এবার দার্জিলিং আর সিকিম ভ্রমণের গল্প (পর্ব – ১)

ভার্সিটিতে ক্লাশ শুরু হওয়ার পর যখন সহপাঠীদের সাথে মোটামুটি খাতির হয়ে গেল, তখন আমি সবার প্রতি একটা প্রস্তাব রাখলাম যে, আমরা যেখানে পড়ছি সেখানকার এযাবৎকালের রীতি হল, ছাত্ররা চতুর্থ বর্ষে একটা দশ দিনের শিক্ষা সফর এর সুযোগ পায়, যেটার খরচ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া দেশের বাইরে শিক্ষা সফরের কোন নজির নেই! তো আমি সবাইকে উৎসাহ দিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক জায়গায়ই ছাত্ররা বিভিন্ন স্পন্সর যোগাড় করে আর নিজেরা কিছু টাকা দিয়ে সার্কের অনেক দেশ ভ্রমন করে, আমরাও সেরকম কিছু চিন্তা করতে পারি। আর সেজন্য এখন থেকেই আমরা যদি কিছু টাকা আলাদা করে জমিয়ে রাখতে পারি তাহলে একটা সুন্দর ট্যুর দেয়া সহজ হবে। কিন্তু সমাপণী বর্ষের শুরুর দিকে এসে বুঝলাম, আমার সেই প্রস্তাবনা কল্পনাতেই রয়ে গেছে। এই ধরণের একটা ট্যুর এর জন্য যেই আত্মপ্রণোদনা প্রয়োজন, সেটা আমার অধিকাংশ বন্ধুর মধ্যেই নেই।

কিন্তু আমাকেতো কিছু একটা করতেই হবে! কি করি ?? শেষ পর্যন্ত আমার রুমমেটকে বললাম, দোস্ত চল একটা ইন্ডিয়া ট্যুর দেই, তুই যা টাকা যোগাড় করতে পারিস, বাকিটা আমি তোকে ধার দেব, তবুও তুই চল। ও রাজি হল। বলেছিলাম, তুই এখন টাকা না দিরে পারলে চাকরি পেলে তারপর শোধ দিবি। ও সত্যিই আমাকে চাকরি পেয়ে টাকা শোধ দিয়েছিল। আমার সেই বন্ধুটি এখন সুদূর ইরানের তেহরানে কর্মরত !!

তো সেবার কলকাতা হয়ে চেন্নাই, পন্ডিচেরি, উটি, ব্যাংগালোর, গোয়া, মুম্বাই, দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর ঘুরে একরকম ক্লান্ত হয়ে দেশে ফিরেছিলাম।তবে যেই আনন্দ পেয়েছিলাম সেটার কাছে ক্লান্তি কিছুই না। সেবারও একটা অতৃপ্তি নিয়ে ফিরেছিলাম, সিমলা, মানালি না দেখে ফেরার কষ্ট ! ২২ দিন টানা ঘুরেছিলাম, কারণ বুঝতাম, চাকরি জীবন থেকে সময় বের করে হয়ত এত জায়গা দেখার সুযোগ হবে না। এখন সেটার সার্থকতা বুঝতে পারি !!! 😀

যাহোক, আসল গল্পে ফিরে আসি। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে একটা চাকরি পেয়ে গেলাম ২০০৪ সালের শেষ দিকে। তক্কে তক্কে থাকি কখন একটা সপ্তাহ খানেকের ছুটি চাওয়া যায়। নতুন নতুন আবার লম্বা ছুটিও চাওয়া যায় না। ম্যানেজারদের ভাব দেখে মনে হত, ছুটি চাওয়াটাই একটা অপরাধ। শেষ পর্যন্ত বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে সপ্তাহ খানেকের ছুটি মিলে গেল। মানে আগে পড়ে শুক্র শনি মিলিয়ে ৯ দিন। গন্তব্য দার্জিলিং আর যদি চান্স পাই তাহলে সিকিম।

আমার সংগী আমার এক স্কুল বন্ধু। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যথারীতি নাইট কোচে রওনা দিলাম লালমনিরহাট জেলার সীমান্ত বুড়িমাড়ী স্থল বন্দর। বর্ডার পার হওয়ার সময় পুরনো ঢাকার একদল আমাদের বয়সি ছেলের সাথে দেখা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথা বার্তার পর বন্ধুত্বও হয়ে গেল। ফলাফল, সবাই দল বেধে একটা জিপ ভাড়া করে শিলিগুড়ি রওনা। সেই সময় একটা ভ্রমনের সময় হওয়ার বর্ডারে অনেক ভীড় ছিল আর আমাদের ইমিগ্রেশন সারতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা যখন শিলিগুড়ী পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। নিয়মিত জিপ সার্ভিস বন্ধ, পাহাড়ী এলাকায় সাধারণত ওরা পাবলিক সার্ভিস রাতে চালায় না। আমরা সময় নষ্ট করতে চাইলাম না, কারণ একরাত শিলিগুড়ি থাকা মানে একরাতই লস। একটা জীপ পেয়ে গেলাম একটু বেশী ভাড়ায়। দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা হল শুরু। যেতে যেতে এক জায়গায় দেখলাম, পুরো শিলিগুড়ী শহরটাকে দেখা যাচ্ছে, খুব সুন্দর লাগল। বৈদ্যুতিক বাতিতে জ্বলজ্বল করছে একটি শহর, ঠিক যেমন উড়োজাহাজ যখন আকাশে নীচুতে থাকে তখন যেমন নীচের শহর দেখা যায় !!

গঙ্গামায়া পার্ক

দার্জিলিং যখন পৌছালাম, রাত প্রায় সাড়ে আটটা, গাড়ী থেকে নেমেই দেখি কন কনে শীত। উফ্ কি ঠান্ডা !! কাপতে কাপতে জীপের উপরে থাকা ব্যাগ থেকে প্রথমেই জ্যাকেট বের করলাম।আমার বন্ধুর পরিচিত এক হোটেলে উঠলাম, মোটামুটি মানের, কিন্তু এই রাতের কনকনে ঠান্ডায় কে যাবে হোটেল খুজতে??

পরদিন সকালে উঠেই বেরিয়ে পরলাম ঘুরতে। মনটা প্রথমেই ভাল হয়ে গেল দূরে বিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালা দেখে। আমাদের কপাল ভাল ছিল, আবহাওয়া ছিল চমৎকার, আকাশে ছিল না কোন মেঘ। দার্জিলিং আসা সার্থক হল!

জীপ ভাড়া করলাম, সেভেন পয়েন্ট দেখব বলে। রক গার্ডেন, গঙ্গামায়া পার্ক, চিড়িয়াখানা, চা বাগান, Himalayan Mountaineering Institue (HMI), একটা ওয়াল যেখানে পর্বতারোহণ চর্চা করা যায়, ঘোড়দৌড় ময়দান। যাক ৭টা জায়গার নাম মনে আছে তাহলে !! রক গার্ডেন, গঙ্গামায়া পার্ক দুটোই পাহাড়ের বুকে গড়া, ঘুরতে ভালই লাগল।

চিড়িয়াখানায় কয়েকটা বিরল প্রাণী দেখলাম। HMI দেখে ভালই লাগল। আমাদের মূসা ইব্রাহীমও কিন্তু এখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যাদুঘরে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি দেখলাম। অডিটরিয়ামে একটা শর্ট ফিল্মও দেখলাম। সবই পর্বতারোহণ বিষয়ক।

বিকেলে চা বাগানে এসে গাড়ী থামল আর সেখান থেকে হিমালয়ের এক অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। বিকেলের তির্যক আলোতে হিমালয়ের ঈষৎ রক্তিম রুপ আপনারাও দেখুন।

আরেকটা সুন্দর স্কুলও দেখেছিলাম, ওই যে যেই স্কুলটাতে “ম্যায় হু না” সিনেমার শুটিং হয়েছিল!!

সন্ধ্যায় আইনক্স সিনেপ্লেক্সে একটা সিনেমা দেখলাম। জায়গাটা আমাদের স্টার সিনেপ্লেক্সের মতই। এক কম্পাউন্ডে ৩ টা হল। খুবই মজার একটা সিনেমা দেখলাম, যদিও জানতাম না মুভিটা এত হাসির হবে। “Garam Masala -– গারাম মাসালা। অক্ষয় কুমার আর জন আব্রাহামের বিটলামি আর সাথে আছে পরেশ রাওয়াল। হাসতে হাসতে জান শেষ। যারা দেখেছেন, জানি না তাদের কেমন লেগেছে। আমার কিন্তু খুব মজা লেগেছে। ফুল অফ কমেডি। দেশে আমি যখনই টিভিতে সিনেমাটি চলতে দেখেছি সময় থাকলে দেখতে বসে গেছি। প্রতিবারই ভাল লেগেছে।

টাইগার হিলে সূর্যোদয়

পরের দিনের সূচীঃ ভোরে উঠে টাইগার হিলে যেতে হবে। দার্জিলিং শহর থেকে ১০-১২ কিমি দূরত্ব। ওখানে সূর্য মামাকে পাহাড়ের নীচ থেকে উঠতে দেখা যায়। পর্যটকদের জন্য এক দুর্লভ দৃশ্য। সূর্যোদয়ের কয়েক ঘন্টা আগে গিয়ে পজিশন নিতে হবে। আমাদের কপালটা একটু খারাপ ছিল। পাহাড়ে এক গাদা মেঘ জমে ছিল। তাই আমরা সূর্য মামাকে ঠিক পাহাড়ের নীচ থেকে উঠতে না দেখে মেঘের নীচ থেকে উঠতে দেখলাম।

মজার ব্যাপার আমাদের এই টাইগার হিল আগমনে আমরা ছিলাম মাত্র তিন জন। বাকি চারজন, লেপ মুড়ী দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তারা নাকি এত শীতে বের হতে পারবে না এবং সেদিন সকালে উঠেই বাংলাদেশে চলে যাবে। হায়রে পর্যটক!!

টাইগার হিল থেকে ফেরার পথে বাতাসীয়া লুপে যাত্রা বিরতি। এখানে দার্জিলিং এর টয় ট্রেন ৩৬০ ডিগ্রী টার্ণ নেয়। আর এখানে আছে একটা ওয়ার মেমোরিয়াল। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আমি হিমালয়ের যেই অসাধারণ স্নিগ্ধ একটি রুপ দেখেছি সেটা আমার মনে সারা জীবন গেথে থাকবে।

কাঞ্চনজংঘা

উপরের ছবিতে আপনারা হিমালয়ের যেই অংশটি দেখছেন, সেখানে সবচেয়ে উচু চূড়াটির নাম, কাঞ্চনজংঘা। বাকি সব চূড়ারই নির্দিষ্ট নাম আছে। এই ছবিটি আমার তোলা শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর একটি।

সকাল দশটার মধ্যেই আমরা দার্জিলিং এর মূল শহরে। এরপর আমরা নিজেরাই একটু ঘোরাঘুরি করলাম। ম্যাল রোড বরাবর হাটতে লাগলাম। পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত একটা সমতল মিলনস্থল থাকে যেটাকে ম্যাল বলে। ম্যালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানও হয়।সব সময় এখানে লোক জনের সমাগম থাকে, অনেক কবুতর উড়ে, কেউবা তাদের খাবার দিচ্ছে।

গার্লস কলেজে, এক ছাত্রী ছবি তুলে দিচ্ছে…. 😀

ম্যালের একপাশ থেকে একটা বৃত্তাকার পথ ঘুরে এসে ম্যালের আরেক প্রান্তে যুক্ত হয়েছে, এই পথ ধরে হাটলে আপনি শুধুই দূর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন আর মনটা কেমন যেন উদাসী আর অলস হয়ে যাবে। ম্যালের এক পাশের রাস্তায় একটা খুব সুন্দর চার্চ টাইপের ভবন দেখলাম, ভাবলাম ভেতরে গিয়ে ছবি তুলি। পরে দেখি ওটা একটা গার্লস কলেজ। ভাগ্যিস বেশি ভিতরে যাই নি, তাহলে বেইজ্জতি হতে হত !!

সেদিন সন্ধ্যায় সিনেপ্লেক্সে আরেকটা ছবি দেখলাম, শাদী নাম্বার ওয়ান। একটু জোর করে হাসানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু সিনেমা হলের হাই কোয়ালিটির কারণে সময়টা ভালই কাটল। দার্জিলিং এর ঐতিহ্যবাহী পিঠা টাইপের খাবার মোমো। ভাপ দিয়ে তৈরী করে। খেতে ভালই। শুকরের মাংস দিয়েই বেশী তৈরী করে। তাই আমরা কয়েকটা মুসলিম খাবারের হোটেল খুজে বের করেছিলাম। খুব ঘিঞ্জি পরিবেশ কিন্তু খাওয়া খারাপ না। মানে ওই দূর দেশে ওইটাই সই। সেখানে চিকেন মোমো খেয়েছিলাম। এছাড়া অন্যান্য হোটেলে দক্ষিণ ভারতীয় খাবার মাসালা দোসা খেয়েছি। অনেক রকম খাবারই থাকে কিন্তু সব ট্রাই করতে সাহস হয় না। আর পাহাড়ের কোলে সুন্দর কোন রেস্টুরেন্টে বসে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কফি বা গরম চকোলেট খাওয়ার আমেজটাই আলাদা!!!

পাঠক দীর্ঘ লেখা পড়তে পড়তে নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন। আমার অবস্থাও আসলে তাই, বসে থাকতে থাকতে কোমড় ব্যাথা হয়ে গেছে। আসলে আমার দার্জিলিং এর কাহিনীও প্রায় শেষ। আমাদের এর পরের গন্তব্য ছিল সিকিম, যাকে অনেকে ইন্ডিয়ার সুইজারল্যান্ড বলে ডাকে। বলে রাখি, সিকিম কিন্তু বাংলাদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ একটি জায়গা। তো সেখানে যাবার কাহিনীতে কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনাও ছিল। সেই কাহিনী আরেকদিন….

অন্য পর্বগুলোঃ
এবার দার্জিলিং আর সিকিম ভ্রমণের গল্প (পর্ব – ২)
এবার দার্জিলিং আর সিকিম ভ্রমণের গল্প (শেষ পর্ব)

Leave a Comment
Share