ধুপপানি ও মুপ্পাছড়া ঝর্ণা ভ্রমণ

ধুপপানিমুপ্পাছড়া ঝর্নার কথা টিওবি গ্রুপে দেখতে দেখতে নিজেদের আর সামলে রাখতে পারছিলাম না। অগাস্ট এ যাবার প্লান ছিল কিন্তু বিধি বাম টানা বৃষ্টির জন্য যাওয়া হল না। কি আর করার মন খারাপ করে ক্যালেন্ডার ঘাটতে রইলাম ছুটির আশায়। অক্টোবর এ কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু পানি থাকবে কিনা এই নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম। আল্লাহ ভরসা বলে অক্টোবর এ ট্যুর প্লান ফাইনাল করে ফেললাম। যেই বলা সেই কাজ, বাসের টিকিট কনফার্ম করে ফেললাম। ২৯ অক্টোবর ঢাকা থেকে কাপ্তাই এবং ১ তারিখ কাপ্তাই থেকে ঢাকা। ফোনে কাপ্তাইর রিটার্ন টিকিট বুকিং করাটা বুদ্ধিমান এর কাজ হবে। পুজার ছুটি ও আশুরার বন্ধ একসাথে হওয়াতে বিলাইছড়িতে থাকার জায়গা নিয়ে একটু বিপদে পরে গেছিলাম।

শরতের কাপ্তাই

যাই হোক পরে আমাদের এক এডমিন ভাই এর শ্বশুর বাড়ির বদৌলতে ভিআইপি একটা জায়গা পেয়েছিলাম। আপনারা নিরিবিলি বোর্ডিং (মোবাইল ০১৫৫৩১২৮৬৭৬, ০১৮২৭৭২২৯০৫) এ থাকতে পারবেন। ৪ জনের ডাবল বেডের রুম ৫০০ টাকা, ২ জনের সিঙ্গেল বেডের রুম ৩০০ টাকা- ফিক্সড। ফ্রেন্ডরা মিলে গেলে ট্রলার এ ও রাতে থাকা যায়। সেটা অবশ্যই আরও মজার। যাইহোক এবার ট্যুর এর ফুল বর্ণনা-

১. ঢাকা থেকে কাপ্তাইঃ ২৯ তারিখ শ্যামলীর বাসে কাপ্তাইএর উদ্দেশে রওনা। ভাড়া ৫৮০।

২. ৩০ তারিখ সকালে কাপ্তাই থেকে বোঁট ভাড়াঃ দুই ভাবে বোঁট ভাড়া পাওয়া যায়। লোকাল এবং রিজার্ভ। আমরা লোক ১১ জন ছিলাম তাই রিজার্ভ এ নিয়ে ছিলাম। ২ দিনের জন্য (কাপ্তাই থেকে ধুপ্পানি হয়ে বিলাইছরি, বিলাইছরি থেকে মুপ্পাছড়া হয়ে কাপ্তাই), ভাড়া নিয়েছিল ৫০০০ টাকা। মাঝির নাম ছিল রুবেল, বেশ ভাল ছেলে। বেশি মানুষ হলে রিজার্ভ করাই ভাল। তাহলে আমাদের মত সব কিছুই কাভার করা সম্ভব হবে। আর মজাটাও হবে বেশি।

৩.ধুপপানিঃ আমাদের কাপ্তাই লেক এ কায়াকিং করার প্লান ছিল তাই প্রথম দিন এ ধুপপানি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের ভাগ্য বেশ ভাল ছিল, একমাত্র শনিবার কাপ্তাই হাঁট বসে। যা লাগে সব ই পাওয়া যায়। আমরা ২ দিন এর জন্য শুকনা খাবার ও ফল বলতে লোকাল কমলা-৫ টাকা পিস, আঁখ, জাম্বুরা, পাকা কলা, শসা ইত্যাদি কিনে নিলাম। অন্য দিনে গেলে নতুন বাজার এ সব পাবেন। দাম হয়তোবা একটু বেশি পরবে। সকাল ১০ টায় আমাদের বোঁট স্টার্ট দিল। কাপ্তাই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের যে কি মুগ্ধ করে ছিল তা লিখে বুঝানো সম্ভব না। শরৎ কাল থাকায় লাইফ এর বেষ্ট ভিউ দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল যে অন্য কোন দেশের দৃশ্য দেখছি।

সবাই দাঁতে ধার দিতে ব্যস্ত

৪ ঘণ্টার লম্বা জার্নি করে ২ টার সময় উলুছড়ি পৌঁছেছিলাম। ওখান থেকে ছোট ডিঙি নৌকা নিতে হবে। প্রতি নৌকায় (৩০০টাকা) ৪/৫ জন বসতে পারে। গাইডের খরচ বাবদ (সংস্কার চাঁদা ২০০ টাকা+ গাইড ৫০০ টাকা=) ৭০০ টাকা- দিতে হবে।

২০ মিনিটের মত নৌকা জার্নি করে হাটা শুরু করতে হবে। পথে ২ টা পাহাড় পার করতে হবে। প্রথম দিকে মনে হবে যাওয়া অসম্ভব। শরীর বলবে সারা রাত বাস জার্নি করে রোদের মধ্যে ৪ ঘণ্টা বোঁটে করে দুপুরে নাম মাত্র খাবার খেয়ে এত উচুতে যাওয়া অসম্ভব। মনকে বুঝতে হবে কোন ব্যাপার না। কিছু অর্জন করতে হলে তো কিছুটা ত্যাগ শিকার করতে হবেই। সত্যি বলতে মনের জোর ছাড়া ওখানে যাওয়া টা অনেকটাই অসম্ভব। আমাদের ১১ জনের মধ্যে এক বর ভাই ও ভাবি কষ্টের কারনে বোঁট এ ফেরত চলে গেলেন। উঠতে উঠতে জান শেষ। আমারা যখন যাচ্ছিলাম পথে অনেককেই পেলাম, কিন্তু সবাই ঝর্ণা দেখে ফিরছিল। যাকে ই জিজ্ঞাস করছিলাম ভাই কতদুর? উত্তর একটাই মাত্র উঠা শুরু করছেন সামনে অনেক কষ্টকর পথ আছে। শুধু একটা দল পেয়েছিলাম যারা বলল ভাই স্টেপ বেশির ভাগ উঠে গেছেন আর ৫ মিনিট উঠলেই সমতল। মনে যে কি শক্তি পেয়েছিলাম বুঝান যাবে না। আমাদের মনে একটা বড় ভয় কাজ করছিল দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে। পাহাড়ে সন্ধ্যা হয় খুব তাড়াতাড়ি সাথে কোন লাইট নেই বলে খুব টেনশন এ ছিলাম। প্রায় ১.৪৫ ঘন্টার মতো অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ধুপপানি পাড়ায় পৌঁছাবেন। এখানে একটা দোকান আছে সেখানে চাইলে চা বিস্কুট জাতীয় কিছু খেয়ে নিতে পারবেন। এর পর সবচেয়ে রিস্কি একটা ঢাল পার করতে হবে। সাথে অবশ্যই দড়ি নিয়ে নিবেন। ২৫-৩০ মিনিট পর পৌছে যাবেন কাক্ষিত লক্ষ্য – ধূপপানি ঝর্ণায়। দূর থেকে এর সুন্দর রূপ আমাদের এততাই মুগ্ধ করে ছিল যে ৪:৫০ ঘণ্টার জার্নিকে কয়েক সেকেন্ড এ ভুলে গিয়েছিলাম।

নৌকাতে আমরা কয়েকজন

ভাগ্য ভাল ছিল যাবার সময়ে অনেক বৃষ্টি হয়ে ছিল তাই ঝর্নাতে অনেক পানি ছিল আর এত বাতাস ছিল যে ব্যালেন্স রাখাটাই কষ্টকর ছিল। ১০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতার এই ঝর্ণার পানি নিচে পরতে পরতে ধোয়ার সৃষ্টি করে। এই জন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে ধূপপানি ঝর্ণা। আসলে এটি একটি তীর্থের জায়গা তাই এমন কোন কাজ করা উচিত নয় যাতে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগে। ১ ঘণ্টা লাফালাফি দাপাদাপি করে বোটে ফেরার জন্য রওনা দিলাম তখন বাজে সাড়ে চারটা। গল্প করতে করতে কখন যে যেখান থেকে ছোট নৌকা ছাড়ে ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম তা বুজতেই পারিনি। উলুছড়ি পৌঁছেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।

ধুপপানি ঝর্নার সামনে আমরা

৪. উলুছড়ি থেকে বিলাইছরিঃ আসার সময় আর্মি বলে দিয়েছিল ৫ টার মধ্যে রিপোর্ট করতে আমরা প্রথম ক্যাম্প এ যখন যাই তখন বাজে ৭ টা। বুজতেই পারছেন কি অপেক্ষা করতে ছিল। কিছু নীতিকথা শোনার মাধ্যমে আমাদের রিপোর্ট শেষ হয়েছিল। ফেরার পথ টা ছিল অবর্ণনীয় সুন্দর। চাঁদনী রাত বোঁটের ছাদে বসে চানাচুর মুড়ি মাখানো খেতে খেতে শুনশান পরিবেশে ভুতের গল্পের আড্ডাটা বেশ জমে ছিল।

৫. রাত কাটানঃ ট্যুরে গিয়ে চুপচাপ রাত কাটানো যে একেবারেই অসম্ভব আমাদের পক্ষে। ঢাকা থেকেই প্ল্যান করে গিয়েছিলাম রাতে বার-বি-কিউ করবো। কয়লা, মশলা ও আনুসাঙ্গিক সব কিছু ঢাকা থেকেই নিয়ে আসছিলাম। রান্না ঘরে ভাবিরা খিচুরি আর বারান্দাতে আমাদের স্পেশাল বাবুর্চি মেহেদী (নন প্রফেশনাল) তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বার-বি-কিউ বানানোর কাজে লেগে গেল। পরটা, খিচুরি আর বার-বি-কিউ, সবাই একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। খেতে খেতে ১ টা বেজে গিয়ে ছিল। আমরা যেখানে ছিলাম তার পাশেই খুব সুন্দর একটি ব্রিজ ছিল। খাওয়ার পরে সবাই গেলাম ওখানে ঘুরতে।

বার-বি-কিউ বানানোর কাজ চলছে

৬. বিলাইছরি থেকে কাপ্তাইঃ সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে গেলাম মুপ্পোছড়া ঝর্না দেখার জন্য। রাতের রান্না করা ভুনা খিচুরি আর ডিম ভাজি দিয়ে বোটে বসে নাস্তা করে নিলাম। কলা পাতায় ভুনা খিচুরি ভালই ছিল খেতে। নাস্তা করতে করতে পৌঁছে গেলাম বাঙ্গালকাটা। ওখান থেকে হাটা শুরু করতে হবে। মাঝিকে বলে রাখলে ঐ গাইড ঠিক করে রাখবে (৫০০ টাকা নিবে)। পাহাড় আর ঝিরির সংমিশ্রণে ঝর্নার যাবার পথটা ছিল অবর্ণনীয় সুন্দর। ১:৩০ মিনিট হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত মুপ্পাছরা ঝর্নাতে।

কিছুটা খাঁড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হয়

আমাদের হাতে সময় ছিল অনেক তাই অনেকটা সময় নিয়ে ঝর্নাতে গোসল করে ছিলাম। ফিরে আসার পথে কিছু জাম্বুরা কিনেছিলাম আর আমাদের রুবেল ভাই কিছু গুঁড়া মরিচ ও লবণ যোগাড় করে দিলেন। ব্যাস চটপট জাম্বুরা মাখানো বানিয়ে ফেললাম। ওখান থেকে কাপ্তাই প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। কাপ্তাই আসব আর লেক এ গোসল করবো না তা কি হয়, মাঝিকে বলে রাখলাম সুবিধামত এক জায়গায় থামতে। দুপুরের খাবারের ব্যাপারে আগেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম। রুবেলর পরিচিত একজনের বাসা একেবারে কাপ্তাই লেকের সাথে। ঐ বাসায় আমাদের দুপুরের খাবারের বাবস্থা করা হয়েছিল। খাবারের আইটেম ছিল অসাধরণ। ভাত, হাসের মাংস, আলু ভর্তা আর ডাল। প্রায় ১ ঘণ্টা লেক এ গোসল করে সবাই গেলাম খেতে। আহ রান্নাটা ছিল অসম্ভব মজার ।

মুপ্পাছড়ায় ফটোসেশন ব্যস্ত সবাই

৭. কায়াকিংঃ আমাদের বাস সেই রাত ৮ টায়, হাতে অনেক সময়। বোটে করে কাপ্তাই এসে সবাই মিলে গেলাম কায়াকিং করতে। ট্রলার ঘাঁট থেকে সিএনজি পাওয়া যায়। ১২০ টাকা ভাড়া। বন্ধের কারনে অনেক ভিড় ছিল। আমাদের অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়ে ছিল। আগে থেকে বুকিং করলে অনেক সময় সেভ করা যায়। ঘণ্টা ৩০০ টাকা, ছাত্র ও ছাত্রী দের জন্য ৫০ টাকা ছাড় (আই ডি কার্ড দেখাতে হবে)।

কায়াকিং মুহূর্ত

৮. যান্ত্রিক শহরে ফেরাঃ কায়াকিং শেষ করে সরাসরি বাস কাউন্টার এ চলে আসলাম। সময়মত বাস ছেড়েছিল। বাসে আসতে আসতে চিন্তা করতে লাগলাম নেক্সট ট্যুর এর কথা।

কিছু টিপস

  • ভোটার আইডি কার্ড এর ফটোকপি ( অবশ্যই লাগবে)
  • হাটার উপযোগী জুতা।
  • রবি ও টেলিটক এর নেটওয়ার্ক আছে।
  • ঝর্নায় ছবি তুলতে চাইলে পানি নিধরক মোবাইল নিতে হবে।

কিছু দরকারি নাম্বার

শ্যামলী কাপ্তাই– মনা ভাই- ০১৭৫৪৭৮৩৪৩০
নিরিবিলি বোর্ডিং – মোবাইল ০১৫৫৩১২৮৬৭৬, ০১৮২৭৭২২৯০৫
রুবেল মাঝি- ০১৮৬১৬৬৩২২৯
কাপ্তাই কায়াক ক্লাব – ০১৭৫৩২২২২৮৬

Leave a Comment
Share