কক্সবাজার এবং বান্দরবান – একই সাথে পাহাড় ও সমুদ্র

আজ থেকে প্রায় তিন কি সাড়ে তিন বছর আগেকার কথা। ২০১৬ সালের শেষের দিকে। ট্যুরটা এমন, অনেকটা এক ঢিলে তিন পাখি মারার মত অবস্থা! কারণ এক ট্যুরে তিন যায়গা ঘুরে এসেছিলাম সেবার! অনেক ভালো লাগা যেমন আছে এই ট্যুরে তেমন অনেক বিপত্তি ছিল পুরো ট্যুর জুড়ে। সেগুলো এখানে তুলে ধরেছি। আসলে লেখাটা আরও আগেই লিখতাম, কিন্তু সময় সুযোগ হয়ে না ওঠায় আর সম্ভব হয়নি। এখন লিখতে বসার দুটো কারণ রয়েছে, এক হল আমি খুব প্রকৃতি প্রেমিক, গাছপালা, এই সবুজ শ্যামল মাঠ-ঘাট, নদী সবকিছু যেন আমার মন কেড়ে নেয়। সব সময় মিশে থাকতে ইচ্ছে করে প্রকৃতির এই অপরুপ লীলাভূমিতে। ঘুরতে খুব ভালোবাসি। সময় সুযোগের কারণে খুব বেশি একটা ঘোরা হয়ে ওঠে না। তবে যতটুকুই পারি চেষ্টা করি কিছু স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসতে। স্মৃতি কাতরতার যায়গা থেকে এটি লিখা, আর দ্বিতীয়টি হল, ঠিক এই সময় খুব অসম্ভব রকমের দুঃসময় এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা, আজ প্রায় তিনমাস করোনাকালীন সময়ে ঘরবন্দী অবস্থা! অফুরন্ত সময় যেমন আছে তেমনি একঘেয়েমিতাও রয়েছে এই ঘরবন্দী দিনে। বিষণ্ণময় দিনগুলোতে বসে মনে হল অসম্ভব ভালো লাগার দিনগুলোতে আবার ফিরে যাচ্ছি না কেন? আমরা মানুষ, দিনশেষে স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকি আমরা। ছোট্ট জীবনটাকে যতবেশি আনন্দঘন করে তোলা যায়, ততই ভালো থাকা যায়, কারণ বাস্তবিক জীবনটা এতটা সহজ নয়, দিনশেষে আমাদের সেই কর্মময় জীবনেই সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয়, চাইলেই পৃথিবীটাকে ঘুরে দেখা যায় না। এ এক কঠিন বাস্তবতা! তো সেই থেকেই স্মৃতিচারণ করতে বসা আরকি!

তো যাই হোক, স্থির হল বাবা, অর্থাৎ আমাদের পরিবার, আমাদের পরিবার বলতে আমি মা বাবা আর সেসময় আমার ছোট চাচি আর আমার মেঝো মামা ছিলেন আমাদের সাথে। বাবার অফিসের কয়েকজন কলিগ ও তাদের পরিবার, বাবার বন্ধু, উনার পরিবার সবাই মিলে ঘুরতে যাবো আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম, অর্থাৎ বান্দরবান আর কক্সবাজার। আপাতত, দুটিতেই সীমাবদ্ধ ছিল কারণ হাতে সময় নেই। মাত্র তিন কি চারদিনের মধ্যে আমাদের ফেরত আসতে হবে। ওদিকে ক্লাস খুলে যাবে। বাবার অফিস খুলে যাবে। আবার ব্যস্ততায় ফিরে যেতে হবে ভেবেই আপাতত দুটিতেই স্থির থাকতে হল। প্রথমে বান্দরবান, এরপর কক্সবাজার হয়ে ফেরত আসব এমন পরিকল্পনা ছিল। যদিও এ নিয়ে আমি চতুর্থবার কক্সবাজার যাচ্ছি, বান্দরবান সেবারই প্রথম ট্যুর ছিল আমার জন্য। তবে এই ট্যুরটিকে ঘিরে অনেক স্মৃতি রয়েছে যেটি অন্য কোন ট্যুরে হয়নি। যার জন্য এই ট্যুরকে নিয়েই লিখতে বসে গেলাম। যাহোক, বাস ছিল বাবার অফিসের। একটিই বাস। যেহেতু আমরা পরিচিতি কিছু লোক যাচ্ছি তাই অন্য কোনো বাস আর লাগেনি। এখানে একটা বিষয়, আমার খুব কাছের ফ্রেন্ড অমি। ওর সাথে তখনি যোগাযোগ করি, যেহেতু আমাদের বাস, আর গুটি কয়েক সদস্য যাচ্ছি, তো অমিকে বলতেই ও রাজি হয়ে যায়, ও যাচ্ছে আমাদের সাথে! আমিও যেন হাফ ছেঁড়ে বাঁচলাম! কারণ, বাবার বন্ধু বা কলিগের ছেলে মেয়ে কারও সাথেই তেমন পরিচয় নেই। একমাত্র অমিই ছিল যার সাথে স্কুল জীবন থেকে বন্ধুত্বের শুরু।

যাই হোক, শুরুটা ছিল খুব সম্ভবত ২৮ তারিখ রাতে। তো যথারীতি বাস ছাড়ার পর আমরা অনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠি। সমবয়সী ছিল প্রায় অনেকেই, যেহেতু বাবার বন্ধু আর কলিগ উনাদের ছেলে মেয়েরা বয়সে আমাদের সাথেই। মীম, মোনা, সাদমান, প্রান্ত এরা সবাই আমাদের বয়সী। চটজলদি করে ফেইসবুকে চেকইন দিয়ে আমরা গান শুনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিছুটা দোয়া দুরুদ পড়ি, বাবা যেহেতু ট্যুর এরেঞ্জ করেছিলেন, তাই বাস ছাড়ার সাথে সাথেই কিছুটা দিকনির্দেশনামূলক কথা বাবার মুখ থেকেই শুনি। যেহেতু লঙ জার্নি, অনেকটা পথ পারি দিতে হবে।

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

রাতের অন্ধকার পেরিয়ে ভোরের শুরু। দেখলাম সকাল ৭টা কি ৮টা। চারদিকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা, হালকা শীত শীত ভাব! পাহাড় আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। খানিকটা আঁকাবাঁকা রাস্তা। বলে রাখা ভালো, প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্রে পরিপূর্ণ পাহাড়ি কন্যার নাম বান্দরবান। আসলে এখানে স্বশরীরে না আসলে বিশ্বাস করাটা কঠিন আমাদের বাংলাদেশ কতটা সুন্দর, বৈচিত্র্যময়! বাস চলছে রাস্তার বাঁকে বাঁকে, আর পাহাড় গুলো যেন আমাদের দিকে ছুটে আসছে। অসম্ভব ভালো লাগার দৃশ্য! সকাল ৯টা কি ১০টা নাগাদ হোটেলে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে সবাই তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নেই। প্ল্যান হচ্ছে প্রথমে চিম্বুক, শৈলপ্রপাত এগুলো দেখে এরপর নীলগিরি যাবো। তো যেই কথা সেই কাজ। চটজলদি করে তিনটা ‘চান্দের গাড়ি’ ভাড়া করে নিলাম। আসলে উপড়ে ছাদবিহীন, চারদিকে খোলা গাড়িগুলোকেই তাদের ভাষায় চান্দের গাড়ি বলে। এগুলো শুধু পাহাড়ি এলাকায়ই চলে। ভাড়া গুলোও যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে! বলে রাখা ভালো, এই গাড়িগুলো যারা ড্রাইভ করেন, উনারা দিনে এরকম একটাই ভাড়া করে দিয়ে থাকেন নরমালি বা খাস বাংলায় জেটাকে বলে খ্যাপ নেওয়া, কারণ বাস স্টেশন থেকে নীলগিরি, নীলাচল এগুলো অনেক দূরে, প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা লেগে যায় শুধু যেতেই! আরেকটা জিনিস বলে রাখা ভালো, চান্দের গাড়ি যারা ড্রাইভ করেন, তাদের অসম্ভব রকমের একটা দক্ষতা আছে! পাহাড়ের আকেবাকে যেমন স্পীড তেমন নিশানা কেমন যেন ঠিক থাকে! গাড়িগুলোতে না চড়লে বুঝা যাবে না! যাই হোক, ঝটপট তিনটা গাড়িতে উঠে যাই আমরা। গাড়ি চলার সময় লক্ষ্য করলাম যিনি চালাচ্ছেন গাড়ি উনি যেন চোখ বন্ধ করেই চালাচ্ছিলেন! কারণ একটু অসাবধানতাই ডেকে আনতে পারে অনেক বড় বিপদ! সেখানে এত দক্ষতার সাথে চালানোটা রীতিমত অবাক করেছে আমাকে! যাই হোক, ছোটখাটো একটি বিপত্তি ঘটে, উল্টোদিক থেকে আসা এক মোটর সাইকেল আমাদের গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে পরে যায় মাটিতে। কিছু হয়নি তেমন, তবে যা বুঝলাম মোটরসাইকেল আরোহীরই বেশিরভাগ দোষটা ছিল। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আমরা দু পক্ষই সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম! ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের ছবি তুলে নিলাম, উঁচু উঁচু পাহার। পাহাড়ের জালগুলো দিয়ে যেন আমাদের আঁকড়ে ধরে আছে!

চিম্বুক পাহাড়! বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ ফুট উঁচু চিম্বুক এবং সর্পিল সাঙ্গু নদীর সৌন্দর্য মনকে যেন প্রশান্ত করে। পাহাড়ের রাণী বলা হয় এই চিম্বুককে! এর মধ্যে চিম্বুক ঢুকার আগে রাস্তায় কিছুটা পাস নিয়েই ঢুকতে হয় আমাদের। চেক করে এরপর ঢুকতে দেয় উনারা। বেলা তখন ১২টা কি ১টা! তো চিম্বুকে নেমে রীতিমত কিছুটা অবাক হই, কারণ পুরো রাস্তায় কোনো গাড়ি দেখলাম না সেরকম অথচ, নামতেই মানুষের ঢল! সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম, আশেপাশে ভালো করে ঘুরে দেখলাম। কি সুন্দর সবুজের খেলা! পরতে পরতে পাহাড়! কিছুটা মেঘ দেখলাম আকাশে তখনও। আশেপাশে কয়েকটি সেলফি তোলে নিলাম চটজলদি করে। যতটুক ঘুরা যায় ঘুরে দেখলাম। এর আগে শৈলপ্রপাতে কিছুটা সময় কাটালাম, দেখলাম পাহাড়িরা হরেক রকম জিনিসের পসরা বিছিয়ে বসে আছে! বার্মিজ কাপড়, আচার, শুঁটকি! অনেক কিছু! ওখানকার বয়স্কা মহিলারা তাদের বাচ্চাকে কাঁথার সাথে পেঁচিয়ে বুকের সামনে নিয়েছেন! বাচ্চাটাও খুব সুন্দর বসে আছে, কাঁদেও না, নড়েও না! শৈলপ্রপাতের উপর দিয়ে একটি ব্রিজ আছে, নিচে নেমে দেখলাম ডিম এর মত বড় একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে পানি, এর গভীরতা কতটুকু আমার জানা নেই! সৃষ্টিকর্তাই জানেন! ঝরনা বেয়ে পানি আসছে, এখানে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে! পানি একদম স্বচ্ছ! এ বিষয়টা কিছুটা অবাক করার মতই বটে!

চিম্বুক, বান্দরবান

যাহোক, কিছুটা সময় ওখানে থেকে চিম্বুক ঘুরে আবার রওনা দিলাম নীলগিরির উদ্দেশ্যে। এখান থেকে প্রায় আরও ২০ কিলোমিটার। একই ভাবে গাড়ি চলছে, পাহাড়ের বাঁকগুলো যেন রীতিমত গাড়ি চালকদের বাম হাতের খেলা! তবে বুঝতে পারছি, যতই গাড়ি চলছে উপড়ের দিকে উঠে যাচ্ছি, দূর থেকে দেখা যায় কি সরু পথ! সাপের মত ঢেউ খেলানো রাস্তা যেন শেষ হচ্ছে না! যাহোক, সবশেষে এসে পৌঁছলাম নীলগিরি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটনকেন্দ্র! দুপুরের খাবার কোথায় সেরেছিলাম ঠিক ঠাওরে উঠতে পারছি না। সে যাই হোক, নীলগিরি এসে বুঝলাম কেনো পাহাড়িরা এতো ভদ্র হয়, কেন ওদের কালচার অনেক ভিন্ন! নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্রে ঢুকতে টিকেট লাগে, টিকেট করে আমরা ঢুকলাম ভিতরে। রোদ থাকায় তাকাতে খানিকটা কষ্টই হচ্ছিলো তখন। সানগ্লাসই ছিল এর থেকে বাঁচার একমাত্র অবলম্বন! খানিকটা ভেতরে যেতে দেখলাম ওই পাশে বর্ডার দেখা যায়। সীমান্তরক্ষীরা একটু উঁচু যায়গায় তাঁবু গেঁড়ে দূরবীন দিয়ে দেখছেন! সেখানে একটা যায়গায় আছে যেখানে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করে, এন্ট্রি রেস্ট্রিক্টেড থাকায় যেতে পারিনি। যতটুক চোখ যায় দেখে নিলাম। চারপাশে পাহাড়ের সাথে যোগ হয়েছে আবছা নীলাভ রঙের আকাশ! খুব মন টানছিল এখানে থেকে যেতে! কয়েকটি সেলফি নিলাম চট করে! যা হোক আশেপাশতা ঘুরে চলে আসতে হবে, গাড়িতে উঠলাম। কারণ, হাতে সময় নেই একদম। একদিনেই যতুটুক কভার করা যায়! আসার সময় খেয়াল করলাম, বৃদ্ধা মহিলারা বাইরে কাজ করছেন, কেউ লাকড়ি কুরাচ্ছেন, কেউ কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ বা গাছের ডাল টানছেন! এতদিন শুধু শুনতাম পাহাড়ি মেয়েরা বাইরে কাজ করে, ছেলেরা বাসায় থাকে। আজ নিজ চক্ষে দেখলাম!

নীলগিরি, বান্দরবান

সেখান থেকে ফিরতে প্রায় চারটা কি পাঁচটা বেজে গেলো! এখন ঠিক করলাম আর মাত্র এক ঘণ্টা আছে, এখনও অনেক কিছু দেখা বাকি! ঠিক করলাম সেখান থেকে মেঘলা ঝুলন্ত ব্রিজ হয়ে নীলাচল যাবো। সেই হল! বান্দরবান শহর থেকে মেঘলার দূরত্ব ৪ কিলোমিটার হবে! ঝুলন্ত ব্রিজ দেখে মনে হচ্ছিলো আমি লন্ডন টাওয়ার ব্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে! প্রাচ্যের টাওয়ার ব্রিজ বললে বোধহয় ভুল করবো না! সেখানে পুরো ব্রিজটা এপার থেকে ওপারে যেতেই বুক কেঁপে উঠছিল, কেননা এতটা দোল খাচ্ছিল! একই সময় অনেক মানুষ উঠায় খানিকটা ভয়ও হচ্ছিলো! দেখলাম ওখানে ব্রিজের নিচ দিয়ে কৃত্রিম লেক বয়ে গেছে। তার উপর দিয়ে সূক্ষ্ম দড়ির মত করে বেঁধে পর্যটকদের জন্য ঝুলে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার খুব সুন্দর একটি ব্যবস্থা! তবে, দেখে অনেক ভয় হচ্ছিলো! বিকেলের মিষ্টি রোধ আছড়ে পড়ছিল মুখে!

যাই হোক, সেখান থেকে খানিকটা সময় হাতে থাকার পরও ভাবলাম নীলাচল যাওয়া যায় কিনা! যেই ভাবা সেই কাজ। চলে আসলাম নীলাচল! কিন্তু তখন প্রায় সন্ধ্যা! গাড়ি দূরে পার্ক করে রেখে খানিকটা পথ হেঁটে ভেতরে ঢুকতে হল। যতটুক মনে পড়ে, এখানে পর্যটনকেন্দ্রটা একটু উঁচুতে রয়েছে। সেখান থেকে অনেক দূর অবধি দেখা যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, নীলাচল থেকে স্বর্ণমন্দিরটা একদম ছোট দেখা যাচ্ছিলো!! এত ক্ষুদ্র দেখা যাচ্ছিলো বুদ্ধদের পূণ্যঘরটা! ভাগ্য খারাপ তাই, এর বেশি আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নীলাচলই ছিল বান্দরবান এর শেষ পর্যটনকেন্দ্র আমাদের জন্য। সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার চলে আসলাম হোটেলে। তবে আসার সময় খুব ক্লান্তি নিয়ে ফিরে আসলেও মন কিছুটা খারাপ ছিল। কারণ, বান্দরবানের মনোরম দৃশ্য বারবার মন কাড়ছিলো। আবার, মনে হচ্ছিলো এখানকার সিকিভাগও দেখা হয়নি! তবু, মনে আসার সঞ্চার জাগল রাত পোহালেই কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো! সময় সুযোগ পেলে হয়তো আবার আসবো “দ্যা ডাম অফ মাঙ্কিস” খ্যাত বান্দরবানে!

নীলাচল, বান্দরবান

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরি আমরা সবাই, সে রাতে আর বেশিকিছু করা হয়নি। মন খানিকটা ভালো লাগছিলো সকালে উঠেই কক্সবাজার এর উদ্দেশ্যে রওনা দিবো! ক্লান্ত শ্রান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতে চোখ লেগে গেলো!

৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬

সকালে উঠে তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়েই রওনা দিলাম আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। আমরা সবাই বাসে, বসে উপভোগ করছি পাশে পাহাড়ের দেশ ছেঁড়ে সমুদ্রের দেশে ঢুকছি! এটা যেন অন্যরকম এক ভালো লাগা! গতকালকেই না পাহাড়ের দেশ ঘুরে বেড়ালাম আর আজ সমুদ্রের তীরে হারিয়ে যাবো! রাতের অবসাদ আর নেই। নতুন দিন, নতুন যায়গা, নতুন সবকিছু! প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর বেলা ১২টার দিকে পৌঁছলাম কক্সবাজার। হোটেল কক্স ইন! একদম এয়ারপোর্ট এর পাশে কলাতলী রোডের পাশেই হোটেল। হোটেলে উঠে আরেক দফা ফ্রেশ টেশ হয়েই সেখানকার স্থানীয় অটো করে চলে গেলাম সাগরের পাড়ে! সেই অনুভূতিটা কখনো বোঝানো যায় না! যারা কক্সবাজার গিয়েছেন তারাই কেবল উপভোগ করেছেন এই অনুভূতিটা। বিশাল সমুদ্র। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আমার সামনে দাঁড়িয়ে! বারবার পানি পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে! মাঝে মাঝে পায়ের নিচ থেকে বালি সরে যাচ্ছে! আশেপাশে কেউ কেউ বালিতে নিজেকে গুঁজে দিচ্ছে! কেউ বাঁ ঘোড়ায় চড়ছে, কেউ কেউ আবার তার প্রিয় মানুষটির নাম বালিতে লিখে রাখছে! কত কিছুই না দেখেছি!

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

ওখানে কিছুক্ষণ থেকে দুপুরের খাবার খেতে রওনা দিলাম সেখানকার স্থানীয় এক বাসিন্দার বাড়ি! উনি আবার বাবার বন্ধুর সম্পর্কে পরিচিত! উনি আমাদের জন্য খাবার রেডি করে রেখেছেন। ভালো মন্দ কিছু খেয়ে রওনা দিলাম ইনানী বীচে! ইনানী! পাথরঘেরা সমুদ্র সৈকত! আহা! কি এক অপরূপ লীলাভূমি আমাদের এই দেশে লুকিয়ে আছে! সেবার হিমছড়ি যাওয়া হয়নি কারণ এর আগেরবার এখানে গিয়েছিলাম, আর এবার সময়ও নেই এতো। অপশন দুইটা ছিল, হিমছড়ি অথবা ইনানী! সেখান থেকে ইনানী বীচই ঠিক হল! কিন্তু বিপত্তির শুরুটা এখান থেকেই!! সেখানে কিছুক্ষণ থেকতেই প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো! আর তখনি বাঁধল বিপত্তি! পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আমরা অনেকটা দূর চলে গেলাম। পাথর গুলোকে পেছনে ফেলে আমরা যারা ছিলাম ইনানীতে সবাই-ই মোটামুটি কিছুটা দূর চলে যাই। এদিকে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আমরা যেই ফেরত আসবো, তখনি দেখি আমাদের ছেড়ে পানি অনেক দূর চলে গিয়েছে! সমস্যা ছিল না। কিন্তু পানির নিচে পাথর গুলোকে ঠিক আন্দাজ করতে পারছিলাম না! মুহূর্তের মধ্যেই যেন পানি অনেক দূর তীরে চলে এসেছে! বাবার মোবাইল ফোনটা পানিতে পরে যায়! আমার স্যান্ডেল জোড়া দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়! আর একটু পর পর পাথরে ধাক্কা লাগছিলো পা! কি এক অবস্থাই না ঘটেছিলো সেদিন! যাইহোক, সে যাত্রায় কোন রকম বেঁচে ফিরি আমরা সবাই। সবাই সেখানে কিছুক্ষণ আশেপাশের দোকানপাট ঘুরে দেখলাম। কেউ কিছু দেখছে আবার কেউ কেউ কিনছে কিছু! এরপর সবাই বাসে উঠি। বাসে উঠে নাস্তা সেরে নেই।

হোটেলে ফিরে বারান্দায় বসে আমি আর অমি মিলে চারপাশটা দেখছিলাম। কি ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া! শীতকাল হওয়ায় কিছুটা কুয়াশা পরেছে! যেহেতু অন্যদের সাথে এতটা ভাব নেই তাই আমরা দুজনই বারান্দায় বসে প্রকৃতি কে দেখছিলাম। আগেই বলেছিলাম আমাদের হোটেলটা ছিল একদম এয়ারপোর্টের সাথে। যার কারণে রানওয়েতে কয়েকটা বিমান ওঠা নামা করতে দেখেছিলাম! খুব কাছ থেকে এই দৃশ্য দেখতে পাবো ভাবিনি কখনো! কয়েকটা বিমান রানওয়ের ঠিক পাশেই রাখা ছিল! সবকিছু যেন একদম চোখের কাছে! সে রাতে আমরা বারান্দায় বসে গান শুনে, ফেইসবুকে চ্যাট করেই কাটিয়ে দেই!

মজার বিষয় হচ্ছে, সেই রাতে ইনানী থেকে ফিরেই জানতে পারি আমাদের সেন্ট মার্টিন যাবার জাহাজ এর টিকেট করে রাখা হয়েছে!! এটা একদমই অপ্রস্তুত ছিলাম শুনতে! কারণ, সেন্ট মার্টিন আমাদের লিস্টে ছিল না। সে রাতে যোগ হল আরেক আনন্দ! রাত পোহালেই সেন্ট মার্টিন! বাহ!! সে রাতে ঘুম বোধ করি হয়ই নি!

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬

সকাল হলে আমরা তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হই! গাড়ি যেহেতু আমাদেরই ছিল, বাবার অফিসের। সেহেতু এক্সট্রা কোনো বাস আর লাগে নি। ঠিক হল এটা দিয়েই যাবো টেকনাফ! টেকনাফ যাওয়ার পথে বাঁধল আরেক বিপত্তি। তখন সেখানে মেরিন ড্রাইভ রোড এর কাজ চলে। রাস্তা ওপারে বন্ধ! কিন্তু যেহেতু আমাদের নিজেদের গাড়ি, নিজেদের ড্রাইভার, সেহেতু আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না! সে ড্রাইভারও প্রথমবারের মত টেকনাফ যাচ্ছে! তো, সেই রাস্তা ধরে আগাচ্ছিলাম, একপাশে সমুদ্র অন্যপাশে পাহাড়! আহ! কি অপরুপ! কিছুদূর যেতেই দেখি, ভাঙ্গা রাস্তা শুরু হল! আমরা তখনও বুঝিনি এটা রং ওয়ে! যাচ্ছি তো যাচ্ছি! আশেপাশে শুনশান, কোন গাড়ি নেই, কিছু নেই। কোন মানুষও নেই! শুধু আমরা গুটি কয়েক লোক গাড়িতে! গাড়ি চলছে! ভয় হচ্ছিলো খুব, একদিকে আমরা এই এরিয়াতে একা, আবার জাহাজ মিস করি কিনা!! উভয় সংকট! সামনে আরেক্টু আগাচ্ছি, দেখি দুই পাশে তাঁবু। সেখানে কি হয় এক মাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন! একবার ভাবি জঙ্গি আস্তানা কিনা! আবার ভাবি ধ্যাত! ওসব কিছু না! গাড়ি কিছুদূর যেতেই বালিতে আটকে গেলো। আর যাচ্ছে না। কোনভাবেই আর সামনে আগাবে না! আবার পেছন ফিরে গেলে প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগবে! জাহাজ ঠিক নয়টায় ছাড়বে! জেটিতে জাহাজ না পেলে পুরো টাকাই গচ্ছা যাবে! এমন একটা সময়ে কিভাবে যেন একটা রাস্তা সৃষ্টিকর্তা মিলিয়ে দিলেন! একটা গ্রামের ভেতর দিয়ে বাস ঢুকল! কেউ হয়তো বলেছিল এদিকে যাওয়া যাবে আমার ঠিক মনে নেই! দেখলাম গ্রামের ভেতর দিয়ে আমাদের বড় বাস একাই ছুটে যাচ্ছে! আশেপাশে গ্রামবাসীরা চেয়ে আছে আমাদের এই কাণ্ডকারখানা দেখে! এদিকে আমরা কি করে বুঝাই আমরা পরেছি বিপদে!! কিভাবে কিভাবে যেন ঠিক নয়টা বাজার পাঁচ কি দশ মিনিট আগে বাস টেকনাফ পোঁছায়!! এরপরও বাস রেখে জাহাজে উঠতে কিছুটা পথ হাঠতে হয়, দেখলাম জাহাজ অলরেডি ছেঁড়ে দিচ্ছে!! আমি অমি, আরও আমরা যারা ছিলাম দৌড়ে গিয়ে জাহাজে উঠি। দেখলাম আমরাই শেষ যাত্রী! আমাদের সবাই উঠার পর দেখলাম জেটি থেকে জাহাজটা ছেড়ে দিচ্ছে! চলছে খানিকটা! সে যাত্রায় কিভাবে বেঁচে ফিরলাম, কিভাবে জাহাজ পেলাম একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন!

জাহাজ চলছে, একপাশে মায়ানমার এর বর্ডার দেখা যাচ্ছে। ততোক্ষণে আমরা নাফ নদের মাঝখানে! নাফ নদ থেকে কখন যে জাহাজ সাগরে মিশে গেলো টেরই পেলাম না!! ততক্ষণে সাদা গাঙচিল গুলো আমাদের জাহাজের পিছু নিয়েছে! বেশ মনোরম দৃশ্য! নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না! কেউ কেউ পাখিকে খাবার দিচ্ছে, কেউ কেউ ছবি তুলছে! ততক্ষণে আমরা সাগরে মাঝখানে চলে এসেছি! কোন কুল কিনারা দেখা যাচ্ছে না!! জাহাজে অনেক মানুষ, চারদিকে কোলাহল! এক সময় জাহাজের ছাদে উঠলাম। খানিকটা ভয় লাগছিলো ছাদ থেকে সাগর, গাঙচিল! কেমন যেন! সেখানে ঘটলো আরেক বিপত্তি, কারও একজনের মোবাইল অসর্তকাবসত সাগরের পানিতে তলিয়ে গেলো!! কি একটা অবস্থা পুরো ট্যুর জুড়ে! যাই হোক, আমরা কিছু সেলফি তোলে, খাওয়া দাওয়া করলাম কিছু। দেখলাম বেশ খানিকটা পথ আগাতেই আরেকটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে! মনে সাহস হল! না আমরা অনেক মানুষ! জাহাজ এর যে সূক্ষ্ম একটা রাস্তা রয়েছে সেটি খেয়াল করলাম খুব ভালো করে। চাইলেই যেদিকে ইচ্ছে জাহাজ সেদিকে যাচ্ছে না! সব জাহাজ একই পথ ফলো করছে। বেশ অবাক করার ছিল বটে!

যাই হোক, জাহাজ ঘাটে ভিড়ল! আমরা নামলাম। কি নীল পানি! স্বচ্ছ! আমরা নেমে সেখানে কিছুক্ষণ ফুটবল খেলি, ছেলে মেয়ে সবাই মিলে মজার ছলে ফুটবল খেলা হয়। বাবা ছিলেন গোলরক্ষক আর বাবার বন্ধু ছিলেন অন্য দলের গোলরক্ষক! কিছু সময় খেলি, এরপর সবাই পানিতে! অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। তখন অনেক দূর পর্যন্ত অনায়সেই যাওয়া যেতো এতোটা পানি ছিল না তখন। কয়েকটি সেলফি তুলি। আমি অমি, প্রান্ত সবাই মজা করে পানিতেও খেলি! সময় বেশি নেই, আবার ৩টায় জাহাজ। তাই তড়িঘড়ি করে আশেপাশটা একটু দেখেই যেই খেতে রওনা দিব অমনি আমাদের স্কুল এর সাখাওয়াত স্যারের সাথে দেখা!! বলে রাখা ভালো, সাখাওয়াত স্যার ছিলেন আমাদের স্কুলের ডিসিপ্লিন কমিটির হেড! উনার সাথে ইনফর্মাল কোন কথা কখনো হয়নি, এই প্রথম উনার সাথে ইনফর্মাল দেখা এবং কথা, একটা সেলফি তুলে নিলাম আমি আর অমি! রীতিমত আমাকে অবাক করেছে স্যার এর সাথে দেখা হওয়াটা! সামনে যে আরও কিছু অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য তখনো জানতাম না আমরা!

গেলাম খাবার খেতে। পাশেই খাবার দোকান। কারণ দ্বীপে তো সব কিছুই কাছাকাছি। পেটপুরে খেয়ে নিলাম। তবে খাবার আইটেমগুলো ছিল জিবে পানি চলে আসার মত। রূপচাঁদা মাছ, ওদের আলুভর্তা, আমাদের সাথে যারা গিয়েছিলো অনেকে শুঁটকি খায়, তাঁরা শুঁটকি ভর্তা বেছে নিয়েছে। অনেক ধরণের ভর্তা, ডাল। সাথে কড়া করে রূপচাঁদা মাছ ভাজা! বেশ খাওয়া হলো। তড়িঘড়ি করে আবার জাহাজের উদেশ্যে রওনা দেই আমরা! সেখানেও প্রায় জাহাজ ছেঁড়ে দিবে এমন একটা অবস্থা! তো, বিপত্তির বিষয় হল বাবার বন্ধু সিদ্দিক আংকেল উনি আর উনার ছেলে জাহাজ ধরতে পারেন নি! আমরা সবাই চলে আসি কিন্তু উনারা রয়ে যান, জাহাজ মিস করেন! উনারা পরের জাহাজে আসেন আরকি! উঠলাম জাহাজে, তখনো জাহাজ মিস করার ভয়টা কাটেনি! বেশ কিছুক্ষণ পর, যখন খানিকটা পথ চলে আসলাম, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়! বারবার নারিকেল জিঞ্জিরার টানে মন চলে যাচ্ছিলো। বারবার ইচ্ছে করছিলো আরও একটু যদি থাকতে পারতাম!! ইশ!! আবার কবে আসবো!

তবে একটা বিষয় কি ফিরে আসার সময় এই জাহাজ ভ্রমণটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগার মুহূর্ত। কারণটা বলি, সন্ধ্যা ছয়টা কি এর আশেপাশে। তবে বোধ করি, সন্ধ্যা ছয়টার আরও আগে, কারণ সন্ধ্যা ছয়টায় সূর্য অস্ত যায় সেদিন! আমরা তখন মাঝ সমুদ্রে! চারদিকে কোলাহল, অনেক মানুষ, পাখিদের ডানা মেলে উড়া সবকিছু মিলিয়ে ভালোই লাগছিলো। পাখিরা জাহাজের সাথে সাথে যখন উড়ে সেই মুহূর্তটা কত ভালো লাগে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না! অন্যরকম একটা ভালো লাগার মুহূর্ত! তখনো কিছু চমক বাকি আমরা জানতাম না!!

জাহাজে মোটামুটি কিছুদূর আসার পর দেখলাম আমাদের স্কুল জীবনের বন্ধু আজিজ, আবিদ, জোয়ার, সেজান, সাবির, রাফি, সানি এরা অনেকে!! আমরা জানতাম ওরা গিয়েছে বাট আসার সময় একই জাহাজে ওদের পেয়ে যাবো ভাবিনি!! যাই হোক, তখন আমরা মোটামুটি একটি টিম হয়ে গিয়েছি! আমরা প্রায় ১০ জন বন্ধু! যাই হোক, আমরা যখন এই মাঝ সমুদ্রে ঠিক তখনই বাঁধল বিপত্তি! সেন্ট মার্টিন ছেড়ে আসার সময় জাহাজটা ঠিক মাঝ সমুদ্রে এসে আটকে যায়, পানি কম থাকায় সে জায়গায় চড় জেগেছিলো, যার কারণে জাহাজ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো প্রায় এক থেকে দেড় ঘন্টা!! দেড় ঘন্টা জাহাজ নড়েও না চড়েও না! দেখলাম, জাহাজ থেকে অনবরত পানি সমুদ্রে ঢালছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝা যাচ্ছিলো না! আবার ভাবলাম জাহাজের ইঞ্জিন নষ্ট কিনা!! এই দেড় ঘন্টা দেরি হওয়াতে জাহাজ টেকনাফ পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো। যাই হোক, মজার ব্যাপার হলো, জাহাজ আটকে থাকায় এই দেড় ঘন্টা দেরি হওয়াতে জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগার মূহুর্তটা কাটালাম ঠিক তখনই!! সূর্যটা আবছা আলো দিচ্ছে তখনও! ঠিক কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে সূর্যটা মিলিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যেনো ডুবে যাচ্ছে!! সূর্য ডোবার ঠিক ওই সময়টা, বিশেষ করে গোধূলিটা দেখতে যেমন ভালো লাগে তেমনই মনটা কেমন যেনো বিষণ্ণ হয়ে যায়! বছরের শেষ সুর্যাস্তটা সমুদ্রের মাঝখানে বসে দেখার সৌভাগ্য কয়জনেরই বা কপালে জোটে! হয়তো আর কখনো এরকম সৌভাগ্য হবে না। কারণ, এর পরদিনের সূর্যটা ছিলো নতুন বছরের সূর্য। নতুন সবকিছু! বছরের শেষ সূর্যাস্তটা আজও চোখে লেগে আছে, চোখে ভেসে ওঠে সে যাত্রার সবকিছু!

বছরের শেষ সূর্যাস্ত, জাহাজে

এতক্ষণে বোধ হয় ঘোর কাটল! জাহাজ জেটিতে এসে ভিড়েছে। আমরা সবাই নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি! রাত প্রায় অনেক হয়েছে, জাহাজ মাঝপথে দেরি না করলে হয়তো অনেক আগেই এসে পৌঁছতাম। যাহোক, আমরা নেমে বাসে উঠলাম সবাই। বন্ধু যাদের সাথে জাহাজে দেখা হয়েছিল ওদেরকেও বাসে তুলে নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য কলাতলি, কক্সবাজার। ততক্ষণে, নতুন বছর উদযাপনের হইহই শুরু হয়ে গিয়েছে। আশেপাশে অনেক যায়গায়ই গান বাজছিল, কানে ভেসে আসছিলো। আমরা এসে পোঁছাবার পর, ডিরেক্ট সাগরের পাড়ে চলে যাই। সেখানে ততক্ষণে স্টেইজ করা হয়ে গিয়েছে। তবে অনুষ্ঠানটা ছিল পরের দিন। যার কারণে, আমরা দেখতে পারিনি। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে ডিনারের জন্য চলে যাই কোনো এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। আমরা সবাই মিলে সে রাতে একসাতে খাওয়া দাওয়া করি। কিছু সেলফি তুলে মুহূর্তগুলোকে স্মরণীয় করে রাখি। এরপর, সেখান থেকে বেড়িয়ে আবার চলে যাই সমুদ্রের পাড়ে। সে রাতটি ভুলার মত নয় আমার কাছে, কারণ আমি, বাবা মা, বন্ধুরা সবাই সাগরের পারে।

রাত তখন ৩টা! সাগরের কলকল পানির আওয়াজ, সাগরের গর্জন! বেশ ভালো লাগছিলো। এর মধ্যে এক পিচ্চি এসে আম্মুকে বলছে, মাথা এক্সারসাইজ করে দিবে। খুব একটা মনে নেই, হয়তো মাথা ম্যাসেজ করে দিয়ে কিছু টাকা দিয়েছিলাম ওকে! মনে হচ্ছিলো গরিব! যাই হোক, আমরা বন্ধুরা মিলে গান ধরলাম। এমন সুযোগ বোধ হয় আর আসবে না জীবনে! কে জানে! সে রাত না ঘুমিয়েই পার করে দিলাম। পরদিন আবার ঢাকা ফেরত আসা লাগবে! নাহ মনে আর কোনো ইচ্ছা নাই, কিছু জিনিস অপূর্ণ থেকে গেলেও যা পেয়েছি তাই বা কমক কিসে?

১ জানুয়ারি, ২০১৭

সকালে বোধ করি আরও একবার সাগরে ছুটে যাই। শেষবারের মত সমুদ্রকে কাছ থেকে দেখে বিদায় জানাতে যাই সেদিন। হাতে খুব বেশি সময় নেই। ঠিক দুপুর ১২টায় বাস। উদ্দেশ্য এবার টেকনাফ কিংবা কলাতলি নয়! উদ্দেশ্য ঢাকা!! এটা ভেবে মনটা আবারো খারাপ হয়ে যায়। কি আর করার, বাসে চুপ মেরে বসে থাকি, কিছুটা ক্লান্ত, মন বিষণ্ণ! যারা গিয়েছেন তাঁরা বুঝবেন সাগরটা ছেঁড়ে আসতে কতটা খারাপ লাগে। ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। যাই হোক, ফিরতে হল অনেকগুলো স্মৃতি নিয়ে। শুন্যতাও কিছুটা কাজ করছে। তবে, যা পেয়েছি, তার কাছে না পাওয়ার হিসাবটা অতি নগণ্য! রাস্তায় যে যার সুবিধা মত নেমে যায়। সবাই আগামীকাল কর্মব্যস্ত শহরে ছড়িয়ে যাবে! যান্ত্রিক এই শহরে আবারও বেঁচে থাকার তাগিদে নেমে পড়তে হবে! ঘোর এবার বোধহয় পুরো দমে কাটল। অসম্ভব সুন্দর তিন দিনের ট্যুরে সফলতার ভাগ যতটা বেশি তার থেকে অনেক বেশি হয়েছে অভিজ্ঞতা!! অনেক গুলো অভিজ্ঞা নিয়ে ফিরে আসি নিজ গন্তব্যে!

আজ এই করোনার দিনগুলোতে কোয়ারেন্টাইনে বসে লিখাটা যখন লিখছিলাম, তখন সদ্য ফেরত আসা সেন্ট মার্টিনের তিন বাসিন্দার ফেরত আসার গল্প, উনাদের অভিজ্ঞতাটুকু পড়ছিলাম। ভাগ্য! অসম্ভব সুন্দর ভাগ্য! বেঁচে থাকলে আবার যাবো পাহাড়ের দেশে, আবার ঘুরব সুগন্ধ্যা বীচ, কলাতলি, নারিকেল জিঞ্জিরা আরও কত কি!! ভালো থাক আমার স্মৃতিগুলো, ভালো থাক ওখানকার প্রতিটি বাসিন্দা, ভাল থাক আমার দেশের মানুষ! সুন্দর একটি দিনের অপেক্ষায়…

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Coxsbazar