বাতাসিয়া লুপ
আমাদের গাড়ি এসে থামল ঘুম মনেস্ট্রী। এর বাইরে ও ভিতরে সিঁড়ির ধাপে ধাপে পসরা সাজিয়ে বসে আছে পাহাড়ি মেয়েরা। রং বেরংয়ের চাদর, টুপি, গরম জামা আরো কত কি! সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে অনেকটা জায়গা জুড়ে এই মনেস্ট্রী। বেশি ভিড় নেই। লামার লাল লাল পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট বাচ্চারা। যেন এক একটি লাল ফুল। ভিতরে বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি ধ্যানাসনে বসে। চারিদিক ভীষণ চুপ চাপ। কয়েকটা ছবি তুলে আমরা চারদিক টা ঘুরে দেখলাম। কিছু সময় কাটিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ম্যাল রোড দিয়ে ওপরে উঠতে আমাদের প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লেগে গেল। প্রথম দার্জিলিং দেখলাম, চারিদিকে এখানকার মতোই বড় বড় বিল্ডিং আর ঘিঞ্জি গায়ের ওপর বাড়ি। বিশাল জ্যাম। সারা রাস্তা জুড়ে গাড়ির পর গাড়ি। এতো কলকাতার থেকেও খারাপ অবস্থা বলে মনে হল। আমাদের বুকিং ছিল Darjeeling Tourist Lodge এর। সব ফর্মালিটি সেরে যখন ঘরে গেলাম মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। বদ্ধ পরিবেশ। ঘর ঘেকে কিছুই দেখা যায় না। তবে বাইরের ব্যালকনি থেকে পাহাড়ের শোভা দেখা যায়, আর ঘর বেশ পরিষ্কার , বাথরুম ও বেশ বড় এবং সুন্দর। আসা মাত্রই বোতলে নরমাল আর ফ্যাক্স এ করে গরম জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষন বাদেই বুঝলাম পাওয়ার ব্যাকআপ এর সুবিধা। স্নান সেরে আমরা লাঞ্চ করতে গেলাম, আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। বাইরে খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও এখানেই খেতে হবে। ভাত, ডাল, আলুভাজা আর মাছের ঝোল। এখানে প্যাকেজ সিস্টেম নেই। খেতে বসে একটু অপ্রতিভই হলাম। আগেকার ফুড কোয়ালিটির সাথে অনেকটাই তফাৎ। খাওয়া সেরে একটু রেস্ট নিয়ে বিকালে যাওয়া যাবে ‘ম্যাল’ এ। বিকালে বৃষ্টিটা কমে গেলে বেরলাম, সারা বিকাল কাটল ওখানেই। কত লোকের আনাগোনা, যেন মেলা বসেছে। নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে লোকজন চা, নানান খাবার, বেলুন কোনো কিছুরই অভাব নেই। ডিনার সেরেই ফিরলাম, কারণ এখানে তাড়াতাড়িই সব বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের সকালে joy ride এর বুকিংও আছে সকাল ৭ঃ৪০ এ। রাতের খাবার বেশ ভালোই হল। হোটেল মহাকালে। ফ্রাইড রাইস আর ডিমের কারি। দারুন রান্না। খালি আমাদের হোটেল থেকে এর দূরত্বটা একটু বেশি।
সকালে যখন বেরোলাম ঘড়িতে ৬ঃ৪০ বাজে। আমাদের ড্রাইভার কুঙ্গা মহাশয় একটা শর্টকার্ট দেখিয়ে দিয়েছিলেন, পায়ে হেঁটেই পৌঁছানো যায় দার্জিলিং স্টেশন। সেই পথ ধরে আমরা ৭ টা ৫ এর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। স্টেশনে বিশেষ লোক নেই। চারপাশটা ঘুরে দেখতে দেখতে মিনিট ২০ কাটল। ততক্ষনে ভরে গিয়েছে স্টেশন joy ride এর জন্য। দার্জিলিং থেকে ঘুম স্টেশন আবার ব্যাক। সবাই যে যার মত ছবি তুলতে ব্যস্ত। একটি non bengali family প্রায় ১৫ জন মত টিমে। ওদের উৎসাহ এবং উত্তেজনা দেখে সাত সকালে চা না খেয়েও আমরা বেশ চার্জড। ওদের ছবি তোলার উদ্ভাবনী পোজ আমাদেরও উৎসাহ দিল। দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন গুলির দরজায়, ড্রাইভারের কেবিনে, বাফার এ কখনও বা ছাদে যেখানে যেখানে ওঠা যায় সেখানে উঠে লোকজন ছবি তুলছে, আমরাও দেখা দেখি সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই নিলাম। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগে শুরু হল বৃষ্টি। সকাল থেকেই মেঘলা করেছিল। এবার ট্রেন ছাড়বে কিনা সেটাই ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। প্রায় ২০ মিনিট বাদে বৃষ্টিটা ধাতস্থ হতে ছাড়ল ট্রেন। টয় ট্রেন আমি আগেও চড়েছি, শিমলা ভাইজ্যাগ। দার্জিলিং এ এই প্রথম। ট্রেন ছাড়ার পর শুধু গায়ের ওপর গায়ে বাড়ি ঘর দেখে মনে হল কলকাতার রাস্তায় ট্রামে চড়ছি। কিন্তু কিছুক্ষন পর বাতাসিয়া লুপ আসতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টির সাথে সব মনখারাপ ধুয়ে গেল। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। একটুকরো সবুজ কে তুলে এনে যেন বসানো হয়েছে এখানে। সুন্দর সাজানো গোছানো এই জায়গাটার জন্য আমাদের ৫ মিনিটই বরাদ্দ। নেমে চারিদিক নিজের না ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখব ভেবে বার করতে করতেই সময় পার হয়ে গেল। যে যার মত দৌড়ে উঠতে লাগল। সবাই মিলিয়ে নিচ্ছে বাড়ির লোকদের, এ উঠল কিনা ও কোথায়, এসবের মধ্যে দিয়েই ট্রেন ছেড়ে চলল আমাদের গন্তব্য ঘুম স্টেশনের দিকে।
বাতাসিয়া লুপ এত সুন্দর আশ মিটলনা। আবার এসে বেশ খানিক্ষন কাটানোর ইচ্ছেটা থেকে গেল, অনেকে এসেছে নিজেদের মত করে , পাহাড়ি পোশাকে সেজে ঝাঁকে ঝাঁকে ছবি তুলছে লোকজন, সবুজের মধ্যে লাল নীল হলুদ কত রং। কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পৃথিবীর উচ্চতম ন্যারোগেজ রেল স্টেশন, ঘুম স্টেশন। এখানে আমাদের আধঘন্টা সময় বরাদ্দ।
স্টেশন এরিয়াতেই ঘুম মিউজিয়াম। ওটাই মূল আকর্ষণ। ভিতরটা সুন্দর সাজানো বাগান, একটা টয়ট্রেন, আর আর বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সাজানো খোলা সংগ্রহশালা। ছবি তোলার অফুরন্ত রসদ। টয়ট্রেনে তো ছবি তোলার রীতিমত লাইন পড়ে গেল। পুরো জায়গাটা ঘুরে শেষ করতে না করতেই ট্রেনের হুইসেল বাজল। এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় আরো একবার দেখলাম দুচোখ ভরে বাতাসিয়া লুপের অনাবিল সৌন্দর্য। বাতাসিয়া ছাড়তে না ছাড়তেই আমাদের একপ্রকার চমকে দিয়েই হটাৎ মেঘের ফাঁকে জেগে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘা! এক্কেবারে হই হই রই রই কান্ড। এর ৫ মিনিট ধরে সবাই মিলে জানালায় হত্যে দিয়ে চেয়ে থাকল যদি আর একবার দেখা মেলে। সব আশায় জল ঢেলে আবার সেই ইঁট পাথর কংক্রিটের সাম্রাজ্যে ঢুকে গেলাম। প্রায় ১০ টা বাজল আমাদের ফিরতে।
পরের গোটা দিন আমাদের হাতে কারণ বাড়ি ফেরার জন্য সেই রাতের দার্জিলিং মেল। সারাদিন কি করা যায় ভাবনাটা ছিলই। টয় ট্রেনের গার্ডের কাছেই জানলাম একদিন অন্তর টয় ট্রেন ছাড়ে দার্জিলিং থেকে নিউ জলপাইগুড়ি। প্রায় ৮-১০ ঘন্টার জার্নি। একরকম আমার একনায়কত্বের জেরেই বরমশাই গাড়ি ক্যান্সেল করে কেটে নিলেন সেই টিকিট। সারাদিন ঢিকির ঢিকির করে পুরো পাহাড়টা দেখার লোভ সামলাতে পারলামনা!
ফেরার সময় আমরা ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম দার্জিলিং এর বিখ্যাত keventers রেস্তোরাতে। পাওয়া যায় মূলত স্ন্যাক্স আর কফি। সুন্দর এক পেয়ালা ক্রিম দিয়ে সাজানো কফি দেখে খিদেটা বেড়েই গেল, সাথে চিকেন সসেজ, পোচ আর চিকেন ললিপপ। কফির অনবদ্য স্বাদ মনে রাখার মত, এত ভাল কফি আর কোথাও খেয়েছি বলে মনে পড়েনা। খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা গেলাম দার্জিলিং ম্যাল এ। ওখানে সুন্দর ড্রেস নিয়ে পসরা সাজিয়ে, আমাদেরও ইচ্ছে হল। পাহাড়ি পোশাকে সাজতে।
কিন্তু ম্যাল এর মধ্যে প্রকৃতি কই ভাবছি! সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে পাহাড়ের একটু নিচে গিয়ে দেখি ৫০ স্কয়ার ফিট মত জায়গায় কৃত্রিম ভাবে তৈরি হয়েছে বাগান, ফুলের গাছ কমলা লেবু গাছ সবই আছে , তাতে সারা বছরই ফুল ফুটে থাকে আর টসটসে পাকা লেবু কখনো ঝরে পড়েনা (আরে প্লাস্টিকের তো সব)। ড্রেস পছন্দ করে সেজেগুজে কর্তা সহ গেলাম ‘সাজানো বাগান’ এ। কথা ছিল তিনটি ছবি প্রিন্ট করিয়ে দেবে (১২০ টাকার বিনিময়ে)। এর পর আমাদের মনের কথা বুঝে বোধহয় ‘অভি আপ ম্যাডাম জি কা ফোটো উতারলিজিয়ে’ বলে আমাদের একান্তে আরো কিছুক্ষন সময় দিয়ে বিদায় নিল। পাঁচ মিনিটেই হাতে পেয়ে গেলাম তিনটি ছবি, বেশ পছন্দও হল।
ইতিমধ্যে বাঙালি মন বলে উঠল দুপুরে বাঙালি খাবার চাই ই চাই, তার কথা রাখতে গেলাম পাশের এর বাঙালি রেস্তোরাঁয়! ভাত, ডাল, আলুভাজা, পোস্ত আর মাছের ঝোল। মনে হল আলু গুলো ওপরে উঠে অহংকারে সেদ্ধ হতে ভুলে গেছে, মাছ টা ভালো হলেও ঝোলটা বুঝিবা বাঙালি আর উড়িষ্যার দুজন ঠাকুরের মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছে (বোধকরি জোরসে ঝগড়া লেগেছিল), মাছটা না থাকলে ওটাকে আইডেন্টিফাই করাটাই মুশকিল হত। বিল মিটিয়ে দিয়েই দেখলাম মিষ্টি মৌরী দুজনে দুমুঠো তুলে একসাথেই বুঝি ভাবলাম, যাক মৌরী দিয়ে কিছুটা পোষানো গেল! এবার হোটেলে গিয়ে ঘুম বিকালে সবথেকে গুরুত্বপূর্ন কাজটা সারতে হবে, কেনাকাটা।
বিকালে ম্যাল এ এসে গেলাম মহাকাল মার্কেটে। এক একটি জায়গায় এক এক রকম দাম! একজায়গায় একটি মেয়ে বলেই দিল ওর দোকানে একদর, ঘুরে ঘুরে ততক্ষনে দামের ধারনা হয়ে গেছে ৩ টি সোয়েটার, দুটো জহরকোট, একটা পঞ্চু, অনেক মাফলার ছাতা, কানপট্টি, টুপি ইত্যাদি ইত্যাদি কিনে মহাযজ্ঞটি সারলাম। ততক্ষনে পেল ক্ষিদে আর ইচ্ছে হল মোমো খাওয়ার। রাস্তায় দুজন পাহাড়ি মেয়ে সাজিয়েছে দোকান, মোমো কিনে বুঝলাম ভুল হয়ে গিয়েছে। আমাদের কলকাতায় রাস্তায় রাস্তায় মোমোর দোকান গুলিতে মনেহয় পাহাড়ের লোকেরা মোমো বানায়, আর সব কলকাতার লোকেরা পাহাড়ে গিয়ে বানাচ্ছে মোমো। তাই লুচি পরোটার খাবার সোডা মেশানো ময়দার ফোলা ফোলা সাদা সাদা মোমো গুলো আর মুখে চালান করা গেল না (রেস্টুরেন্টগুলি অবশ্য ফ্লপ করবে বলে মনে হয়না)। রাতের খাবারে নও রিস্ক, তাই গেলাম গতকালের ডিনারের রেস্তোরাঁ মহাকাল এ। অসাধারণ একটা মিক্সড ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন খেয়ে ধরে প্রাণ পেলাম। পরদিন সকাল আটটায় ছাড়বে ট্রেন। হোটেলে ফিরে সব গুছিয়ে নিয়ে দার্জিলিং কে বিদায় জানানোর জন্য তৈরি হয়ে নিলাম।
সকালে স্টেশনে গিয়ে দেখি আমাদের কামরায় (সর্ব সাকুল্যে দুটিই বগি) মোট ৫-৬ টা ফ্যামিলি। ট্রেনে টয়লেটের ব্যবস্থা আছে, আগেই জেনেছি। লাগেজ রাখার জন্য আলাদা জায়গা কিন্তু এত ছোট যে সবারটা ধরে না। তাই সিটের কাছে নিয়েই বসলাম, ফাঁকা ট্রেনে দুজনে দুটো window seat দখল করে। ট্রেন লেট বৃষ্টির জন্য সামনে ধ্বস নেমেছে। কি জানি বাবা কি হবে, ভুল হলনাতো! গার্ড থেকে ড্রাইভার সবাইকে আমার বরমশাই জিজ্ঞাসা করে এলেন, পথে বিপদে পড়ব কিনা। সবার আশ্বাস বাণীতে আমরা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। ট্রেন ছাড়ল ৮ঃ৪০ এ।
সেই গানটা মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে’ সত্যিই চলেছি আমি।
দার্জিলিং, ঘুম, সোনাদা, টুং, কারশিয়াং, মহানদী, গয়াবাড়ি, তিনধারিয়া, রংটং, শুকনা, শিলিগুড়ি তার পর নিউ জলপাইগুড়ি। এই কটা স্টেশন। রাস্তা ঘাট বাজার পেরিয়ে চলেছে ট্রেন। এর মধ্যে কারশিয়াং এ কিছুক্ষন দাঁড়াবে সেখানেই সেরে নেওয়া যায় লাঞ্চ। আমরা যদিও কেক, বিস্কুট ইত্যাদি শুকনো খাবার নিয়েই উঠেছি। ঢিমে তালে এগিয়ে চলেছি আমরা।
ঘুম স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াল, একটা অবাক করা কান্ড ঘটল! আমরা ছিলাম ট্রেনের দ্বিতীয় বগিতে। একটি লোক দুটি ট্রেনের জয়েন্টে উঠে ট্রেন এবং ছাতের মাঝের অংশে পা দিয়ে দাঁড়াল। বাঁ হাতে ধরা ছাতা, আর ডান হাতে ধরা ট্রেন। আমাদের সঙ্গেই সহ ভ্রমণে ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক এবং গার্ড (ভ্রমণ ই বলা চলে, এমন সুন্দর চাকরি!)। কৌতূহলের বশে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম । দুজন ভদ্রলোকই বাঙালি মিস্টার চ্যাটার্জি আর মিস্টার ঘোষ। তাই আলাপ আগেই হয়েছিল, ওনারা বললেন ওই দুটো বগির মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় দাঁড়ানো লোকটির কাজ ব্রেক সামলানো! পাহাড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে এভাবেই ব্রেক কন্ট্রোল করতে হয়! আকাশ থেকে পড়লাম, ঝড়, জল রোদ মাথায় নিয়ে ওভাবেই যাবেন উনি তাও মহানদী স্টেশন অবধি (প্রায় তিনঘন্টা), ওখান থেকে বদল হবে লোক! ট্রেন ছাড়তেই বুঝলাম কাজটা মোটেও মজার নয় !! একে বৃষ্টি পড়ছে, হাতে ছাতা তার ওপর গাছ পালা আসলে নামাতে হচ্ছে মাথা, একটু অন্যমনস্ক হয়েছ কি যে কোন রকম বিপদ হতে পারে! রক্ষে কর ! এ যেন রাজধানীর আগে লাইট নিয়ে দৌড়ানোর মতোই অবস্থা!! সত্যি পৃথিবীতে কত ধরনের চাকরিই না আছে!! মনটা উদাস হয়ে গেল।
এবারে সামনে পাহাড়ের সারি, আর খালি সবুজ। এ যেন গত দুদিনের দার্জিলিং এর অন্যরূপ। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে ট্রেন তার পাশেই গাড়ির রাস্তা, মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত দৃশ্য ‘মেরে স্বপ্নোকি রানী কব আয়েগি তু’ !! এই রাস্তা জুড়েই তো হয়েছিল শুটিং! নস্টালজিয়ায় অন্ত নেই! এটাই যেন দার্জিলিং এর মন, তার ভিতর দিক, সাজানো কংক্রিটে ভরা বাইরের দিকটা আড়াল করে রেখেছিল এই অকৃত্রিমতাকে।
ট্রেন লেট থাকাতে নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ৪৫ মিনিট পর করে কার্শিয়ং ঢুকলাম। জমজমাট স্টেশন। এখানে প্রায় ১০ মিনিট দাঁড়াবে, বাকি স্টেশনের বেশিরভাগে একমিনিট করে। আমাদের বগির আমরা আর এক দম্পতি বাদে সবাই নেমে গেল এখানে (আমাদের মত এডভেঞ্চারের একটু বেশিই নেশা মনে হয়)!। কার্শিয়ং এর পর পুরো রাস্তায় অফুরন্ত প্রাকৃতিক শোভা, ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে ক্যানভাস। এতক্ষণের জার্নিতে বোর হওয়ার অবকাশ আর যারই থাক আমার হয়নি, আমার সাথের জন যে নাক সিঁটকে ছিল এতক্ষন ঢিকির ঢিকির করে যাওয়াতে সেও দিব্যি আমাকে পাত্তা না দিয়ে ক্যামেরাকে নিজের গার্ল ফ্রেন্ড বানিয়ে নিয়েছে!
এক একটা স্টেশন বেশ দূরে দূরে, লোকজনও বিশেষ নেই, মাঝে মাঝে দু একটা বসতবাড়ি,এই পাহাড়ে কি করে যে জীবনধারণ করে ভাবিয়ে তোলে। মহানদী স্টেশনে বদল হল ব্রেকের সেই লোকটি। আবার একজন উঠল ওপরে। বৃষ্টি টা কমাতে রক্ষে, বেচারার কষ্ট একটু কম হবে। ছাতাটা ছাদের একটা ফুটোয় গুজে দিব্যি পজিশন নিয়ে নিলেন উনি। পিছনের বগিটা হওয়াতে এত ভালো করে দেখতে পাচ্ছি। অনেক স্টেশনে এক মিনিট করে দাঁড়ানোর কথা হলেও কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই ছেড়ে দিচ্ছে ট্রেন, এতক্ষনে বুঝেগেছি মাঝ পথে ওঠার আর কেউ নেই! আর একটা মজার বিষয়, পাহাড়ি পথ এতই অপরিসর যে ঘুরে নামার জায়গা নেই, অগত্যা নিচে নামতে গেলে কিছুটা রিভার্স এসে ট্রেন কে জিগজাগ করে নামতে হয়। এরকম প্রায় ৬ টা পয়েন্ট আছে। বেশ লাগে দেখতে, পুরো ট্রেনটা দেখা যায় এসময়।
আকাশে, পাহাড়ে আর সবুজে মিলে মিশে গেছে। পাহাড়ের পথে দেখা মিলল অনেক পুরোনো ছোটবেলায় ভূগোলে পড়া পাগলাঝোরা ঝর্নার! বয়েসের ভারেই মনে হল শীর্ণ থেকে শীর্ণতর আকার নিয়েছে। আর ধ্বস নেমে নেমে রাস্তা (হিলকার্ট রোড) প্রায় বন্ধ। ওখান দিয়ে বেশ আস্তেই চলল ট্রেন, ভগবানের নাম নিতে নিতে পার হলাম রাস্তাটা পাশের পাহাড়ে ধ্বসের চিহ্ন স্পষ্ট! দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝিবা নেমে এল!! মিনিট দুয়েকের এই রাস্তাটুকু পর করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তিনধারিয়া স্টেশন ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে ট্রেন থামল হটাৎ দুজন নান হাত দেখিয়েছিলেন। সামনের স্টেশনেই নেমে যাবেন তারা। গার্ড বললেন লোকাল লোকেদের অনেক সময়ই এভাবে ‘লিফট’ দেওয়া হয়। আমাদের সফর সঙ্গী হয়ে চললেন ওনারাও।
রংটং থেকে শুকনা পর্যন্ত দুপাশে ঘন হতে থাকল জঙ্গল, এর পর থেকেই সমতলে নামতে থাকলাম পিছনে আবছা হতে থাকল পাহাড়। শহরের কাছাকাছি এসে পড়তেই রাস্তায় লোকজনের দেখা মিলল, টয়ট্রেন দেখে বাইক, গাড়ি থামিয়ে ওদের ছবি তোলাটা বেশ ইনজয় করছিলাম আমরা ভিতর থেকে। কিন্তু নিউ শিলিগুড়ি ঢোকার একটু আগেই সিগনালে দাঁড়িয়ে পড়ল ট্রেন। এবার ছাড়ার আর নামই নেয় না। ইতিমধ্যে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট লেট। সবাই ট্রেন থেকে নেমে খোঁজ খবর নিতে ব্যস্ত। আমাদের আগের বগিতে প্রায় ১০ জন মত লোক সবারই ট্রেন ধরার তাড়া। আমার ভদ্রলোকও গিয়ে এক্কেবারে ড্রাইভারের সাথে কথা বলে এলেন। যা জানা গেল জলপাইগুড়ি পৌঁছাতে এরকম অনেক সিগনালের দাঁড়াবে। কখন ছাড়বে তার কোন ঠিক নেই! এটা নিত্য দিনের কারবার।
দেখতে দেখতে আধ ঘন্টা কেটে গেল, ঘড়িতে বাজে পাঁচটা। অবশেষে গার্ডের পরামর্শে আমরা ট্রেনের মায়া ত্যাগ করলাম। এখান থেকে মিনিট পাঁচের দূরত্বে পাওয়া যাবে অটো, ভাড়া মাত্র ২৫ টাকা মাথাপিছু। রাস্তা নেহাত কম নয় প্রায় ৫ঃ৪৫ নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। অটো ড্রাইভারবাবুই আমাদের নামিয়ে দিল ভালো একটা হোটেলে। একটা ভাতের খালি আর মিক্সড ফ্রাইড রাইস নিলাম। নারায়ন হোটেলের ঘরোয়া রান্না, ভীষণ ভালো লাগল। কোয়ালিটি এবং পরিমান দুই বেশ ভাল। খাওয়া দাওয়া সেরে স্টেশনে এলাম, ট্রেন একেবারে স্টহিক সময় ৮ টায় ছেড়ে দিল দার্জিলিং মেল। পাহাড়ের স্মৃতি মাখা মনটা কিন্তু এখন কলকাতা কলকাতাই বলছে। সকালে চোখ খোলার অপেক্ষায় ঘুমোতে গেলাম। একঘন্টা লেটে পরদিন পৌঁছালাম প্যাচ প্যাচে গরমে। যতই ধূলো ধোঁয়া মাখা হোকনা সেতো আমার প্রাণের শহর আমার কলকাতা, অপেক্ষা করে আছে অনেকদিন,আমাদের সব স্মৃতি রোমন্থনের একমাত্র সঙ্গী।
Leave a Comment