ঈদের ছুটিতে ধুপপানি,মুপ্পোছড়া ও ন-কাটা ঝর্ণা আভিযান

ধুপপানি ঝর্ণার খোঁজ পেয়েছিলাম সেই ২০১৫ এর শেষের দিকে। ছবি দেখেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় ১৬০ফিট উপর থেকে পানি আছড়ে পড়ে। তখন থেকেই অনেকবার প্ল্যান করেও বিভিন্ন কারণে যাওয়া হয়নি। আগেতো সেখানে রবিবার ছাড়া যাওয়া যেত না, কারণ ঝর্ণার উপরে এক বৌদ্ব ভিক্ষু(ভান্তে) ধ্যান করতেন। উনি সারা সপ্তাহ ধ্যান করতেন আর রবিবার নিচে নেমে এসে পানাহার করতেন তাছাড়া ধুপপানি পাড়াটা পবিত্র জায়গা। তাই সপ্তাহের যেকোন দিন যাওয়া যেত না। এখন অবশ্য সেই নিয়মটা শিথিল, এখন যেকোন দিনই যাওয়া যায়। তবে ওখানে কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত চিল্লাচিল্লি করা যাবে না।

১ম দিন (১৮ জুন,২০১৮)

আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঈদের ৩য় দিন (১৮জুন, ২০১৮) কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে। সকাল ৬:৪৫-এ কাপ্তাই রাস্তার মাথায় চেক ইন (সবাইকে তাড়াতাড়ি আসার অনুরোধ করা হয়েছিল)। সবাই ঠিকমতো এসেছিলও।

ধুপপানি ঝর্ণায় যাওয়ার সময়

সকাল ৭:০০ টায় কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে সিএনজিতে আমরা যাত্রা শুরু করি এবং ৯ টার মধ্যে কাপ্তাই নতুন বাজার পৌঁছে আমরা সকালের নাস্তা করি। আমাদের নৌকা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল এবং মাঝিও আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা ১২ জন ছিলাম কিন্তু ১ জন আমাদের সাথে যেতে পারেন নাই, উনার ফ্যামিলিতে একটু প্রব্লেম হয়েছিল। তাই উনি কাপ্তাই থেকেই চলে গিয়েছিলো। আমাদের ট্রলারটা যথেস্ট বড় ছিল। 

সকাল ৯:৩০ টায় কাপ্তাই ঘাট (নতুন বাজার) আমরা ১১জন থেকে উলছড়ির উদ্দেশ্যে ট্রলারে ভ্রমণ শুরু করি। ১ম দিনে আমাদের হয়তো বিস্কুট, মুড়ি, চানাচুড় ইত্যাদি শুকনা খাবার খেয়েই থাকতে হতে পারে। দুপুরের ভাত নাও জুটতে পারে কারন আমরা ১ম দিনেই ধুপপানি ঝর্না দেখে আবার উলছড়িতে নৌকায় রাতে থাকবো। এরকম মানসিকতা থাকতে হবে – এটা সবাইকেই বলা হয়েছিল। সেজন্যই সবাইকে সকালবেলা তাড়াতাড়ি আসার অনুরোধ করা হইয়েছিল। এটাও বলা হয়েছিল যদি সম্ভব হয় পথে কোথাও দুপুরের ভাত খেয়ে নিব (ভাত, ডাল, ভর্তা, সবজি)। তবে সময় একেবারের নষ্ট করা যাবেনা। আমরা ঐ দিন দুপুরে ভাত খাইনি। ট্রলারে ঊঠে আমরা আগের দিনে ক্রয় করা ৪ কেজি ওজনের ২টা মুরগী সব ধরনের মসলা মাখিয়ে ম্যারিনেট করে রাখলাম কারণ আমরা রাতে দম বিরিয়ানি খাবো।

ধুপপানি ঝর্ণা

এরপরে যে যার মতো করে ট্রলারের ছাদে ঊঠে কেউবা কোনায় দাঁড়িয়ে ফটোশেসন শুরু করে দিল। এখন বর্ষাকাল, তাই কাপ্তাই লেকের পানি যথেস্ট ঘোলা ছিল। আমরা সাথে করে স্টোভের চুলা নিয়েছিলাম, নৌকাতেই সব ধরনের রান্না করেছিলাম। উলছড়িতে পৌছানোর ঘন্টা খানিক আগে আমরা নূডলস করে খেয়েছিলাম। পথে আমাদের ২ যায়গায় বিজিবি ক্যাম্পে নাম লিখাতে হয়েছিল (ভোটার আইডির ফটোকপি অবশ্যই রাখতে হবে)।

আমরা দুপুর ১.৩০ মিনিটের দিকে উলছড়িতে পৌঁছানোর পর গাইড ঠিক করে ঐ ঘাট থেকেই ২০ মিনিটের কোষা নৌকা(ছোট নৌকা) পার হয়ে মূল ট্র্যাকিং এ ঢুকেছিলাম(গাইড অবশ্যই নিতে হবে)। এরপর শুরু হল ২-২.৫ ঘন্টার পাহাড়ি পথে ট্র্যাকিং। আমরা যেসময় ট্র্যাকিং শুরু করলাম তখন মাথার উপর সূয্যিমামা বেজায় বেজাড়, গরমও বেশ ছিল আমরা অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, মোট ৩ টা পাহাড় পার হবার আমরা ধুপপানি পাড়ায় পৌঁছুলাম, তখন ঘড়িতে ৩:৩০,সেখানে অল্প কিছুক্ষন জিরিয়ে নিয়ে ২০ মিনিটের পাহাড়ি পথ পেড়িয়ে নিচের দিকে নামতে নামতে ঝিরি পথ ধরে আমরা বিশাল ধুপপানি ঝর্ণার (Dhuppani Jhorna) কোলে চলে এলাম, পাহাড় থেকে যখন নামছিলাম তখনই এই ঝর্ণার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল,দুধসাদা ধুপপানি ঝর্ণার বিশালতায় আমরা মুগ্ধ, সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই শেষ করে দিচ্ছিল অনিন্দ্যসুন্দর ধুপপানি ঝর্ণা, সবচেয়ে আনন্দের ব্যপার ছিল ঝর্ণার ১টা অংশে গিয়ে ভিতরে গিয়ে বসে থাকা যায়, ঐ যায়গাটা অসাধারণ!

ধুপপানি ঝর্ণার নিচে

১ ঘন্টা ধুপপানি ঝর্নায় দাপাদাপি আর ফটোশেসন শেষ করে আমাদের ব্যাক করার তাড়া ছিল,কারণ আমরা নৌকায় রাতে থাকবো আর পাহাড়ে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয় তাই দ্রুত পা চালিয়ে উলছড়িতে আসতে হল। উলছড়িতে ফিরে আমরা নৌকা নিয়ে মাঝির পরিচিত একটা দ্বীপ সদৃশ গ্রামের ঘাটে(বিলাইছড়ির আশেপাশে) পৌঁছুলাম। সেখানে কিছুক্ষন জিড়িয়ে নিয়ে শুকনা খাবার খেয়ে গল্পের ছলে ছলে রাতের খাবারের আয়োজন শুরু করলাম। টর্চ, মোবাইলের লাইট গ্বালিয়ে আমরা দম বিরিয়ানি রান্নার প্রস্তুতি শুরু করলাম। রাতের খাবারের মেন্যুতে ধুঁয়া ঊঠা গরম গরম দম বিরিয়ানি আর স্পেশাল সালাদ ছিল। রাতে বিশেষ আয়োজনে গান আর আড্ডার আসরও ছিল।

শহরের কোলাহল, ব্যস্ত জীবন, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেষ ভূলে,শহর থেকে অনেক অনেক দূরে নির্জন পাহাড়ি এলাকার এক ছোট্র দ্বীপ সদৃশ ঘাটে, সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে নুয়ে ঝিঝি পোকার ডাক শুনে,খোলা আকাশে  তারার মিটমিটি আলোয় নৌকায় আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

২য় দিন (১৯ জুন, ২০১৮)

সকাল বেলাটা শুরু হয়ে ছিল চারিদিকে মেঘে ঢাকা এক স্বর্গীয় পরিবেশে। সকাল বেলায়  ঘাটে আমরা নাস্তা সেড়ে(আগের দিনের বেঁচে যাওয়া দম বিরিয়ানি আর কফি) আমরা বাঙ্গলকাটার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মাঝখানে ১টা গ্রামে নেমে আমরা কেউ কেউ চা-পরোটাও খেলাম। গ্রামটার নাম মনে পড়ছেনা এবং বিলাইছড়ির বিজিবি ক্যাম্পে আমরা পুনরায় চেক আউট দিলাম।

মুপ্পোছড়া ঝর্ণা

৯টার পর বাঙ্গলকাটা পৌঁছে সেখান থেকে গাইড নিয়ে আমরা মুপ্পোছড়া (Muppochora) ও ন-কাটা (No-kota) ঝর্নার উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করলাম। বাঙ্গলকাটা গ্রামটা অনেক সুন্দর, ছিমছাম গুছানো, পাহাড়ের উচু নিচু টীলায় আদিবাসীদের ঘরগুলোও দেখার মত,ঘন্টাখানিক পাহাড়ি ঝিরি পথ যেতে যেতে আমরা মুপ্পোছড়ায় পৌঁছুলাম।

মুপ্পোছড়া ঝর্নাটাও অনেক লম্বা, সেখানে কিছুক্ষন ঝর্না দর্শন শেষ করে ন-কাটার দিকে রওনা দিলাম। ন-কাটা ঝর্নাটা ছবি দেখে মনে হয়েছিল শুধু ক্যাসকেড কিন্তু ওটার সামনে গিয়ে বুঝলাম সেটাও কোন অংশে কম নয়। সেখানেও কিছুক্ষন ঝর্না দর্শন শেষ করে আমরা বাঙ্গলকাটা দিকে রওনা দিলাম।

মুপ্পোছড়া ও ন-কাটা ঝর্না যাবার পথটা খুব সুন্দর, অনেক ক্যাসকেড ছিল, যা এর সৌন্দরয্যটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ধুপপানি যেতে যে পরিমান এনারজি নষ্ট হয় মুপ্পোছড়া ও ন-কাটা ঝর্না যেতে তার কানাকড়িও যায় না। মুপ্পোছড়া ও ন-কাটা ঝর্না অভিযান শেষ করে দুপুর ১২টার মধ্যে বিলাইছড়ি আসলাম।  

বিলাইছড়িতে আমরা বকুলের হোটেলে দুপুরের ভাত খেয়ে আশেপাশে ঘুড়ে বিলাইছড়ি থেকে কাপ্তাই আসলাম এবং আমাদের ২ দিনের জন্য রিজার্ভ করা নৌকা ও নৌকার মাঝিকে বিদায় দিলাম। দুপুর ৩:০০ টায় আমরা কাপ্তাইয়ে পৌঁছুলাম। নৌকার মাঝি রুবেল মিয়া অনেক ভাল আর হেল্পফুল ছিল।

কাপ্তাই পৌঁছে আমরা চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে বাসে রওনা দিলাম। সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে আমরা চট্রগ্রাম আসলাম এবং আমাদের ২দিনের স্মৃতিময় সফল ট্যুর শেষ হলো।

Leave a Comment
Share