ভারতে এর শেষ গ্রাম – মানা

মানা এর অবস্থান – চামোলি,উত্তরাখন্ড,ভারত।

স্বর্গের নদী গঙ্গা মর্ত্যে নামবেন। গতি তার বিপুলা। শঙ্কা – তোড়ে ধ্বংস পাবে পৃথিবী। শিব এলেন জটাতলে, গতি রোধ করতে। তবুও শঙ্কা কাটে না। গঙ্গা তাই ১২ টি ধারায় বিভক্ত হয়ে মর্তে চললেন। ধারা ১২ হলেও উল্লেখ্য এদের মধ্যে চার – অলকানন্দ, মন্দাকিনী, ভাগীরথী ও যমুনা। এই অলকানন্দার তীরেই মানা গ্রামটি অবস্থিত যা তিব্বত তথা চীন সীমান্তে ভারতের শেষ গ্রাম।

গত ২৯/০৮/২০১৮ তারিখে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার ট্রেক শেষে বেলা এগারটার পর আমরা গোবিন্দঘাট পৌঁছি। এখন মূল লক্ষ্য হলো ভারতের শেষ গ্রাম মানাতে যাবো। যদিও তার আগে সনাতন ধর্মের তীর্থস্থান বদ্রীনাথ পথিমধ্যে থাকায় সেটা দেখে নিয়েছি।

গোবিন্দঘাট থেকে ২৫০০ রুপিতে সুমো ভাড়া করা হয়, মানা শেষে আমাদেরকে যোশিমঠে পৌঁছে দিবে। গোবিন্দঘাট থেকে গাড়ী সোজা উত্তর দিকে চলছে। ভারতের জাতীয় ৫৮ নং রাস্তা ধরে। সুবিশাল পাহাড়ের ধার ধরে সুমো চলছে তীব্র বেগে। কোথাও বা পাহাড়ের গা বেয়ে চুঁইয়ে পরা পানিতে রাস্তা সিক্ত। আবার কখনো রাস্তা ল্যান্ডস্লাইডের এর জন্য কর্দমাক্ত। মনে হচ্ছে এই বুঝি পাহাড়ের মাটি ও পাথর নিচে গড়িয়ে পড়বে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখতে হয়। চোখ বন্ধ রাখাও যে দায়! এমন সৌন্দর্য্যভরা পাহাড় আর পাশ দিয়ে বয়ে চলা আলকানন্দ নদীর পাগলকরা স্রোত কিভাবে উপেক্ষা করি! কিভাবে স্থির থাকি সাদা মেঘরাজিকে এতোকাছ থেকে পেয়েও না দেখে! পাহাড়ী রাস্তাগুলোতে মনে হয় ঘড়ির কাটাগুলো সময়কে ফাঁকি দিতে পারে। না হলে এতো দ্রুত কিভাবে
বেলা ১২ঃ৪৫ বাজলো। চমকে উঠলাম, ঐ তো নীল রং এর মাঝে সাদা কালিতে লেখা Last Indian Village লেখা, ঠিক রাস্তার উপরে, সুবিশাল সাইনবোর্ডে।

গ্রামের ভিতরে গাড়ী ঢুকবে না, সরু রাস্তা। তাই গ্রামে ঢুকার গেট থেকে কিছুদুরে আমাদেরকে নামিয়ে দিলো। পাথর বিছানো রাস্তা ধরে সোজা পশ্চিম দিকে যেতে হয়। ১৮০ টি পরিবারের একটা ছোট গ্রাম। প্রায় ৬০০ জনের মতো বাস। গ্রামটি রাস্তার উত্তর ধারে আর দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। গ্রাম বলতে যা বুঝায় ঠিক তেমনি। কষ্টের এক চাপা অভিব্যক্তি সকলের চোখে মুখে। সেটা যে অভাবের,সেটা আর বুঝতে খুব একটা দেরি হলো না। তবুও তারা সুখি। হাসিমাখা মুখ নিয়ে পর্যটকদের সাথে সুন্দর করে কথা বলে। জিজ্ঞাসা করলে বলে দেদেয় কোন দিকে যেতে হবে। বাড়ীর সামনে দোকান নিয়ে বসে আছে দোকানীরা। । বেশির ভাগ দোকানে নিজ হাতে বুনানো উলের শীত বস্ত আর খাবার দোকান।

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে আলু,বাঁধাকপি, বিন চাষাবাদ আর ছোট ছোট আপেল গাছ। আবাদী ফসল বলতেই এগুলোই মানাবাসীর পরম যত্নে লালিত ফসলাদি। পাহাড়ী গ্রাম হলে কি হবে এখানে এখন বিজলি বাতি জ্বলে আর রান্নার জন্য LPG গ্যাস প্রতিটি বাড়ীতে ব্যবহৃত হয়। মাসের একটা নিদির্ষ্ট তারিখে গাড়ী বোঝাই সিলিন্ডার আনা হয় আর লাইন ধরে সেগুলো নেবার সেই দৃশ্যও বড়ই মনোমুগ্ধকর।

কিছুদূর এগিয়ে যেতে রাস্তা টা Y অক্ষরের মতো দুপাশে বাঁক নিল। বাম দিয়ে চললে দেখা মিলবে –

  • ভিম পুল
  • স্বরসতী ধাম
  • কিসব প্রয়াগ

আর ডান দিকে গেলে দেখা মিলবে –

  • গনেস গুফা
  • ভাস গুফা

আমরা বাম দিকেই আগে রওনা দিলাম। কিছু দূর যাবার পর, একটা বিশাল পাথর ঠিক রাস্তার উপরে। নিচ দিয়ে রাস্তা। দূর থেকে কিসের যেন গর্জন ভেসে আসছে কানে। বামে মোর নেবার আগে ঐ পাহাড়ের নিচে বালু মাখা মেদহীন জটাধরা এক সাধুকে বসে থাকতে দেখলাম। কাছে যেতে হাত তুলে আর্শিবাদ করলো। মুখে হাসি-তৃপ্তির না অন্য কিছুর বুঝতে পারলাম না। তার পাশেই আর এক বয়োবৃদ্ধ সন্যাসও দেখলাম। তারা দুজনে বসে আছেন কি ব্রত নিয়ে আর কতোদিন থেকে পাহাড়ের পাদদেশ এমন নির্জন বাস,সঠিক জানি না। বা তার কাছ থেকে জানাও হয় নি। কি প্রয়োজন, অন্যকে বিরক্ত করা?

বামে মোড় নিতেই সেই গর্জণটা আরো তীব্র হতে লাগলো। কি সেই গগণবিদারী শব্দ! আর কি ভাবে পাথরে আছড়ে পড়ে জল বাষ্প সৃষ্টি করছে,তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। এ যে স্বরসতী নদী। বরফ গলা পানি।

পৌরণিক কাহিনি

পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদী এই পথে যাত্রা করেছিলেন স্বর্গারোহণে। কিন্তু স্বরসতী নদীতে তীব্র স্রোত দেখে দ্রৌপদী ভয় পেয়েছিলেন। তখন ভীম একটা বিশাল পাথর স্বরসতী নদীর উপর পারাপারে জন্য ফেলে দেন। তার উপর দিয়ে দ্রৌপদী ও অন্যরা স্বরসতী নদী পার হয়েছিলেন। সেই পুল ভীমপুল নামেই পরিচিত। স্বরসতী নদী কয়েক শ মিটার তীব্র বেগে ধাবিত হয়ে কিসব প্রয়াগে গিয়ে আলকানন্দ নদীতে মিশেছে। প্রয়াগ হচ্ছে দুটি নদীন মিলনস্থল। এর পাশেই আছে ভারতের শেষ টি স্টল।

সেই পাথর কাটা রাস্তা ধরে আরো কিছুদূরে এগিয়ে গেলে এক চিকন রাস্তা আর সাইডে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে এক ন্যাড়া পাহাড়। সেই রাস্তা যে কোথায় গিয়ে মিশেছে, জানি না..

স্বরসতীর প্রাণে তাকিয়ে ছিলাম আমরা সবাই অনেক ক্ষণ। আর তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলাম সবুজ পাহাড়া, নদীর ঠান্ডা জল। পাশে একটা ছোট গ্রাম যে গ্রামের লোকের কিছুদিন পর নিজ ভুমি ছেড়ে চলে যাবে আর নিচে, চামোলীতে। যখন বরফে আচ্ছাদিত হবে সব কিছু। আর তাকিয়ে ছিলাম দক্ষিণে উঁচু পাহাড়ের গায়ে বর্ডার গার্ড অর্গানাইজেশন এর তৈরি করা রাস্তাগুলোর দিকে। এখান আর মাত্র ২৪ কিলোমিটার পরেই বর্ডার,তিব্বত সীমান্তের। যা মানা পাস নামে পরিচিত। পৃথিবীর উচ্চতম গিরিপথ। ১৯৬২ সাল থেকে বন্ধ আছে। এই পথেই আগে চীন ও ভারতের যোগাযোগ হতো।

মনটা উদাসী হলেও আরো কিছু দেখার বাঁকী তাই তো উঠতো হলো সবাইকে। সেই Y এর কাছে এসে ডান দিকে মোড় নিলাম কতিপয় আমরা। একটু পর দেখি আমার পিছে আর কেউ নেই। একটু নিচে দূরে ছায়াতলে বসে শীতল সমীরণে গল্প করছে দুজন। আমার যে কিসে নেশা পেয়েছে জানি না। উপরে উঠছি তো উঠছি। এক মহিলাকে দেখলাম। পিঠে পাহাড়ী ঢালি নিয়ে নিচে নামছেন। তার কাছ থেকে জেনে নিলাম গনেস গুম্ফা আর কতো দূর।
কাছেই।

আরো কিছু উপরে উঠে দেখা মিলল গনেস গুম্ফার। একা ভিতরে যাবার কেন জানি আর সাহস পেলাম না। সেই পথ ধরে আরো কিছু দূর এগোলেই ভাস গুম্ফা।

কি আশ্চর্য ১০১৩৩.৫ ফুট উচ্চতায় দেখতে পেলাম আজ থেকে ৫৩২৬ বছর আগের এক গুম্ফা। কি পরিপাটি করে রাখা আছে। তার উঠানেই একজন হারমোনিয়াম বাঁজিয়ে চলছেন আপন মনে। আমাকে দেখে হারমোনিয়াম বাজানে বন্ধ করে ভিতরে যেতে বললেন। কি মনে করে আর ভিতরে যাওয়া হলো না। একটু বসে পড়লাম নিজকে সেই অতীতকালের মধ্যে অবগাহনের জন্য।

সেই পথ ধরে আবার নেমে আসলাম আর বারে বারে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম , ভাবছিলাম এখানেই বসে মুখ দিয়ে মহর্ষী ব্যাসদেব বলতেন আর গনেস তা লেখে রাখতেন। এভাবেই রচিত হয়েছিল বিখ্যাত মহাভারত।

কিভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে তিনটি ট্রেন দেরাদুন যায়। দেরাদুন না নেমে তার আগেই হরিদ্বার নেমে পড়ুন। আর জিপ ভাড়া করুন ৬৫০০ থেকে ৭৫০০ রুপিতে। আর একা হলে বদ্রীনাথের বাসে উঠুন। ভাড়া ৩০০-৪০০ রুপি।

অথবা বিমানে দেরাদুন। ভাড়া কলিকাতা টু দেহরাদুন পর্যন্ত সময় ভেদে ৬০০০-৮০০০ রুপি। দেহরাদুন থেকে বদ্রীনাথের বাস পাওয়া যায়। ভাড়া ৪০০-৪৫০ রুপি। অথবা শেয়ার জীপেও যেতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে ভাড়া লাগবে চামোলি পর্যন্ত ৫০০ রুপি। চামোলি হতে সোজা বদ্রীনাথ।

বদ্রীনাথ থেকে মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার দূরেই মানা গ্রাম।

থাকবেন কোথায়

মানাতে থাকার মতো কোন আবাসিক হোটেল এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে গ্রামের কাউকে বলে থাকতে পারলে তা ভিন্ন কথা। মানা গ্রামের পাশেই বদ্রীনাথ হবার কারণে সবাই বদ্রীনাথেই রাত্রীবাস করেন। ভাড়া ৫০০-৬০০ রুপি।

কখন যাবেন

মে থেকে সেপ্টেম্বর।

মোট খরচ

প্রায় ২০ হাজার টাকা।

কেন যাবেন

√ ভারতে শেষ গ্রাম- মানা
√ বদ্রীনাথ মন্দির
√ ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস
√ হেমকুন্ড সাহিব
√ যোশীমঠে গিয়ে রোপওয়ে করে Auli
√ হরিদ্বারে সন্ধ্যা আরতি
√ হৃশিকেশে রাফটিং ও বাঞ্জি জাম্প
√ ম্যুসোরি ইত্যাদি।

Leave a Comment
Share