সোনাদিয়া দ্বীপে তাবু নিবাস

সোনাদিয়া দ্বীপ কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে অবস্তিত। আমাদের ভ্রমণ সময়কাল ২ দিন ১ রাত।

সোনাদিয়া দ্বীপ 💯 এক বাক্যে বললে, একের ভিতর অনেক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধময় এই দ্বীপ। দ্বীপের বিশাল একটা অংশ জুড়ে রয়েছে সমুদ্র সৈকত শুধু সৈকতই না সাথে রয়েছে বড়বড় ঢেউ। নির্জন এই সমুদ্র সৈকতে যারা রাজ্য বিস্তার করে চলেছে তারা হলো লাল কাকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি নানারকম সামুদ্রিক জীব। ঝাউবনের সাথে অজানা এক ফুলের সৌন্দর্যে সোনাদিয়া দ্বীপ (Sonadia Island) এর সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে আরো কয়েকগুন। রয়েছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট; অসংখ্য ছোটবড় খাল,দিগন্ত জোড়া বিশাল বিশাল লবন চাষের মাঠ। সব কিছু মিলিয়ে ছবির মত সুন্দর এই সোনাদিয়া দ্বীপ। দ্বীপে একশ সত্তর পরিবারে বসবাস। সময় ২০১৮ সাল হলেও এখানকার লোকেরা ২০১৮ থেকে অনেক অনেক দূর পিছিয়ে। নিজেদের কোনোরকম খেয়ে পড়ে বাচিয়ে রাখতে যারা প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত । তাদের আনাগোনা সোনাদিয়ার ঐ লোকালয়ে নিজেদের কর্মব্যস্ততায়। আর এখনো অন্যান্য বানিজ্যিক ট্যুরিস্ট স্পটের মত হয়ে ওঠেনি এই সোনাদিয়া দ্বীপ এবং যারা একটু এডভাঞ্চারাস ট্যুর দিতে পছন্দ করেন সুতরাং শহুরে যান্ত্রিক আর কোলাহল পূর্ণ জীবন থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য এরকম উত্তম জায়গা খুবই কম আছে।

আমাদের ভ্রমনকথা

গত ১৩ ডিসেম্ববর রাত দুইটায় আমরা চারজন চট্রগ্রাম হতে আর দুইজন কক্সবাজার থেকে অর্থাৎ মোট ছয়জন সোনাদিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। উল্লেখ্য যে, যারা সোনাদিয়া ভ্রমনে যায় তারা সোনাদিয়ার পশ্চিমপাড়েই ভ্রমনে যায়। লোকালয় সোনাদিয়ার পশ্চিমপাড়ে। সোনাদিয়ার পশ্চিম পাড়ে যাওয়ার জন্য সারাদিনে একটাই ট্রলার ছাড়ে ঘটিভাংগা নামক স্থান হতে কারন হচ্ছে জোয়ারভাটা। সেটা দুপুরে বারোটা -সাড়ে বারোটা করে সোনাদিয়ার পশ্চিম পাড় থেকে ছেড়ে আসে ঘটিভাংগা নামক স্থানে ওখান থেকে আবার ছেড়ে যায় সোনাদিয়ার পশ্চিম পাড়ের উদ্দেশ্য। যেটা বলছিলাম আমরা যেহেতু রাত দুইটায় চট্টগ্রাম হতে রওনা দি ভোরে কক্সবাজার পৌছাই নাস্তা করেই সাথে সাথে চলে যাই কক্সবাজার ছয় নং ঘাটে সেখান থেকে স্পীডবোটে মহেশখালী।

যেহেতু আগেই বলেছিলাম সোনাদিয়ার ট্রলারে দুপুরে ছাড়ে তাই মাঝখানের সময়ে আমরা মহেশখালী স্যুটিং ব্রীজ,আদিনাথ মন্দির এবং বৌদ্ধ মন্দির ইত্যাদি ঘুরি। ঘুরা শেষে গোরাকঘাট বাজারে নিশান হোটেল দুপুরে লাঞ্চ সেড়ে প্রায় ১২ টার দিকে সেখান থেকে অটোতে ঘটিভাংগার উদ্দেশ্য রওনা দেই। পৌছাতে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটের মত লাগে। কাঙ্ক্ষিত ট্রলার অবশ্য তখনও এসে পৌছায় নি। প্রায় ঘন্টা খানেকের অপেক্ষার পর সে ট্রলারের দেখা পাই। অবশেষে ঘাটে এসে যাত্রী এবং মালামাল নামিয়ে প্রায় অাধা ঘন্টার ব্যবধানে যাত্রী এবং মালামাল বোঝাই করে সাথে আমরা সোনাদিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা। ট্রলার চলছে আর দু পাশের প্রকৃতি আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ঘন্টাখানেকের ট্রলার ভ্রমণ শেষে পৌছাই আমাদের গন্তব্যে।

ক্যাম্পিং, সোনাদিয়া দ্বীপ

সোনাদিয়া বানিজ্যিক ট্যুরিস্ট প্লেস না সেটাতো আগেই বলেছিলাম, থাকা খাওয়া এইসব নিয়েতো এখনো কিছুই বললাম না। বলছি সোনাদিয়ায় আমরা তাঁবুতে ছিলাম। সোনাদিয়ার লোকাল Giash Uddin ভাই ( উনার ফোন নাম্বারটা আমি নিচে দিয়ে দিবো) আমাদের তাবুর ব্যবস্থা করেছিলেন। আর হ্যাঁ যদিও আমাদের রাতে বারবিকিউ করার প্ল্যানিং ছিলো কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি সময়ের স্বল্পতার জন্য আরো কিছু ব্যক্তিগত ফ্যাক্টরের জন্য। হয়তো এই ট্যুরের এটা আমাদের অপূর্ণতা হয়ে থাকবে।

সোনাদিয়া পৌছে আমরা সরাসরি গিয়াস ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠি। ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়ি আশপাশের জায়গা ভ্রমনে সাথে চলতে থাকে সাইট ক্যাপচারিং, সেলফি আর আড্ডাবাজি সুযোগ করে গ্রামের মানুষদের সাথে মিশে যাওয়া। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ রেস্ট করে সাতটা নাগাদ রাতের খাবার (গিয়াস ভাইয়ের বাসায়) সেড়ে চলে যাই নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাবু ইত্যাদি নিয়ে চলে যাই সোনাদিয়ার সমুদ্র সৈকতের দিকে মাঠ পেরিয়ে ঝাউবনে প্রবেশ করতেই সমুদ্রের গর্জন মনে হচ্ছিল আমাদের স্বাগতম বার্তা বলে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে। তাবু রেডি করে কিছুক্ষন বীচে হাঁটাহাঁটি করে পরে ক্যাম্পফায়ারিং এর প্রস্তুতি নেই।

ক্যাম্পফায়ার, সোনাদিয়া দ্বীপ

বনের ভিতর থেকে শুকনো ঢালপালা কুড়িয়ে এনে শুরু করে দি আমাদের ক্যাম্পফায়ারিং সাথে নিজেদের মত করে চিলিং। রাত বাড়তে থাকে সাথে এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সব কিছু নিয়ে চিন্তা করতে করতে সারাদিনের ক্লান্তি যে কখন নিজেকে ঘুম পাড়িয়ে গেলো টেরই পেলামনা। যখন ঘুম ভাংলো তখন সকাল সাড়ে ছয়টা।

শুভ সকাল সোনাদিয়া দ্বীপ সমুদ্র সৈকত। আলোতে একবার সোনাদিয়াকে দেখে নিলাম। সফরসঙ্গীদের ডেকে তুললাম। ফটো তোলা পর্ব সাথে লালকাকড়া, ঝিনুকদের সাথে কয়েক দফা সাক্ষাৎ শেষে বাসায় ফিরে ফ্রেস হয়ে ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে ঘটিভাংগার উদ্দেশ্য রওনা। তবে এবার ভিন্ন ওয়েতে। কারন ট্রলার তো মিনিমাম বারোটার আগে ছাড়বেনা কিন্তু আমাদের আর্লি ব্যাক করতে হবে তাই পায়ে হেটে রওনা দেই।

পায়ে হেটে ঘটিভাংগা পৌছাতে প্রায় দুঘন্টা নিয়েছিল। তবে আশপাশের যা ভিউ ছিলো আমাদের দু ঘন্টা পায়ে হাটার যে কষ্ট তা ভুলিয়েছে। ঘটিভাংগা হয়ে গোরাকঘাট সেখান থেকে লাঞ্চ সেড়ে মহেশখালী জেটিতে এসে স্পীডবোটে কক্সবাজার। তারপর বীচে এসে ঘন্টাখানেক ঢেউ খেলা উপভোগ করে বাসের মধ্যে অসাধারণ সব মুহুর্তগুলো ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরা।

সোনাদিয়া দ্বীপের লাল কাঁকড়া

কিছু তথ্য যা আপনাদের ট্যুর প্ল্যান করতে সাহায্য করতে পারে

  • রুট : কক্সবাজার যেকোনো জাগয়া থেকে চলে আসুন ছয় নং ঘাট >স্পীডবোটে (জনপ্রতি ভাড়া ৭৫টাকা) মহেশখালীজেটি> কিছুটা হেটে জেটির মধ্যে কিছু অটোপাবেন বা গোরাকঘাট বাজার থেকে অটোতে ঘটিভাংগা (জনপ্রতি ৩০টাকা)> ট্রলারে ঘটিভাংগা থেকে সোনাদিয়া পশ্চিমপাড় (জনপ্রতি ৩০ টাকা)
  • আমরা যে তাঁবুতে ছিলাম তাতে দুইজন করে ছিলাম। প্রতি তাবুর ভাড়া ৩৫০ টাকা।
  • তাবু সরবরাহ করেছে গিয়াস ভাই। যথেষ্ট আন্তরিক। ফোন নং 01829452446
  • সোনাদিয়ায় আমরা খাবার খেয়েছিলাম একবেলা শুধু রাতের। জনপ্রতি দিয়েছিলাম ১৬০ টাকা করে। দামের সাথে খাবারের পার্থক্য বিস্তর কিন্তু সিচুয়েশন ভিন্ন তাই মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
  • রাতে আমাদের সাথে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে একজন লোকাল মানুষ ছিলেন। উনিই তাবু সেট করেছিলেন।
  • উনাকে দিতে হয় ৪০০ টাকা।
  • বারবিকিউ করতে হলে অবশ্যই গোরাকঘাট বাজার থেকে বাজার প্লাস প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাবেন।
  • দ্বীপে কোনো বিদ্যুৎ নাই। সোলারও খুবই কম। সুতরাং ঘুরতে গেলে অবশ্যই পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যাবেন।
  • দ্বীপে দোকান পাট নাই বললেই চলে। দুটো মনে হয় আছে সেখানে আপনার প্রয়োজন হতে পারে এমন অর্ধেকের অর্ধেক জিনিসপত্র নাই।
  • দ্বীপে তাঁবুতে থাকাটা কতটা সিকিউর? যখনই পসিবল হইছে বিভিন্নভাবে গ্রামের দু চারটা মানুষের সাথে আলাপচারিতার ফাকে জিজ্ঞেস করেছি । উনাদের সাথে বলে বুজলাম আশাকরি কোনোরকমের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার মত না। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন সতর্কের মার নেই। দলবেঁধে থাকার চেষ্টা করবেন।
  • অবশ্যই দামাদামি করতে করে নিবেন। যেখানেই দামাদামির অপশন পাবেন দামাদামি করে যাবেন।
ঝিনুক সৈকত, সোনাদিয়া দ্বীপ

পরিশেষে যেটা বলতে চাই, ঘুরতে গিয়ে ময়লা আবর্জনা এদিকসেদিক ফেলার ব্যাপারে সর্বোচ্চ রকমের সতর্কতা অবলম্বন করুন। পরিবেশের ক্ষতি করা মানেই নিজের ক্ষতি করা আর সোনাদিয়া দ্বীপটা এখনো বানিজ্যিক ট্যুরিস্ট স্পট না হওয়ায় যথেষ্ট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রয়েছে। সুতরাং আপনি ঘুরতে গিয়ে যাতে এই দ্বীপ যাতে অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

Leave a Comment
Share