হর্ণবিল ফেস্টিভ্যাল, নাগাল্যান্ড

সময় টা অগাস্ট মাস হবে। এক ফ্রেন্ড যখন প্রস্তাব টা দিলো কোনো ধারনাই ছিলনা হর্ণবিল ফেস্টিভ্যাল (Hornbill Festival) জিনিসটা কি। নাগাল্যান্ড যাওয়ারও কস্মিনকালে ইচ্ছে হয়নি। একটু গুগল করতেই বেশ উৎসাহ জেগে উঠল মনে। ফটোগ্রাফি করার একটা সখ থাকায় ফেলতে পারলাম না প্রস্তাব টা কারন ফটো তোলার আদর্শ জায়গা হতে পারে এটা।

আমাদের প্ল্যান টা ছিল এরকম:

01 Dec Fri : Evening Flight to Guwahati. Overnight train to Dimapur.
02 Dec Sat : Dimapur to Kohima by car, 2hrs. Attend festival.
03 Dec Sun : Full day at festival. Late evening car to Dimapur. Overnight train to Guwahati.
04 Dec Mon : Morning flight to Kolkata.

দুদিনের মধ্যে একটা whatsapp গ্রুপও তৈরি হয়ে গেল। Make My Trip থেকে ভাল ক্রেডিট কার্ড ডিস্কাউন্ট পেয়ে গেলাম গুয়াহাটি যাওয়া আসা ফ্লাইট ৪০০০ রুপীতে। ট্রেন এর টিকিট ও হয়ে গেল স্লিপার ক্লাস এ ৩৬০ রুপীতে গুয়াহাটি থেকে ডিমাপুর যাওয়া আসা।

এরপর শুরু হল হোটেল খোঁজা। আমাদের ইচ্ছে ছিল ফেস্টিভাল গ্রাউন্ড এর যত কাছে থাকা যায় কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতেই তখন হয় খালি নেই নয়ত দুটোর বেশি রুম পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই মিলে অনেক খোঁজার পর “Vicha Paying Guest” এ ৩ টে রুম পাওয়া গেল ২০০০ রুপী করে কিন্তু একটাই কমন বাথরুম। সাথে দুজন মহিলা বন্ধু থাকায় এটা ভাল অপশন ছিলো না তাও খুব পছন্দ না হলেও এটাকেই কনফার্ম করে দেওয়া হল। প্রথমে ৬ জন যেতে রাজি হয়েছিল। যাওয়ার ১ সপ্তাহ আগে আরো একজন যোগ হলো। সেক্সপিয়র স্মরনীতে নাগাল্যান্ড হাউস এ গিয়ে Inner Line Permit (ILP) করে নেওয়া হল আমরা কোহিমাতে যতদিন থাকব ততদিনের জন্য। ILP করতে খরচ ৫১ রুপী জনপ্রতি, দুপুরের মধ্যে গেলে দিনের দিনই বানিয়ে দেয়।

Leaving Kolkata Airport

এরপর শুধুই অপেক্ষা ১লা ডিসেম্বর এর। যাত্রার দিন দুজন সকালের ফ্লাইট ধরে আগে চলে গেলো। দুজন দুপুরের ফ্লাইট এ। সবশেষে আমরা ৩ জন অফিস করে বিকেলের ফ্লাইট এ গুয়াহাটি পৌঁছলাম। ওখানে তখন কলকাতার থেকে সামান্য বেশি ঠান্ডা। ঊবার নিয়ে পৌঁছলাম গুয়াহাটি ষ্টেশন। ষ্টেশন এর পাশেই প্রশান্তিতে ডিনার করে নাগাল্যান্ড এক্সপ্রেস এ উঠলাম যেটা রাত ১১ঃ৪০ এ ছাড়ল। আমরা একটু আড্ডা মেরে যে যার বার্থ এ শুয়ে পড়লাম। বাথরুম এর পাশেই সিট পড়ায় খুব একটা ভাল ঘুম হলো না। ভোর ৫ টায় পৌঁছানোর কথা ছিল কিন্তু লেট করে ট্রেন ডিমাপুর পৌঁছল ৬ঃ৩০ এ। ডিমাপুর এ ভালই ঠান্ডা লাগছিল। হাল্কা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন এর ওয়েটিং রুম এ রিফ্রেশ হতে গিয়ে হতাশ হতে হল। খুবই করুণ অবস্থা ওয়াশ রুম এর। ফ্রেশ হওয়া আর হলো না। এরপর স্টেশন এর বাইরে যেতেই ট্যাক্সিওয়ালারা চলে এলো কোহিমা এবং ফেস্টিভাল লোকেশন এর যাওয়ার রেট নিয়ে কথা বলতে।

ডিমাপুর রেল স্টেশন

এরই মধ্যে আমাদের কয়েকজন ষ্টেশন এর বাইরে চলে গেলো এক রাজবাড়ি দেখতে। ওখানে নাকি ভীম আর হিড়িম্বা দাবা খেলেছিল। বিশালাকৃতি দাবার ঘুঁটি গুলো কিছু ভেঙে গেলেও এখনো বিরাজমান। আমরা এদিকে একটা Eeco গাড়ি ২৫০০ রুপীতে রফা করলাম একদম হোটেল এ পৌঁছে দেবে। রওনা হয়ে বাকিদের রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হল। এরপর শুরু হল খারাপ রাস্তায় চলার অভিজ্ঞতা। কোহিমা শহর এর একটু আগে পর্যন্ত রাস্তার বলা যায় ৭০% খুব খারাপ। মাঝে এক জায়গায় একটা রেস্তোরাতে চা খাওয়া হল এবং কেক, চিপ্স সাথে নিয়ে নেওয়া হল। কোহিমা ঢোকার একটু আগে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাল কিন্তু হর্নবিল ফেস্টিভাল যাব শুনে ILP চেক না করেই যেতে দিল। সুন্দর পাহাড়ি পথ ধরে গাড়ি চলল। রাস্তার ধারে আনারস এর পাহাড় নিয়ে বিক্রেতারা পসার সাজিয়ে বসেছে সাথে কমলালেবু আরও অনেক রকম ফল ও সব্জি নিয়ে। প্রায় ১১ঃ৩০ বেজে গেল হোমস্টে পৌঁছতে। এটা কিগুয়েমা গ্রামে আর ফেস্টিভাল হয় কাছেই পাশের হেরিটেজ গ্রামে যার নাম কিসামা (Kisama – Heritage Village) যেটা কিগুয়েমা আর ফেসামা গ্রাম এর জমি নিয়ে বানানো হয়েছে। গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডার কনকনানি মালুম হল। মেন রোড থেকে ঢালু পথে বেশ কিছুটা নেমে হোমস্টে সুন্দর ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা। আমাদের ৩ টে রুম এর সাথে একটা কমন বাথরুম দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সৌভাগ্যবশত দুটো রুম কমন বাথরুম এর সাথে ও আর একটা রুম পেলাম অ্যাটাচ্ড বাথরুম সহ। মহিলা দুজনকে ওই রুমে পাঠিয়ে আমরা ৫ জন দুটো রুম শেয়ার করে নিলাম। হোমস্টের মালিক জাঠো আমাদের অভ্যর্থনা জানালো ও আপ্যায়ন করল গরম কফি সহযোগে। টেবিল এ পড়ে থাকা ফেস্টিভাল বুকলেট এ আমরা চোখ বুলিয়ে নিলাম সেদিন ও পরের দিনের অনুষ্ঠান সূচিতে।

কোহিমা যাবার পথে

আমাদের হাতে সময় অল্প ছিলো তাই ঠিক করা হল যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে পড়তে হবে। বাইরে গিয়েই লাঞ্চ করা যাবে। সেইমত দ্রুত আমরা রেডি হয়ে ১টায় বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। হোটেল থেকে প্রায় ৩ কিমি হাঁটা পথ ফেস্টিভাল গ্রাউন্ড যেতে তাও মাঝে একটা শর্টকাট নিয়ে। প্রাকিতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হাঁটতে মন্দ লাগছিল না। ঠান্ডা ছিল ভালই তবে সাথে ঘন নীল আকাশ আর সূর্যের তাপ বেশ উপভোগ্য লাগছিল। মাঝে মাঝে একটু দাঁড়ানো, ফটো তোলা, আবার পথ চলা। এদিকে ক্ষিদের চোটে অবস্থা খারাপ সবার।

হোম স্টে থেকে হর্ণবিল ফেস্টিভ্যাল এর দিকে যাবার সময়ে

কোনমতে গেট এর কাছে পৌঁছেই দেখি এক মহিলা বিক্রেতা ভেজ পকোড়া ভাজছে। দেরি না করে একদম সদ্য কড়া থেকে নামানো গরম পকোড়া খেয়ে একটু খিদে মেটানো গেল। এরপর গেট এর কাছে এগোতেই কিছু ছেলেমেয়ে চলে এল রিষ্ট ব্যান্ড পড়াতে। ওটাই ফেস্টিভাল এর টিকিট ২০ টাকা জনপ্রতি। প্রত্যেকদিন ভিন্ন রঙ এর ব্যান্ড, ওইদিন এর রঙ ছিল সবুজ। ক্যামেরার জন্য ২০/৩০ টাকার স্লিপ কেটে (ক্যামেরার আকার ও ধরণ অনুযায়ী) প্রবেশ করলাম ফেস্টিভাল গেট দিয়ে।

ফেস্টিভ্যাল এর প্রধান গেট

একটু এগোতেই পথে পড়ল ফুল/ফল আর সব্জির প্রদর্শনী এবং বিক্রির স্টল। সবই গ্রামবাসীদের নিজের ক্ষেতে তৈরি করা। পুরস্কারও পেয়েছে এদের মধ্যে কেউ কেউ, লেবেল দিয়ে মার্ক করা রয়েছে প্রাইজ জেতা জিনিসগুলো। ওখানে সবচেয়ে আগে যেটা আকর্ষণ করলো তা হলো আনারস। ৩ টি আনারস গোটা ১০০ টাকা। আর স্টিক এ গেঁথে আইসক্রিম এর মত আনারস পাওয়া যাচ্ছে ১০ টাকা প্রতি স্টিক। আমরা ২/৩ টি করে স্টিক সবাই খেয়ে নিলাম এবং মনস্থির করলাম পরের দিন ফেরার আগে গোটা আনারস অবশ্যই নিয়ে যাবো বাড়ির জন্য। এরপর যে জিনিসটা ওখানে মূল আকর্ষণেরটা হল নাগা মিরচি, এটি মূলত এক্ রকমের লঙ্কা যেগুলি আস্বাভাবিক ভাবে বেশি ঝাল। সেই রকম গোটা লঙ্কা, লঙ্কার আচার, সস, পেস্ট সব রকম ই পাওয়া যাচ্ছিল। এছাড়া ছিল নানারকম সবজি, ফল যেমন কুমড়ো, কিউয়ি, কমলালেবু, কলা, অ্যাভোকাডো আরো অনেক কিছু। নানারকম ফুল, অর্কিড এর প্রদর্শনী হচ্ছিল পাশের হলে।

ফুলের প্রদর্শনী

ওখানেই আমাদের অনেকটা সময় বেরিয়ে গেল। এবারে আর একটু কিছু খেতেই হয়। খাবারের দাম বেশির দিকেই বলা যায়। ছোট ৮ পিস করা তন্দুরি চিকেন ৬০০ টাকা আর তার সাথে খেলাম স্থানীয় কালো চেরি দিয়ে তৈরি ওয়াইন ৩০মিলি ১০০ টাকা করে। কিছুটা আজব শোনালেও এটাই ছিল আমাদের ওই দিনের মধ্যাহ্নভোজন। একটু উপরে উঠতে আমরা দেখলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কিছু জিপ রাখা সাথে কিছু তরোয়াল, বন্দুক ইত্যাদি। জিপ এ বসে তরোয়াল হাত এ নিয়ে আমরা কিছু ফটো তুললাম। পাশে আর একটা স্টলে কিছু কারিগর বসে নাগাদের টুপি, পোশাক ও সাজ-সরঞ্জাম তৈরি করছিল। অনেকটাই সময় চলে গেল আমাদের এসব দেখতে দেখতে, তবে এগুলো ফেস্টিভাল এরই অংশ তাই মিস করাও যায়না। অবশেষে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপরের রাস্তার পাশে ফেস্টিভাল গ্রাউন্ড এ পৌঁছলাম।

ফুলের প্রদর্শনী

ফেস্টিভাল এর সম্মন্ধে একটু বলি। নাগাল্যান্ড রাজ্যটি প্রায় ১৬ টি আদিবাসী গোত্রের আবাসস্থল এবং তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র উত্সব আছে। নাগাল্যান্ডের জনসংখ্যার ৬0% এরও বেশি কৃষিতে নির্ভর করে এবং তাই তাদের বেশিরভাগ উৎসব কৃষিকে ঘিরেই। নাগাল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উৎসাহিত করতে এবং প্রচার করতে নাগাল্যান্ড সরকার প্রতিবছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হর্নবিল ফেস্টিভাল আয়োজন করে। প্রথম উৎসব ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের নাম ভারতীয় হর্নবিল এর নামানুসারে যা নাগাল্যান্ড এর অন্যতম প্রধান পাখি এবং যা বিভিন্ন আদিবাসী গোত্রের লোককাহিনীতেও উল্লিখিত আছে [উৎস – উইকিপেডিয়া]।

ফেস্টিভ্যাল গ্রাউন্ডের গেট

ফেস্টিভাল এর দিনগুলোতে প্রতিদিন ৩ টি সেশন এ বিভিন্ন উপজাতির নাগারা ওই মাঠে নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শন করে। প্রথম সেশন সকাল ১০ টা থেকে ১১ঃ৩০ টা। দুপুরের সেশন ১ টা থেকে ২ঃ৩০ টা এবং বিকেলের সেশন ৩ টা থেকে ৪ টা। এরপর ৪ঃ৩০ টা থেকে শুরু হয় রক কনসার্ট যেটা চলে প্রায় ৬ টা পর্যন্ত। আমরা যখন মাঠে পৌঁছলাম তখন প্রায় ৩ঃ৩০ টা বাজে এবং ওইদিনের বিকেলের সেশন প্রায় শেষের দিকে।

মাঠে যখন ঢুকছি অনেকেই তখন বেরিয়ে আসছে, তাই গ্যালারিতে সহজেই ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেলাম বসার। একটু আফসোস হচ্ছিল না এমন নয়, ভাবছিলাম যদি আমাদের ট্রেনটা সঠিক সময়ে পৌঁছতো আমারা হয়ত আরো দেড় ঘণ্টা বেশি সময় পেতাম। যাই হোক তখন পৌঁছেও ৩-৪ টি পারফরমেন্স দেখতে পেলাম নর্থ-ইস্ট এর কয়েকটি রাজ্যের। সবার পারফরমেন্স হয়ে যাবার পর দলগুলো মাঠ প্রদক্ষিণ করে এটাই নিয়ম ৩ টি সেশন -এর পরেই। এর ঠিক পরই দর্শকরা সবাই মাঠে ঢুকে পরল এবং পারফর্মারদের ক্লোস আপ ফটো সেশন শুরু হল সাথে তাদের সাথে সেলফিও। আমরাও বাদ গেলাম না, এই সুযোগ কি আর ছাড়া যায়।

পারফর্মারদের সাথে ছবি

এরপর আমরা মাঠ ছেড়ে পাশের শপিং আর্কেড  এ ঢুকলাম। নানারকম জিনিস এর সম্ভার সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। অল্প সল্প কিছু জিনিস কিনে আমরা উপরের দিকে গিয়ে একটা কুঁড়ে ঘর দেখতে পেলাম যার দরজাটা ভেজানো ছিল। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি কেউ নেই কিছু নাগাদের পোশাক, গয়না আর অস্ত্র রাখা। আমরা সবাই ওগুলো গায়ে চাপিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে ফটোসেশন করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দুজন নাগা মহিলা এসে দেখে হাঁসছিলো তবে অনধিকার প্রবেশ এর জন্য কিছু ঝামেলা করেনি এই সৌভাগ্য 🙂 এরপর আমাদের আবার খিদে পেয়ে গেলো, অত হাল্কা লাঞ্চ -এ কি আর বেশিক্ষণ কাটান যায়। যাই হোক খাবার-এর অপশন খুঁজতে শুরু করা হল। বেশিরভাগ স্টলেই খালি পর্ক, বিফ আর ডগমিট যেগুলো আমাদের একেবারেই পছন্দ ছিল না। অনেক খুঁজে একটা রেস্তরাঁতে পাওয়া গেল ভাত-চিকেন। আমার আবার বিকেল বেলা ভাত খেতে ইচ্ছে করছিল না তাই নিলাম ফ্রায়েড চিকেন আর চিকেন স্যুপ। সার্ভ করার পর দেখি নামেই ফ্রায়েড চিকেন। কারিপাতা বা আরও কিছু একটা মিশিয়ে বানিয়েছে চিকেনটা এবং বাজে একটা গন্ধ লাগছে খেতে। স্যুপটা যদিও খারাপ ছিল না। সূর্যাস্থের পর থেকেই তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছিল, আমরা খাচ্ছিলাম প্রায় কাঁপতে কাঁপতে। টেবিল এর পাশে একটা উনুন রেখেছিল যাতে আমরা কিছুটা উষ্ণতা পাই। খেতে খেতে আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম রক কন্সার্ট এর গান। রেস্তরাঁটাও খুব সুন্দর চাইনিস লাইট দিয়ে সাজালো ছিলো। খাবারটা খুব উপাদেয় না হলেও মূহুর্তটা বেশ উপভোগ করছিলাম সবাই। খাওয়া শেষ করে আমরা নিচে এসে আবার ঢুকলাম শপিং আরকেড এ। পরের দিন বেশি সময় হাত এ থাকবে না আর তাছাড়া ব্যাগ প্যাকিং সেদিন রাত এই শেষ করতে হতো তাই যা কেনাকাটা করার সবাই করে নিলো।

আমরা যখন ফেস্টিভাল এর মাঠে ফিরলাম তখন সব অনুষ্ঠান শেষ, কিছু ছেলে মেয়েরা স্টেজ এ উঠে যার যা খুশি মাইকে গান গাইছে। ডিজে বেচারাও আর বসে না থেকে ড্যান্স বিটস বাজাতে শুরু করল। সবাই আরও খুশি হয়ে নাচতে শুরু করল। বিদেশিরাও বাদ রইল না। আমরাও সামিল হলাম সবার সাথে। সবচেয়ে ভাল লাগল যে জিনিসটা, ছেলে বা মেয়েদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই সবাই মিলেমিশে একই রকম ভাবে আনন্দ করছে আর অর্গানাইসারদের তরফ থেকেও কোন কড়া বিধিনিষেধ নেই এটা করবেন না বা এখানে যাবেন না, সবটাই বেশ উনমুক্ত সবার জন্য, হয়ত জনসংখ্যা কম হবারই সুবিধে এগুলো।

৭ঃ৩০ নাগাদ অবশেসে সাঙ্গ হল সেদিনের পর্ব। আমাদের আবার অনেকটা হেঁটে ফিরতে হবে হোটেলে তাই আর দেরি করলাম না। রাস্তায় যথেষ্ট আলো ছিল তার সাথে ছিল ফুটফুটে পূর্ণিমার চাঁদের আলো। তাই হেঁটে ফিরতে একটুও সমস্যা হচ্ছিল না। তাপমাত্রা তখন ৮ ডিগ্রি এবং ফোরকাস্ট বলছিল মধ্যরাত এ তা নামতে চলেছে ৫ ডিগ্রিতে। হোটেল এ ফিরতেই আমাদের ডিনার করে নিতে বলা হল। মেনু ছিল ভাত, ডাল, পাপড়,সবজি আর চিকেন, সব ই খুব গরম গরম, ঠাণ্ডার দিন এ ঠিক যেমন টা হওয়া দরকার। সবাই খেয়ে নিয়ে উপরে একটা ঘরেই বসা হল এবং আড্ডা চলল প্রায় রাত ২টা অবধি। সবাইকে গুড নাইট জানিয়ে শুয়ে পরলাম দুটো মোটা কম্বলের নিচে শরীরটা কে ঢুকিয়ে দিয়ে। পরের দিন সকাল সকাল উঠে আবার যেতে হবে যে ফেস্টিভাল এ।

সকালে ঘুম ভাঙ্গল ৭ঃ৩০ এ এক ফ্রেন্ড এর ডাকে। ঘুম থেকে উঠেই চটজলদি তৈরি হয়ে নেওয়া যে যার মতো। প্রাতঃরাশ এ আমাদের জন্য ছিল ব্রেড টোস্ট, বাটার, অমলেট আর চা। একেবারে সব রুম ছেড়ে দিয়ে সিটিং রুম এ সবার ব্যাগ গুলো রেখে দিয়ে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম ফেস্টিভ্যাল এর উদ্দেশে। আবার একই পথে হাঁটা এবং ফেস্টিভ্যাল গেট এর কাছে পৌঁছে গেলাম। ওইদিনের রিস্ট ব্যান্ড এর রঙ ছিল কমলা। প্রথমে ঢুকেই আবার আনারস এর খোঁজ। সবাই দুটো স্টিক আনারস খেয়ে ও বাড়ির জন্য আনারস, কিউই নিয়ে তাড়াতাড়ি করে পৌঁছে গেলাম সোজা ফেস্টিভ্যাল গ্রাউন্ড এ। সময় তখন ৯ঃ৩০ এবং অনেকেই আসন সংগ্রহ করে বসে গিয়েছে। আমরাও ভাল জায়গায় পছন্দমত আসন নিয়ে বসে গেলাম গ্যালারিতে। এর পর একে একে নাগা উপজাতি দের পারফর্মাররা উপস্থিত হলো।

অনুষ্ঠান শুরু হবার একটু আগে শুরু হল দল গুলোর একে একে নাম ডাকা উপস্থিতি জানানো। নিজের দলের নাম শুনে সাড়া দেবার ধরণ ও এক এক দলের এক এক রকম। কেউ গান গেয়ে, কেউ ঢোল বাজিয়ে আবার কেউ চিৎকার করে সমবেত ভাবে। এরপর উপস্থিত হল ওইদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, একজন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা যিনি সিয়াচেন সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পদস্থ ছিলেন তাঁর কর্মজীবনে। তাঁর একটি ছোট উদ্বোধনী ভাষণ এর পরেই শুরু হয়ে গেল এক একটি করে দলের পারফর্মেন্স। এর মধ্যে ছিল সব নর্থ ইস্ট এর রাজ্যগুলোর বিভিন্ন ধরনের নৃত্য ও নাগা উপজাতিদের বিভিন্ন শিল্পকলা যেমন কুস্তি, হেড হান্টারসদের শিকার এ যাওয়ার আগের প্রস্তুতি এরকম আরও বর্ণময় অনুষ্ঠান।

প্রথম পর্বের সকালের সেশন শেষ হল ১১ঃ৩০ এ। আমরা তাড়াতাড়ি করে বেড়িয়ে চিকেন চাউমিন দিয়ে লাঞ্চ সেড়ে নিলাম ও আবার চলে গেলাম গ্যালারিতে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হল ১ টা থেকে। এই র্পবে একটি নাটক এর মাধ্যমে দেখান হল কিভাবে দুটো নাগা গ্রাম -এর মধ্যে লড়াই বাঁধে। এভাবে দেখান হলো যে দুজন মহিলা বসে বাজার এ কিছু বিক্রি করছে। দুজন পুরুষ তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এবং মহিলা দুজনকে পছন্দ হওয়াতে তাদের কাছে গেল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। এই ঘটনা পাশ দিয়ে আরও দুজন লোক যাচ্ছিল, তারা দেখতে পেল এবং তাদের মনে হিংসে হল। তারা লুকিয়ে রইল রাস্তার ধারে আর ওই লোক দুটো যখন ফিরছিল অতর্কিতে তাদেরকে আক্রমন করে মেরে এরা পালিয়ে গেল। এই দুজন আহত অবস্থায় কোন মতে গ্রামে ফিরে গিয়ে সবাইকে বলল ও এদের গ্রাম থেকে পাশের গ্রামকে আক্রমন করা হলো। প্রথমে শুরু হল একে অপরের দিকে পাথর ছোঁড়া তারপর ক্রমশ কাছাকাছি এসে খণ্ডযুদ্ধ। মহিলারা বাঁশের তৈরি পাত্র করে জল এনে বিপক্ষের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে আর পুরুষরা এক এক জনকে মেরে ধরাশায়ী করে দিচ্ছে। এভাবে একটি দল জয়লাভ করল। খুবই সুন্দর পরিবেশনা ছিল নাটকটির এবং দর্শকরাও দারুন ভাবে উপভোগ করলো। আরও কিছু অনুষ্ঠানের পর আমরা গ্যালারি ছেড়ে হোটেল এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম কারন আমাদের গাড়ি বলা ছিল ৩ টার সময়। আমরা হোটেল এর ম্যানেজারকে বিদায় জানিয়ে ৪ টায় আবার যাত্রা শুরু করলাম ডিমাপুর স্টেশন এর দিকে। রবিবার ছিলো তাই গাড়ি পাওয়া খুব একটা সহজ ছিলো না, আমাদের তাই দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েই যেতে হলো।

রাস্তায় ১-২ টি বিরতি দিয়ে ডিমাপুর পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। স্টেশন এর পাশেই একটি ধাবাতে ডিনার করে আমরা ট্রেনে উঠে পড়লাম। পরের দিন ভোর ৩ঃ৪০ মিনিটে পৌঁছে দিল ট্রেন গুয়াহাটি। ভোরের অন্ধকারেই ঊবার ধরে আমরা চলে গেলাম এয়ারপোর্ট। আমাদের ফ্লাইট ছাড়ল ১ ঘণ্টা দেরিতে। কলকাতা পৌঁছে আবার সবাই যে যার মত চলে গেলাম অফিসে। খুবই ক্লান্তিকর ভ্রমণ হলো আমাদের, হয়ত আর একটা দিন বেশি থাকলে ভাল হতো। তবু এই সীমিত সময়ের ভ্রমনেও নাগাল্যান্ড এর সৌন্দর্য আমাদের সকলকে মুগ্ধ করেছিল।

সবশেষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

  • কলকাতা থেকে নাগাল্যান্ড (Nagaland) যাবার সহজতম উপায় হয় গুয়াহাটি হয়ে ট্রেন- এ ডিমাপুর বা সোজা ফ্লাইট এ ডিমাপুর। তবে ফ্লাইট দিনে ১ টি বা ২ টি।
  • ডিমাপুর গেলে ILP দরকার নেই, তবে কোহিমা বা অন্য কোন জায়গায় গেলে এটি অত্যাবশ্যক। কলকাতার সেক্সপিয়র স্মরণীতে নাগাল্যান্ড হাউস থেকে ৫১ রুপীর বিনিময়ে এটি পাওয়া যায়। দুপুরের মধ্যে গেলে দিনের দিনই বানিয়ে দেয়।
  • হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল হয় প্রতি বছর ১ লা থেকে ১০ ডিসেম্বর। হোটেল বুকিং যত আগে থেকে করা যায় সস্তা পরবে।
  • ডিমাপুর থেকে কোহিমা যাওয়ার শেয়ার গাড়ি এখনকার রেট ১৭০ রুপী প্রতি সিট। রিসার্ভ গাড়ি ২০০০-২৫০০ বড় ও ১৫০০-২০০০ ছোট।
  • কোহিমা তে জোকু ভ্যালিতে ট্রেক করা যায় একই দিনে যাওয়া আসা, হাত এ সময় থাকলে এটি খুব সুন্দর একটি জায়গা। এছাড়া ওয়ার মেমোরিয়াল, মিউসিয়াম, খনোমা গ্রাম অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যস্থল।
  • বর্ষাকাল এর দুই মাস বাদ দিয়ে সাড়া বছর যাওয়া যায় এখানে তবে শীতকালে গেলে ভারী শীতের পোশাক অত্যাবশ্যক।
  • রবিবার নাগাল্যান্ড এর সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ওইদিন সব কিছু বন্ধ এমনকি গাড়িও সীমিত সংখ্যক চলে। যেখানেই যাবেন আসা-যাওয়ার ভাড়া গুনতে হবে। এটা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা ভালো।

আমরা যেখানে রাত্রিবাস করেছিলাম তার তথ্যঃ

Vicha Paying Guest
Owner: Jhatho
Phone: 094364 37930

আমাদের ড্রাইভার এর ফোন – 9856351870

Leave a Comment
Share