হামহাম জলপ্রপাত ভ্রমণ

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত এই হামহাম ঝর্ণা। স্থানীয়ভাবে একে চিতা ঝর্ণা নামেও ডাকা হয়। এই ঝর্ণাটির উচ্চতা নিয়ে কিছুটা মতান্তর রয়েছে। ১৬০/১৭০ ফুট উঁচু এই ঝর্ণাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝর্ণা হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত। হামহামের দেখা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে শ্রীমঙ্গল/মৌলভীবাজার, বাস/ট্রেন যেকোন টাতেই যাওয়া যায়। এরপর জীপ/সিএনজি নিয়ে যেতে হবে কলাবন পাড়া।

পাহাড় প্রেমীদের অন্যতম একটি তীর্থস্থান। অত্যন্ত দুর্গম আর গভীর জঙ্গলে অবস্থিত এই জলপ্রপাত পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতি পদে পদে যেমন রয়েছে বিপদের ভয়, তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চের হাতছানি। সেই রোমাঞ্চের টানেই পাহাড়প্রেমী আমি ও আমরা ১১জন ঘুরে আসলাম হামহাম জলপ্রপাত থেকে৷

০৫ জুলাই ২০১৯ / ২১ আষাঢ় ১৪২৬ /০২ জিলক্বদ ১৪৪০

“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম”
“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম”

গাড়ী থেকে নামার পর মৌলভীদের ফজরের আযানে মুখরিত মৌলভীবাজার৷ পানসী হোটেলে ফ্রেস হয়ে রওনা দিলাম আমি মানিক, তালেব, মাইদ, শিপলু, সাঈদ, শুভ, আজাদ, মামুন, এমরান, রফিক ও আলাল৷ মেঘলা আকাশে ভোরের ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাসে আঁকা বাকাঁ উচু নীচু পাহাড়ী চা বাগানের পথ ধরে ছুটে চলে আমাদের জীপ গাড়ী৷ পথের পুরো সময়টা মাতিয়ে রেখে ছিল সাথীদের গল্প, গান, আড্ডা আর দুষ্টামি৷ পথে সবাই খুরমা ঘাটে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম সঙ্গে চায়ের দেশের বেস্বাদের চা ৷

একজন গাইড নিতে ভুলবেননা যেন। অত্যন্ত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে হামহাম পর্যন্ত তিনিই নিয়ে যেতে পারবেন আপনাকে। আমাদের গাইডের সঙ্গে তালেব ও শিপলু গাইডের ভূমিকা পালন করাতে আমাদের ভ্রমনটা আরও সহজ হয়েছে ৷ আনু মিয়ার হোটেলে কাপড় চেঞ্জ করে ব্যাগ রেখে প্রয়োজনীয় জিনিস ও শুকনা খাবার, পানি এবং লবন পানি সঙ্গে নিয়ে সকলে রওনা দিলাম ৷

কুরমা বন বিট রাজকান্দি রেঞ্জ এখান থেকেই শুরু হবে পায়ে হেঁটে চলা। হামহাম যাওয়ার রাস্তা দুটো। একটা হচ্ছে ঝিরিপথ আরেকটা হচ্ছে পাহাড়ি পথ। যদিও আমরা দুপথেই বিচরন করেছি, বর্ষাকালে এই ঋতুতে যেতে চাইলে আপনাকে পাহাড়ী পথ ধরেই এগোতে হবে। এই পথে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে ঘন জঙ্গল, ছোট বড় কয়েকটি পাহাড় আর ঝিরি।

বনে ঢুকতেই কানে আসবে হটাৎ অচেনা পাখির ডাক আর অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। সময় গড়ানোর সাথে সাথে জঙ্গলও ঘন হতে থাকে। আমরা বন্য প্রানির দেখা পাইনি৷ কলা বন, বাশঁ বন দেখে মনে হবে পৃথিবীর সব বাশঁ এখানেই জন্মায় দুচোখ যতদুর যায় বাশঁ আর বাশঁ৷ ঘন বাশঁ বনের ঝিরির পথটা ডেকে রেখেছে বাশেঁর ছাউনি দিয়ে৷ অনেকটা পথ হেটে যেতে হবে ঝিরির পানি পথ দিয়ে, ঝিরিতে পিচ্ছিল পাথর, পড়ে থাকা বাশঁ দেখে না চল্লে কিছুটা বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।

জলপ্রপাত পর্যন্ত পৌঁছতে ছোট বড় কয়েকটি পিচ্ছিল পাহাড়ও পাড়ি দিতে হয়। এই পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নেয়ার জন্য বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য দাঁড়ালেও আসবে বিপদ। সেই বিপদ আর কিছুই না, দাঁড়ানো মাত্রই চারপাশ থেকে আপনাকে ঘিরে ধরবে অসংখ্য জোঁক। সবাই বলে হামহামের পথ হচ্ছে জোকদের রাজ্য। এর থেকে বাঁচতে চাইলে যতটুকু সম্ভব শরীর ঢাকা কাপড় পরুন। পায়ে জুতো বা উঁচু বুট পরলে ভালো। আর সাথে লবণ নিতে ভুলবেননা। সাবধানতা অবলম্বনের পরেও যদি জোঁক ধরে, তখন লবনই ভরসা। লবণ দিলেই সাথে সাথে ছেড়ে দেবে। আমাদের সবাইকে ধরেছে জোঁকে আমাকে ধরেছে সবচেয়ে বেশী এতে আমার জোঁক ভীতি কমেছে, আমি জোঁক ছাড়ানোর চেষ্টা করছি আর দুষ্ট বন্ধু তালেব জোঁকের ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত৷ দুজন সাথীর জোঁকের কামড়ের ক্ষত দিয়ে রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না৷ তাই খুব বেশি না থেমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেঁটে যাওয়াই ভালো। তবে তাড়াতাড়ি হাঁটলেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, পথ অনেক পিচ্ছিল ও খাঁড়া। পরে গেলে মারা যাওয়ার ভয় না থাকলেও নাক-মুখ বা হাত-পা ভাঙার সম্ভাবনা আছে। আর যেহেতু পাহাড়ী পথে চলে অভ্যাস নাই আমাদের অনেকেরই তাই ছোট্ট একটু অসাবধনতাই হতে পারে বড় বিপদের কারণ। মাঈদের পায়ে রগ টান এবং আমরা সকলে দু এক বার পড়ে গেলেও বলার মত তেমন চোট পায়নি ৷ হামহামের কাছাকাছি আসলে ভারত সিমান্ত দেখা যাবে৷

যাই হোক বিপদজনক পাহাড়ি পথ শেষ হলেই দেখা মিলবে ঝিরির। ঝিরির কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানি। নীচে রয়েছে ছোটবড় পিচ্ছিল পাথর। এই ঝিরি ধরে হাঁটলেই দেখা মিলবে সেই অধরা হামহাম। এই সুন্দরের দেখা পেতেই আমরা গাজীপুর থেকে এডভেঞ্চার প্রিয় দুষ্ট ছেলের দল ছুটে এসেছি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে।

মহান রাব্বুল আলামিনের কি অপরূপ সৃষ্টি কলকল ছলছল শব্দে জল তরঙ্গ তুলে নীচের দিকে স্ববেগে নেমে আসছে হামহামের শীতল পানি। হামহামের এই উচ্ছল লাবণ্যময় সৌন্দর্য ভোলার নয়। হামহাম ঝর্ণা বছরের অন্য সময় যেমনই থাকুক, বর্ষায় অষ্টাদশী নারীর রূপ ধারণ করে।

আমরা কয়েকজন ভয়ঙ্কর খাড়া পিচ্ছিল পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার দূঃসাহস করেছি। আপনারা কিন্তু ভুলেও উপরে উঠার চিন্তা এবং চেষ্টা করবেন না মৃত্যর ঝুকি রয়েছে৷ ঝর্ণার ঠিক নীচেই রয়েছে গভীর খাদ। তাই সাঁতার না জানলে খুব কাছে না যাওয়াই ভালো। ঝর্ণার পানিতে যত ইচ্ছে লাফালাফি করলেও খেয়াল রাখবেন আপনাকে আবার সেই দূর্গম পথ হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। এই ঘন জঙ্গলে বিকেলের পর সূর্যের আলো পৌঁছায় না। আর অন্ধকারে এই পথ পাড়ি দেওয়ার কথা চিন্তা না করাই ভালো। আমরাও হামহাম দর্শন শেষে বিদায় নিলাম।

আল্লাহ্‌ সহায়ক প্রকৃতি আমাদের পক্ষে ছিল। আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই সুস্থ ও সুন্দর ভাবে ভ্রমন শেষে প্রায় বিশ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে এলাম অনাবিল সৌন্দর্যের অনুভূতি নিয়ে।

Leave a Comment
Share