চটকপুর জঙ্গলের রাস্তা
প্রত্যেক বছর সেপ্টেম্বর মাস এলেই আমার ট্রেকিং এ যাবার ইচ্ছা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে থাকে। এমনিতেই সারা বছর বিভিন্ন ভ্রমন সংক্রান্ত গ্রূপে যুক্ত থাকার সুবাদে ছবি টবি দেখতে দেখতে মাঝে মাঝেই ঘুরতে যাবার ইচ্ছেটা বেশ জাঁকিয়ে বসে। সেপ্টেম্বর মাস আসতেই আগের দু বছর আমাদের ট্রেকিং এর গোছগাছ শুরু হয়ে যেত এই সময়ে। এই বছর নিতান্তই পাকেচক্রে যাবার প্ল্যান হওয়া সত্ত্বেও তা বাতিল করে নিজের হাঁড়িমুখ আয়নায় দেখতে দেখতে যখন চরম বিরক্ত আমি, ঠিক তখনই আমার উনি ঠিক করলেন, ট্রেকিং নাহয় নাই হলো, ছোট্ট করে পাহাড় থেকে তো ঘুরেই আসা যায়! ব্যাস, অমনি আমাদের সঙ্গী সাথীরাও এককথায় রেডি !
এবার প্রশ্ন হলো, কোথায় যাবো। বেশিদিন ছুটি পাবেনা কেউই, অগত্যা ঘরের কাছের নর্থ বেঙ্গল ঘুরতে যাওয়াই সাব্যস্ত হলো। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করা হলো, চটকপুর যাওয়া হবে। আমার কিছুতেই কোনো আপত্তি নেই, কারণ সেই কোন ছোটবেলায় মা বাবার হাত ধরে দার্জিলিং, কালিম্পঙ, ডেলো ঘুরেছি যার স্মৃতি প্রায় নেই বললেই চলে। তো ব্যাস, সবাই একপায়ে খাড়া হয়ে দিন গোনা শুরু।
১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ যাত্রা শুরু।আমাদের ট্রেন ছিলো শিয়ালদা থেকে, কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। সবাই নির্ধারিত সময়ে কোনো অঘটন ছাড়াই ট্রেনে উঠে বসেছি। বেশ গল্প গুজব, খাওয়া দাওয়া চলছে, কিন্তু মারাত্মক গরম। প্রান বেড়িয়ে যাওয়ার মত অবস্থা! আমরা মেয়েরা খুব হাঁ হাঁ করছি, চলছে দোষারোপ এর পালা। উল্টোদিকে ছেলেরাও ছাড়ার পাত্র নয়! তারাও ট্রেন সুদ্ধ লোককে বুঝিয়ে ছাড়বেই যে এই দু সপ্তাহের নোটিশে পিক টাইমে ট্রেনে টিকেট বের করেই কতটা মহান কাজ করে ফেলেছে। অগত্যা আমি রোকষায়িত লোচনে ওনার দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে ভস্ম করে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে আপার বার্থে উঠে কোনোক্রমে ঘুমোনোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ভোরের দিকে সামান্যই ঘুমিয়েছিলাম। নামার সময় হবার কিছু আগে থেকে গোছগাছ করছি, হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। পুরো বানভাসি বৃষ্টি! আমরা তখন মনে মনে প্রমাদ গোনা শুরু করে কালো মুখ করে বসে আছি। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর বৃষ্টি সামান্য কমলো। আমরা তারই মধ্যে ভিজে ভিজে একটা share এর গাড়িতে উঠলাম। এই গাড়িতে আমরা সোনাদা অবধি যাবো। প্রায় ঘন্টাদেড়েক ধরে প্যাসেঞ্জার জোগাড় করার পর ড্রাইভার দাদা গাড়ি ছাড়লেন। আমাদের সেই ফাঁকে সকালের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে।
সোনাদা অবধি রাস্তা সুন্দর, হালকা মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি থেমে গেছে। নরম ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে, আর আমাদের মনে ততক্ষণে বেশ পাহাড়ে আসার আনন্দ গেড়ে বসেছে। মধ্যিখানে একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে গরম গরম ভেজ মোমো খাওয়া হলো। সোনাদা পৌঁছনোর আগেই আমরা বিনোদ রাই, অর্থাৎ আমাদের হোমস্টের মালিককে ফোন করে দিয়েছিলাম। উনি গাড়ির ব্যবস্থা রেখেছিলেন সোনাদা থেকে। সেই গাড়িতে করে আমরা চটকপুর যাবো। শুরু হলো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, যেটা আদপেই কোনো রাস্তা কিনা আমার বেশ সন্দেহ। যেভাবে গাড়ি হেলেদুলে চলছিলো, আমার প্রায়ই মনে হচ্ছিলো আমাদের সেই বাটিতে পুরে ঝাঁকানো জামগুলোর মত অবস্থা! হাড়গোড় গুলো এবার খুলে এলেই হয়! একটু অসাবধান হলেই রাস্তার পাশের গাছপালা জানলা দিয়ে ঢুকে আহত করতে পারে, তাই বেশ সাবধানে বসতে হচ্ছিলো। তবে এসব কিছুক্ষণ পর আর মনে থাকলোনা। অসম্ভব সুন্দর চারপাশ আর খুবই নির্জন, আমাদের গাড়ির শব্দ ছাড়া আর কোনো কৃত্রিম শব্দ নেই। একপাশে মেঘে ঢাকা পাহাড়, আরেকপাশে লম্বা গাছের জঙ্গল। ওইটুকু সময়েই আমি পুরো মুগ্ধ হয়ে গেলাম, বারবার মনে হতে থাকলো চটকপুর আসা তবে সার্থক। কিন্তু তখন কি আর জানি, এ যে সব মাত্র শুরু, এরপর আরও কত মুগ্ধতা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য!
গাড়ি যেখানে থামলো সেখান থেকে সামান্য হেঁটে চটকপুর গ্রাম। বিনোদ রাই নিজে আমাদের জন্য ছাতা হাতে অপেক্ষা করছিলেন, সাথে ছিলেন ওনার স্ত্রী। আমরা নামতেই একগাল হেসে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করলেন। যেমন সুন্দর দেখতে ওনাকে, ঠিক ততোটাই সুন্দর ব্যবহার। তার পরিচয় শেষদিন অবধি পেয়েছি। ওনাদের সাথে আমরা হাঁটা লাগলাম। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট নির্জন একটা গ্রাম চটকপুর। চারিদিকে সবুজ, এবং সমস্ত বাড়ির লাগোয়া নানা রঙিন ফুল ফুটে আছে। শান্ত, নিরিবিলি সে গ্রামের রূপ দেখে মন ভরে গেল। পৌঁছেই শরীর ছেড়ে দিলাম। ঘড়িতে তখন প্রায় দুটো বাজে। সাথে সাথে গরম চা এসে গেল, খেয়ে বেশ একটু চাঙ্গা লাগলো। তারপর সবাই ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করলাম। লাঞ্চে গরম ভাত, ডাল, তরকারি, স্যালাড, ডোললের চাটনি আর পাঁপড়। খেয়ে দিয়ে ঘুম দিয়ে যখন উঠলাম তখন সন্ধ্যে। সন্ধ্যেবেলায় জাঁকিয়ে আড্ডা শুরু হলো আমাদের। বেহেনি গরম গরম চা আর ছোট্ট ছোট্ট করে কাটা মাংসের পকোড়া ভেজে দিয়ে গেলেন যেগুলো এতটাই সুস্বাদু ছিলো যে আমরা হটপট টা খেয়ে ফেলতে বাকি রেখেছিলাম শুধু! রাতে হাতে গড়া রুটি, আলুভাজা আর মুরগীর মাংস। অসম্ভব সুস্বাদু রান্না! মুরগী ওনারা বাড়িতে পোষেন, সেগুলোর স্বাদও তাই বলে বোঝানো যাবেনা। চেটে পুটে খেয়ে এক ঘুমে রাত কাবার!
পরদিন আমাদের ইচ্ছে ছিল চটকপুর ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার। কিন্তু সকাল থেকে সেই বৃষ্টি। তবে বেলার দিকে থেমেও গেল। কি আর করা! আমরা গরম গরম মোমো খেয়ে কাছের জঙ্গলে ঢুকে গোরাঘুরি করলাম। সাথে ছিল সাবিন, একটি কমবয়সী নেপালি ছেলে। সেই আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল। তার কাছেই জানতে পারি এখান থেকে মংপু এবং টাইগার হিল ট্রেক করে যাওয়া যায়। তবে এবার আমাদের হাতে সময় কম থাকার কারণে তা সম্ভব হয়না। তারপর ভিউ পয়েন্টে গিয়ে ছবি তুলে আবার ফিরে আসলাম। ততক্ষণে রোদ উঠলেও কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘে ঢাকা। এদিকে আমাদের কাল সকালেই ফেরা।
ফিরে এসে আমাদের ঘর চেঞ্জ করে অন্য রুম দেওয়া হলো। এটি অমর রাইয়ের হোম স্টে। কাজ শেষ হয়নি সেটার তখনো। শুনলাম একটি কুড়ি বাইশ জনের বাঙালি টিম আসছে এবং তাদের ষাট জনের গ্রামের উনিশটা বাড়ির আর একটা রুমও ফাঁকা নেই। একটু পরেই প্রবল গোলমাল সহ সেই দল নিজেদের উপস্থিতির জানান দিলেন। বুকিং অন্য লোক মারফত করায় সেই দলের কাছে সঠিক তথ্য ছিলোনা। তারা ভেবেছিলেন পাশাপাশি তাদের আট দশটা ঘর দেওয়া হবে। শুরু হয়ে গেল প্রবল গোলমাল। গ্রামের সমস্ত লোক অসন্তুষ্ট, এবং আমরা লজ্জিত! ওনাদের বোঝানোই যাচ্ছিল না, এখানে বিনোদ রাই বা তার পরিবার কোনোভাবে এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য দায়ী নন। অত্যন্ত খারাপ শব্দ প্রয়োগ থেকে শুরু করে সব কিছু মিলিয়ে পরিবেশ দূষিত করে তারপর তারা ঘরে ঢুকলেন। আমরাও আমাদের নতুন ঘরে এসে ঢুকলাম। দুপুরের খাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যেবেলায় চা, কফির সাথে খেলাম রাইশাকের পকোড়া! এত সুন্দর খেতে যে আবার আমরা অনুরোধ করলাম আর কিছুটা দিয়ে যেতে। আলু আর পিঁয়াজের পকোড়াও ছিল। রাতে আবার মাংস, রুটি। সেদিন রাতের মাংসটা আমাদের সকলের মতে সবচেয়ে সেরা ছিল। রাতে কিছুক্ষণ ছাদে ঘোরাঘুরি করে নীচে নামলাম। প্রবল বেগে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কালই ফেরা, কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেলাম না বলে মন ভারাক্রান্ত।
সকালে ঘুম ভাঙল সঙ্গীদের দরজা ধাক্কানোর শব্দে। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে শীতের পোশাক পরেই ছাদে। উঠেই দেখি, মেঘহীন আকাশে একঢাল রূপ নিয়ে আবরণহীন ভাবে দাঁড়িয়ে – কাঞ্চনজঙ্ঘা! আহঃ! সূর্যের প্রথম আলো পড়ছে আস্তে আস্তে তার দেহে, সোনার মুকুট পরে সেজে উঠছে সে, সোনালি আলোয় বিচ্ছুরিত হচ্ছে তার দেহ! চক্ষু সার্থক হলো, মন কানায় কানায় পূর্ণ হলো।
ঘরে ফিরে আমরা চা কফি খেলাম, ঘরের জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা হাসছে তখন, সে এক আলাদাই অনুভূতি। চা খেতে খেতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। এবার তৈরি হবার পালা। আজ আমাদের ফেরা। লুচি আর গরম আলুর তরকারি সহযোগে ব্রেকফাস্ট। ফেরার সময়ে মনখারাপ। বিনোদ রাই জানান যে আমাদের ওনার খুব ভালো লেগেছে। আমাদের যে ঘরে থাকতে দিয়েছিলেন, সেই ঘর দুটোর কাজ তখনো শেষ হয়নি। কিন্তু ওনারা আমাদের অনেকখানি ভরসা করে ফেলেছিলেন তখনই। ওনারা খেয়াল করেছেন আমরা খাবার সময় বিছানায় কাগজ পেতে খেয়েছি, সামান্য ও নোংরা করিনি ঘর এবং অকারণে জ্বলা আলো নিভিয়েছি নিজেরা। এগুলো ওনাদের চোখ এড়ায়নি। ওনারা জানান যে আমাদের ব্যবহার, কথাবার্তা এতটাই আলাদা এবং সুন্দর, যে ওনারা অভিভুত এবং আসার আগে আমাদের হাত ধরে আবারও ওনাদের গ্রামে যাবার অনুরোধ জানান। সাথে দেন ওনাদের গ্রামের একঝুড়ি সব্জি। গলায় সাদা সিল্কের কাপড় জড়িয়ে দেন, তোলা হয় অনেক ছবি। আমরাও ওনাদের ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে কথা দিই, আবারও কখনো আসবো ফিরে, কোনো একদিন।
Leave a Comment