দানবীয় ডামতুয়া ঝর্ণা অভিযান

ডামতুয়া ঝর্ণা (Damtua Waterfall) যাওয়ার কথা চলছে বেশ কয়েকদিন ধরেই, কিন্তু সময় আর হয়ে উঠছে না। আমরা ৮জন এবার কোমড় বেঁধে নামলাম। এবার যাবই যাব। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। দুই দিনের প্ল্যান করে ফেললাম। অর্ধেক বেলা অফিস করে দিলাম ছুট চট্টগ্রামের ২য় শাহ আমানত সেতুর দিকে। কেননা সেখান থেকেই আমরা কক্সবাজারের বাসে করে চকরিয়া যাব। প্রায় আড়াই ঘন্টা পর বাস আমাদের চকরিয়াতে আলীকদম যাওয়ার জীপ স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে গেল। এবার সেখান থেকে আলীকদম যাওয়ার চাঁন্দের গাড়ী (এক ধরনের জীপ) ধরতে হবে। জানি, যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি করে ৮ জন উঠে পড়লাম চাঁন্দের গাড়ীতে। ঘন্টা খানেক জার্নি শেষে গাড়ী আমাদের আলীকদম বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে টমটমে করে চলে গেলাম আলীকদম বাজারে। আমাদের গন্তব্য ছিল “হোটেল আলীকদম আবাসিক”। দামতুয়া যেতে হবে মোটরসাইকেল অথবা রিজার্ভ চাঁন্দের গাড়ী করে। আমাদের পছন্দ মোটরসাইকেল, তাই হোটেলে সামান্য ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পড়লাম পরের দিনের জন্য মোটরসাইকেল ঠিক করতে। শেষ পর্যন্ত ৮জনের জন্য ৪টা মোটরসাইকেল ঠিক করে রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম, কেননা কাল খুব ভোরে উঠতে হবে।

ডামতুয়া ঝর্ণা

সকালের নাস্তা করতে না করতেই মোটরসাইকেল এসে হাজির। শুরু হল পাহাড়ী আঁকাবাকা পথ দিয়ে আমাদের পথচলা। আলীকদমের পান বাজার হয়ে আলীকদম টু থানচি যে সড়কটি হয়েছে সেই সড়কটি দিয়েই যাচ্ছি। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চতম সড়ক। পর্যটন স্পট ডিম পাহাড় এই রাস্তা ধরেই যেতে হয়। মাঝখানে পড়ল আর্মি ক্যাম্প, সেখানে আমাদের নাম এন্ট্রি করে নিল আর জমা রাখল সাথে আনা এন.আই.ডি কার্ডের ফটোকপি। আবার আমাদের যাত্রা শুরু। এই রাস্তায় মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ মজা নিলাম। প্রায় ৩০-৪০ মিনিটের যাত্রা শেষে পৌঁছে গেলাম আদুপাড়া। এখানে থেকে গাইড নিয়েই আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে।

ডামতুয়া ঝর্ণার পথে ট্রেকিং

যথারীতি গাইড সমিতি আমাদের একজন গাইড ধরিয়ে দিল। আর তাকে নিয়ে শুরু হল আমাদের ট্রেকিং। প্রথমে দুটো খাড়া পাহাড় বাইতে হল। আমাদের কষ্ট দেখে গাইড বাঁশ কেটে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর আবার ঝিরিপথ। এভাবে কয়েকবার পাহাড় আর ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে পৌছলাম একটি পাড়ায়। কি বলে!! এখান থেকে নাকি আরও ঘন্টা খানেকের পথ। পাড়ার গাছ থেকে ফ্রী ফ্রী কামরাঙ্গা খেয়ে শরীর চাঙ্গা করে আবার রওয়ানা দিলাম। ঝিরিতে নামার পর দেখছি পানির জোর বাড়ছে। বুঝলাম দামতুয়া আমাদের জন্য সেজে আছে তার পূর্ণ যৌবনে। খুশিতে সবার মন টগ বগ। প্রায় ৮০ ডিগ্রী খাড়া একটি পাহাড় নেমে পৌঁছাই ডামতুয়া ঝর্নার কাছে। ডামতুয়া সেজে আছে তার পূর্ণ যৌবন সাজে।

ডামতুয়া ঝর্ণার পথে ঝিরিপথ

বিশাল সাইজের ঝর্নাটি সত্যিই দানবাকৃতির। দুই দিক থেকে দুই ঝিরির পানি পড়ে ঝর্নার সৌন্দর্যকে করেছে দ্বিগুন। আর এই রুপটি দামতুয়াকে করেছে অন্যান্য ঝর্না থেকে আলাদা। সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে ঝর্না থেকে খুমের মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ার। ডামতুয়া ঝর্নাটি মুলত সৃষ্টি হয়েছে তুক-অ ঝিরি থেকে। ওই ঝিরিটিও খুব সুন্দর। সবাই গোসলে ব্যস্ত, ভুলেই গেল এখান থেকে ফেরার পথে আমাদের আরেকটি ঝর্না দেখতে হবে, নাম তার ওয়াং-পা। এভাবে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর শেষ হল আমাদের ডামতুয়া অভিযান। সামনে এগুতে থাকলাম ওয়াং-পা দেখার জন্য। এই গল্প না হয় আজ তোলা থাক, আরেকদিন বলার জন্য।

ডামতুয়া ঝর্ণা

ডামতুয়া যাওয়ার উপায়

বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে কক্সবাজারগামী বাসে উঠে যান। নেমে যান চকরিয়াতে। সেখান থেকে ৭০ টাকা ভাড়া দিয়ে চলে যান আলীকদম বাজারে। আলীকদম বাজার থেকে মোটরসাইকেল অথবা চাঁন্দের গাড়ী করে চলে যান আদুপাড়া গ্রামে। মোটরসাইকেল ভাড়া দুইজন ৬০০-৭০০ টাকা (আপ-ডাউন) আর চাঁন্দের গাড়ী রিজার্ভ ৩০০০-৩৫০০ টাকা (আপ-ডাউন)।

থাকার ব্যবস্থা

আলীকদম বাজারে তিনটি থাকার হোটেল রয়েছে। আলীকদম গেস্ট হাউজ, হোটেল দামতুয়া, হোটেল আলীকদম। আমরা হোটেল আলীকদমে ছিলাম। মান মোটামুটি। পানির ব্যবস্থা তেমন ভালো নয়। আর বিভিন্ন সাইজের রুমের জন্য ভাড়াও বিভিন্ন। তবে ভাড়া ৬০০- ২০০০ টাকার মধ্যে। অবশ্যই রুম নেওয়ার আগে ভাড়ার ব্যাপারে কথা বলে নিবেন।

খাওয়া-দাওয়া

আলীকদম বাজারে মোটামুটি সবকিছুই পাবেন। এছাড়া দুপুর বা রাতের খাবারের জন্য বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল রয়েছে।

গাইড খরচ

আদুপাড়াতে রয়েছে গাইড সমিতি। গাইড ভাড়া পড়বে ১০০০ টাকা। টীম মেম্বার কোন ব্যাপার না, কিন্তু গাইডকে ১০০০ টাকা দিতেই হবে, এটা ফিক্সড।

কিছু টিপস

  • চেষ্টা করবেন আগেরদিন মোটরসাইকেল বা চান্দেঁর গাড়ী ঠিক করে রাখার, তাহলে সকালে সময় নষ্ট হবে না।
  • সাথে করে এন.আই.ডি বা জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি নিয়ে যাবেন, মাঝপথের আর্মি ক্যাম্পে চাইতে পারে। আর আর্মি ক্যাম্প ক্রস করার সময় হল ভোর ৭টা- বিকাল ৫টা। এর মধ্যেই আপনাকে আস-যাওয়া করতে হবে।
  • যদি ওয়াং-পা ঝর্না দেখতে চান, তবে অবশ্যই গাইডকে আগে থেকে বলে নিবেন। না হয় পরে ঝামেলা হতে পারে।
  • ট্রেইলে শুকনো খাবার নিয়ে যাবেন। কারন মাঝখানে কোন দোকান-পাট নেই। এছাড়া জোঁক রয়েছে, তাই সাথে লবন রাখতে পারেন।
  • যতটুকু ‍দেখলাম ট্রেইলটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মনে হয় এখনও খুব একটা টুরিষ্ট যায় না। তাই যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে পরিবেশটা নষ্ট করে আসেবেন না। সবশেষে ”হ্যাপী ট্রাভেলিং।”
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ AlikadamdamtuaTrekking