মানচিত্রের বাইরে পা – একটি ভ্রমণ কাহিনী

ভারত – পাকিস্তান শব্দ দুটো আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে, ছেলেবেলা থেকে বইয়ের পাতায় পাতায় এই শব্দ দুটোর অবিরাম পদচারণায় ভাবতে বাধ্য হয়েছিলাম দেশদুটোর সংস্কৃতি আর ইতিহাস নিয়ে, নিজের চোখে পরখ করতে চেয়েছিলাম তাদের মানুষের জীবনমান, প্রানের স্পন্দন।

আস্তে আস্তে বড় হতে থাকি আর স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের সুবাধে তাদের চলচ্চিত্র, সংবাদ পরিবেশন – এসবের সাথে পরিচিত হতে শুরু করি। একটা সময় নিজের অবচেতন মন চলে যায় দেশ দুটোতে, কিন্তু এই বাস্তব রক্ত মাংসের সত্বাকে তো আর ভিসা,পাসপোর্ট ছাড়া ঢুকতে দিবে না তাদের সীমান্ত রক্ষিরা। তাই পাসপোর্ট করার পালা।

যেদিন পাসপোর্ট টা প্রথম হাতে পেলাম, সেদিন থেকেই ব্ল্যাংক পেজগুলো দেখে বিরক্ত হচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম পাকিস্তান তো আকাশপথ ছাড়া যাওয়ার কোন উপায় নেই তবে ভারতে যাওয়া তো তুলনামূলক সহজসাধ্য একটা বিষয় । তাই সহসা একদিন ভারতীয় ভিসার জন্য এপ্লাই করে ফেললাম, ভিসার স্টিকার টাও লেগে গেল, এখন আর তর সইছে না।

যা হোক, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমি আর আমার সাথে দুই জন সফরসঙ্গী নিয়ে বাংলাদেশের যশোর জেলার উদ্দেশ্যে বাসে উঠে বসি। সারারাত বাস জারনি করে শেষ রাতে যশোর এসে নেমে যাই, শীতের রাত, কনকনে ঠান্ডা, কিন্তু উত্তেজনায় ঠান্ডাকে পাত্তা দিচ্ছে না দেহ-মন দুটোই । এরপর বাংলাদেশের ব্যস্ততম স্থলবন্দর বেনাপোলের উদ্দেশ্যে বাসে চড়ি, দূরত্ব বেশি নয়, তবুও মন যেনো রকেটের গতিতে ছুটে চলে যেতে চায়, কিন্তু মনের গতির সাথে বাস পাল্লা দিয়ে পারছে না। তাই এক কিলোমিটার পর পর দেখি আর কতক্ষণ। এদিকে, ঝিকরগাছা এসে এক মেয়ে নামবে, আমার মনে মনে বিরক্ত লাগছে, এখানেও আবার নামতে হয়, আরো ৫ মিনিট লস, বেনাপোল কখন যাবো! আমি উত্তেজনায় এতটা স্বারথপর হয়ে গিয়েছিলাম যে, বাসের সবাইকেই একরকম জোড় করেই যেনো বেনাপোল নিয়ে যাবো, কারো বাড়ি যে পথিমধ্যে পড়তে পারে, তা আমার পাগল মন বুঝতে অপারগ ছিল।

সকাল ছয়টার দিকে বেনাপোল এসে নামলাম, আমাদের বাসের সামনে আগরতলা থেকে কলকাতাগামী যাত্রী নিয়ে বিআরটিসির আরেকটি বাস অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করছে বর্ডার ক্রস করতে। আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, তাই এক এজেন্টের দোকানে গিয়ে সংগে থাকা ব্যাগগুলো রেখে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিলাম, আর আমাদের পাসপোর্টগুলো সেই এজেন্টকে দিয়ে দিলাম ডিপারচার সিল মেরে আনার জন্য, সাথে কিছু খরচাপাতি, এটাই এখানকার সিস্টেম – তবে আন-অফিসিয়ালি ।

অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে এলো, পাসপোর্ট ফেরত পেলাম ডিপারচার সিল সহ। আমাদের সাথে ভ্রমন সংগীটির হাতে নীল পাসপোর্ট, তাই তাকে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হবে তাই আমাকে একাই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে ভারতে ঢুকে যেতে বললো। আমি বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পার হয়ে জিরো পয়েন্টে লাইনে দাড়িয়ে আছি, আস্তে আস্তে জিরো পয়েন্ট অতিক্রম করে ভারতের হরিদাসপুর ঢুকে গেলাম, প্রথমবার বিদেশের মাটিতে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ক্রস করবো, আর এনডোরস এর বাইরেও কিছু ইউরো আছে পকেটে, তাই একটু নারভাস ছিলাম। ইমিগ্রেশন অফিসে ঢুকতেই আমার বড় ট্র‍্যাভেল ব্যাগটি স্ক্যানার মেশিনে ঢুকিয়ে দিলো, আস্তে আস্তে অপ্রান্ত দিয়ে বেড়িয়ে এল। আমি ব্যাগটি সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন অফিস্যারের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সকল অফিসিয়াল ফরমালিটিস সম্পন্ন করে পরমকরুনাময়ের নাম জপে ভারতের মাটিতে পা দিলাম।

প্রথমবার ভারতের মাটিতে পা ফেলেই ভারতীয় বাংগালদের ব্যাপারে খুবই বাজে ধারনা হলো। বলে রাখা ভালো, বেনাপোল-হরিদাসপুর বর্ডার দালাল আর বাটপারে ঠাসা। আপনি বোঝার আগেই আপনার হাত থেকে পাসপোর্ট ছো মেরে নিয়ে নিবে আর আপনাকে অপেক্ষাকৃত কম রেইটে ডলার ভাংগিয়ে দিবে, চড়া দামে সিম কার্ড ও ট্যাক্সি ভাড়া করে দিতে চাইবে। মোটকথা এরা আপনাকে বোকা বানিয়ে দু চার পয়সা রোজগার করবে। আমিও ভিকটিম হতে যাচ্ছিলাম তবে আমার পাসপোর্ট টা আমি ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম, তাই চাইলেও আমার পাসপোর্ট টা নিতে পারেনি। তবে দালালরা মৌমাছির মত ঘিরে ধরে। কোন উপায় খুজে না পেয়ে আমি তাদেরকে বলি যে, কলকাতা থেকে আমার এক ভাই আমাকে নিতে আসবে আর আমার সাথে কোন ডলার নেই, এরপর এদের হাত থেকে রেহাই পাই।তারপর, নিজে বিভিন্ন কাউন্টারে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার এক্সচেঞ্জ রেট কত তার খোজ নেই এবং রেট ভালো থাকায় গ্রিণ লাইনের কাউন্টারে কিছু ইউরো ভাংগিয়ে রুপি নেই, কড়কড়া পরিচ্ছন্ন নোট, মহাত্মা গান্ধীর ছবি সম্বলিত।

তখনো বাংলাদেশের গ্রামীনফোনের নেটওয়ার্ক কাজ করছিল, তাই বাসায় ফোন দিয়ে জানিয়ে দেই আমার অবস্থান আর বাকি দুজন সফরসঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দুঃখের বিষয়, তারা দালালের খপ্পরে পড়ে গিয়েছিল, কিছুটা লস খেয়েছে, তাই রাগের মাথায় বলে ফেললো আজই দেশে ফিরে যাবো আর এখান থেকেই। আমি বললাম,তুমি তো আমাকে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে একটা ফোন দিতে পারতে। যা হোক, এতক্ষণে আমার উপরেও রেগে গিয়েছে। কি আর করা, বোঝাতে লাগলাম যে, ভারতে যখন এসে পড়েছি, ঘুরাঘুরি না করে দেশে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না।

অবশেষে আমার সঙ্গীদের মাথা ঠান্ডা হল। ছোট একটা খুপরি দোকানে নাস্তা করলাম এক ভারতীয় বাংগালি দিদির হাতে তৈরী অপরিচিত কিছু আইটেম দিয়ে। এরপর প্রাইভেটকার ভাড়া করে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। হরিদাসপুর বর্ডার এড়িয়া পার হয়ে আমরা সেই বিখ্যাত যশোর রোড দিয়ে ছুটে চলেছি কলকাতার দিকে, হঠাৎ করেই আমাদের প্রাইভেটকারটি একটি ছোট নদীর উপর নির্মিত লোহার সেতু অতিক্রম করতে থাকল, সেতুটির রং ছিলো নীল। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশেও অসংখ্য নদ-নদীর উপর ছোট-বড় লোহার সেতু রয়েছে, যেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাল বা সিলভার রংয়ের হয়ে থাকে এবং রেল লাইনের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়। কোথাও কোথাও নীল রংয়েরও থাকতে পারে, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। যখন আমাদের গাড়িটি নীল রংয়ের লোহার সেতুটি পার হচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমার ভিতরে একধরনের রোমাঞ্চ বয়ে গেল, আমি এই প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম যে, আমি ভিন্ন দেশে। এই প্রথম আমি মানচিত্রের বাইরে।

……. চলবে

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Indiatravel story