। না গোসল করলাম, না কাপড় ছাড়লাম। সোজা ধপাস করে ঘুম। গত কয়দিনের ভ্রমণ, দৌড়া দুড়িতে ভালই ক্লান্ত ছিলাম।
নোটঃ আমি আমার ভারত ভ্রমণের গল্প পর্ব পর্ব করে লিখে যাচ্ছি। প্রথম পর্বে লিখেছিলাম কলকাতা নিয়ে , দ্বীতীয় পর্বে লিখেছিলাম দিল্লী নিয়ে। তৃতীয় পর্বে আগ্রা নিয়ে লিখেছিলাম , পড়তে চাইলে এখানে দেখতে পারেন। আমার প্রতিটা পর্বেই আমি বাজেট, খরচ, হোটেল ভাড়া ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি যাতে পরবর্তিতে পাঠকরা ভারত গেলে সব প্ল্যান করে যেতে পারে।
দিল্লি থেকে জয়পুর প্রতিদিন ট্রেন এবং বাস যায়। ট্রেন ভাড়া ১২০-৫৫০ রুপি ( ক্লাস অনুযায়ী ) । বাস ১২০-৩০০ এসি –ননএসি।
হোটেল পাবেন সিংগেল বেড ৩০০-৫০০ রুপির মধ্যে। আমি “হোটেল অসোকে” উঠেছিলাম যেটা মুল শহর থেকে একটু দুরে তাই ভাড়া পরেছিল ২৫০ রুপি আর কোন কাগজ পত্রের ঝামেলা করেনি, খালি পাসপোর্ট এর ফটোকপি নিয়ে নিয়েছিল।
৩/১২/২০১২
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো গাড়ির সা সা চলার আওয়াজে। বিছানায় ঝিম মেরে বসে চিন্তা করতে লাগলাম কোথায় আছি? আস্তে আস্তে মাথায় আসলো আমি গতকাল জয়পুরের ফ্লাইওভারের পাশে একটা হোটেলে উঠছি। ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম। প্রায় ৭টা। তাড়াতাড়ি দাত মাজতে মাজতে জামা কাপড় পাল্টে নিচে নামলাম। আজকের প্রথম মিশন ছিল সাইট সিইং এর বাসের টিকিট কেটে জয়পুর এ ঘুরা। কিন্তু এখন মিশনের লিস্টে খাবারটা আগে চলে আসলো। রাতে কিছু খাইনি। তাই খাবারের সন্ধানে বের হলাম। হোটেলের আশপাশে কিছু পেলামনা। সব বন্ধ । হাটতে হাটতে সেন্ট্রাল বাস ষ্টেশন চলে আসলাম। কিচ্ছু নেই। একটা দোকানে দেখলাম সিংগারা, সমুছা বিক্রি করতেছে। কিনলাম ২টা। মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিলাম। মিষ্টি মিষ্টি। সমুছা যে মিষ্টি হতে পারে ভাবিনি। অন্যটা টেবিলে রেখে ভাগলাম ওখান থেকে। নাস্তা শেষমেষ স্ট্রিট ফুড দিয়েই সারলাম। একটা বিশাল ঝাল পুয়া আর ভেলপুরী দিয়ে। ভেল পুরিটাই সবচেয়ে ভাল লাগছে। সবজি , চানাচুর , টমেটো আরো কত কি। অসাধারণ ছিল। এ জিনিস বার বার খাওয়া যায়।
খাওয়া শেষ এখন শহরটা ঘুরে দেখতে হয়। আর জয়পুর এমন একটা সিটি যেখানে প্রতি ২ কি:মি: তে ৪টা দেখার মত জিনিস আছে। আমি আর দশটা সাধারণ টুরিস্টের মত সিটি ট্যুর বাস খুজতে লাগলাম। একটা ডাবল টেকার ( দুই তলা ) বাসের টিকিট কাটলাম। অনেক দামা দামি করে মাত্র ১৫০ টাকায় নিলাম টিকিট। বাসের উপরে উঠে বসে পরলাম। ছাদ খোলা বাস।
বাস ছাড়লো প্রায় ১০:৩০ এর দিকে। প্রথমেই গেল একটা খুব সুন্দর মন্দিরে। মন্দিরটায় অনেক নিয়ম। ছবি তোলা যাবেনা, গাড়ি পার্কিং করা যাবেনা, জুতা জমা করতে হবে, জোরে কথা বলা যাবেনো। তাই বাইরে থেকে ফটো তুলে ক্যামেরাটা ব্যাগে রেখে ভেতরটা ঘুরলাম। খুব সুন্দর শ্বেত পাথরের মন্দির।
নিজের বাসটা খুজে নিয়ে উঠে বসলাম আবার । নতুন কিছু দেখার জন্য। এবার গাইড বকর বকর শুরু করলো। হিস্টোরি বলতে লাগলো , জোক করে হাসাতে লাগলো আমাদের। আমার এর পর গেলাম একটা মিউজিয়ামে। সরকারি মিউজিয়াম। আলবার্ট হল। আমার জীবনে সামনা সামনি প্রথম “মমি” দেখা। টিভিতে ফিল্ম আর ডকুমেন্টারি দেখে অনেক আগ্রহ ছিল এ জিনিস সামনা সামনি দেখা। কোন এক ইজিপ্টশিয়ান মমি এটা। পাশেই ইজিপ্টশিয়ান একটা মুর্তিও ছিল।পরিবেশটাও ছিল কেমন কেমন যানি। যদিও একটা প্রফাইল পিক তুলার মত কাউরে পাইলামনা যে আমার একটা ছবি তুলে দেবে … তাই গ্লাসে আমার রিফ্লেক্ট সহ মমির সাথে একটা ছবি তুলেই শান্ত হইলাম। :D
পুরা মিউজিয়ামটাই পুরান জিনিস পত্রে ভর্তি। আর আলবার্ট হল বিল্ডিংটার একটা নিজস্বতা আছে। পুরানো সুন্দর একটা বিল্ডিং। মিউজিয়ামটায় প্রচুর দেখার জিনিস। কিন্তু সময় কম তাই দ্রুত দেখে চলে আসলাম আবার বাসে। বাস আবার চলতে শুরু করলো। এবার জন্তরমন্তর । এখানে পুরাটাই সাইন্স এর যন্তপাতি। এস্ট্রোনমিকাল জিনিস পত্র। আমরা বর্তমানে অধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করে গ্রহ – নক্ষত্রের অবস্থান জানার জন্য। কিন্তু আগের যুগে ওরা এসব বিশাল বিশাল যন্ত্র দিয়ে এসব নির্ণয় করতো।
জন্তর মন্তর এর পাশেই সিটি প্যালেস। দ্রত দেখে ফেল্লাম। কারণ বাস থেকে সময় বেধে দিয়েছিল। এরপর আমরা রওনা দিলাম অমির ফোর্ট দেখার জন্য। পথে টুরবাস শপিং এবং খাওয়াদাওয়া সারার জন্য দাড়ালো। খেয়ে নিলাম। পাশেই রাস্তার ও পাশ থেকে জলমহল দেখা যায়। শান্ত লেক , পেছনে পাহাড় আর মাঝখানে এই মহল। চটপট কিছু ছবি তুলে ফেললাম।
পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে বাস আমীর ফোর্টের নিচে এসে বাস থামলো। আমীর ফোর্টে দুই ভাবে যাওয়া যায় .. এক. জিপ ভাড়া করে। দুই হেটে হেটে হাইকিং করে। আমার হাইকিং এ আগ্রহ ছিল কিন্তু গাইড বেশি সময় দিলনা। তাই হেটে গেলে কিছুই দেখবোনা। তাই জিপে রওনা দিলাম।
দুর্গটা এত্ত বড় যে রোকে বলে পুরা ফোর্ট ভালোভাবে দেখতে নাকি ২ দিন লাগে। আর গাইড বেটা আমাদের সময় দিল মাত্র ঘন্টা খানেক। ফোর্ট বা দুর্গটা যে বিশাল তার প্রমান পেলাম পথ হারিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে কোথাই যে চলে এলাম আর বের হতে পারিনা অলি – গলি দিয়ে প্রায় এক ঘন্টা ঘুরার পর আবার ফেরার রাস্তাটা পায়। ততক্ষনে আমার অবস্থা খারাপ। শুধু আমিনা অনেকেই এ সমস্যায় পড়ে আমীর ফোর্টে গেলে। তবে ফোর্টটা অসাধারণ। পোর্টের ভেতরে মন্দির , মসজিদ , সিসা/আয়না মহল , কুপ , অ্যালি , সৈন্য টাওয়ার , গ্রেট ওয়াল আব চায়নার আদলে ছোট একটা দেওয়াল আছে। নিচে কিছু ছবি দিলাম।
দুর্গ দেখা শেষ। ক্লান্ত আমি ঘুরতে ঘুরতে। আবার বাস যাত্রা।এবার নাকি যাবে পিংক সিটি যেটা দেখার জন্য প্রচুর মানুষ আসে এই জয়পুরে। পিংক সিটি হলো ৯ কি:মি লম্বা একটা শহর। যার বাম পাশে যেরকম বাড়ি , দোকান , মসজিদ , মন্দির আছে তার ঠিক উল্টা পাশে ডান পাশেও একই রকম বাড়ি , দোকান , মসজিদ আর মন্দির আছে। আর হা অবশ্যই সব পিংক কালারের। এই সিটিতে ডুকার অনেক গুলা গেট। বেশি ছবি তুলতে পারিনি। কারন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল আর গাড়ি দাড়ায়নি তেমন কোথাও … শুধু সিটির মধ্যে দিয়ে চলল।
রাতে হোটেলে ফিরলাম। থালি সিস্টেমে ভাত খেলাম। এক থালি ১০০ রুপি। আনলিমিটেড রুটি আর সবজি। ভাত , ডাল , তরকারি কিন্তু লিমিট। খেয়ে হোটেলে ঘুমাতে গেলাম। আগামীকাল একটা লোকাল ট্রেকিং গ্রুপের সাথে মিট হবে। তাদের সাথে একটা ক্যাম্পিং এবং হাইকিং এও যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সেই সব গল্প পড়ে বলবো।
নোটঃ জয়পুর পুরাই টুরিস্ট এরিয়া। তাই আপনি টুরিস্ট বুঝলে আপনার থেকে সবকিছু দাম বেশি চাইবে। দামাদামি করুন। সাইট সিইং যদি ধীরে সুস্তে করতে চাইলে ক্যাব বা অটো ভাড়া করুন। কিন্তু খরচ বেশি পড়বে। আর মোটামুটি সব দেখতে চাইলে টুরিস্ট বাসের টিকিট কাটুন। ডাবল টেকার ১৫০ রুপি নেবে আর এমনি বাস ১০০ এর মত। বাস সকাল ১০:৩০ এর মধ্যে ছেড়ে যায়।
Leave a Comment