গবেষণার তাগিদে আমি ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র দ্বীপ রাজ্য তাসমানিয়ার রাজধানী হোবার্টে আসি। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল বাতাস ও দূষণ মুক্ত আবহাওয়া গোটা তাসমানিয়া রাজ্যকে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে করেছে আরও আকর্ষণীয়। গবেষণা ও দৈনন্দিন কাজ আমাকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে রেখেছে ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার গণ্ডিতেই। কারণ অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গবেষণা শিক্ষার্থীদের ছুটি বছরে মাত্র চার সপ্তাহ, যা মাতৃভূমি বাংলাদেশে কাটানোর জন্য সযত্নে রাখা হয়। তা বাদে সরকারি ছুটি বছরে কমবেশি ১০-১৫ দিনের মত, যা আবার অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যগুলোর স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। হোবার্টে ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়া’র পাশেই একটি ছোট্ট স্টুডিও এপার্টমেন্টে আমি আর আমার সহধর্মিণী বসবাস করি। মাস খানেক আগে বাসাবাড়ি বদলে তার ধকল সামলে গত সপ্তাহে ঘুরে আসলাম তাসমানিয়ার ছোট্ট একটি দ্বীপ ব্রূনি আইল্যান্ডে।
হোবার্টে শহর থেকে ব্রূনি আইল্যান্ডের দূরত্ব মোটামুটি ৮৫ কিলোমিটারের মত। আর পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে হলে পাড়ি দিতে হবে আরো ১০০ কিলোমিটারের মত পথ। দূরত্ব বেশি না হওয়ায় দিন গিয়ে দিনেই ফিরব বলে আমরা পরিকল্পনা করলাম। বেশ সকালে উঠেই আমার সহধর্মিণী আগের রাতের তৈরি করে রাখা খাবার গুলো গরম করে কয়েকটি বক্সে নিয়ে নিল, যা আমাদের সারাদিনের জন্য যথেষ্ট। তাসমানিয়া দক্ষিণ গোলার্ধের দ্বীপ, এখন ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে গ্রীষ্মের প্রায় শেষভাগ। এখানকার ঋতু পরিবর্তনের ধারা বাংলাদেশ বা উত্তর গোলার্ধের দেশের উল্টা, যেমন ডিসেম্বর,-জানুয়ারিতে তাপমাত্রা একটু বেশি থাকে, যা জুন-জুলাইয়ে সর্বনিম্ন হয়। মোবাইলের তথ্যের ভিত্তিতে আজকের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে। কিন্তু এখন তা ৭ ডিগ্রির কম। হ্যাঁ, গ্রীষ্মে এখানকার আবহাওয়া এই রকমই হয়। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ৪-৫ গুন তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যেমন ধরুন গত ৩০ শে জানুয়ারি একটি হিটওয়েভ আঘাত হানে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া, ভিক্টোরিয়া ও তাসমানিয়া রাজ্যে, তাসমানিয়াতে, ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তার ঠিক ৪৮ ঘণ্টা পরেই তাসমানিয়ার ক্রেডেল মাউন্টেনে তুষারপাত হয়। মোবাইল অ্যাপে আপনি রোদ্দুর ঝলমলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে যদি ছাতা ও শীতের মোটা জ্যাকেট নিতে ভুলে যান তাহলে অনেক সময় বিপদেও পড়তে পারেন। সে কারনেই তাসমানিয়াকে অনেকে অনিশ্চিত আবহাওয়ার দ্বীপ বলেন। যাহোক, আমরা ছোটখাট পিকনিক করার মত যা যা লাগে তা গাড়িতে নিয়ে নিলাম। ব্রূনি আইল্যান্ডে খুবই কম বসতি আছে, যা প্রায় ১.৬ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। লোকালয় অনেক কম হাওয়াতে দোকানপাট ও রেস্তোরাঁ বেশি নেই। যথেষ্ট গাড়ির জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস আমরা আগেই নিয়ে নিলাম।
হোবার্ট থেকে সাউদার্ন আউটলেট মহাসড়ক হয়ে গাড়ি ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে শুরু করল। এখানকার রাস্তাগুলো অনেক প্রশস্ত হলেও গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসিমা তুলনামূলক কম। যার প্রধান কারণ হল পাহাড়ি রাস্তা আর তীক্ষ্ণ বাঁক। কোথাও পাথরের পাহাড় কেটে বা কোথাও ছোট ছোট সেতু বানিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যা দেখলেই বুঝা যায়, অস্ট্রেলিয়ানরা পরিবেশের যত কম ক্ষতি করে অবকাঠামো তৈরি করা যায় তার দিকেই তাদের বেশি লক্ষ্য। আমরা কিংবরা সিটি কাউন্সিলের কিংসটন শহর হয়ে চ্যানেল হাইওয়েতে উঠলাম। দুই লেনের আঁকাবাঁকা রাস্তা যার দুই পাশে সাদা দাগ জানিয়ে দিয়েছে নিজের গতিপথ। চারদিকে ধূসর মাইলের পর মাইল চারণ ভুমি। কোথাও গরুর আবার কোথাও ভেড়ার পাল। মাঝে মাঝে অনেক ঘোড়া দেখা যায় মাঠে একাগ্র চিত্তে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। গাড়ির গতি এখন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটারের মত। রাস্তার পাশে কিছু দূর দূর পরে রাখা হাতে লেখা কিছু সাইন বোর্ড চোখে পড়লো, আলগা করে মাটিতে রাখা বা অস্থায়ী কিছুর সঙ্গে আলত করে বাঁধা। সাইন বোর্ডের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী ১ কিলোমিটার পরেই তাজা ফলের দোকান। তাসমানিয়াতে রাস্তার পাশে এই রকম ফলের দোকান অনেক। স্থানীয় কৃষকরা নিজেদের চাষ করা এই সতেজ ফল গুলো নিজেরাই বিক্রি করেন। কেউ কেউ আবার বাড়ির পেছনের উঠানে অনেক রকমের শাকসবজি, সালাদ ও ফলের চাষ করেন। নিজেরা খাবার পরে উদ্বৃত্ত গুলো কমদামে রাস্তার পাশে দোকানে অথবা অনলাইনে বিক্রি করে দেন। এই রকমি একটি ফলের দোকানে আমরা আমাদের স্বল্প যাত্রা বিরতি করলাম,। দোকানে বিভিন্ন প্রজাতির অ্যাপেল, কমলা, পাম ফল, গ্র্যাপ ফল, চেরি, এপ্প্রিকট সহ প্রায় সবই পাওয়া গেল। মারগেট নামক একটি ছোট্ট শহরে এসে পৌছলাম। হোবার্ট শহর যে ডারওয়েন্ট ওয়াটার নদীর তীরে অবস্থিত, তারই আরেকটি চ্যানেলে মারগেট শহর। ব্রিটিশরা মারগেটের ডারওয়েন্ট ওয়াটার নদীর তীর কয়লা আমাদানির কাজে ব্যবহার করত ১৮০০ শতকের দিকে। যা এখন অনেকটা ছিমছাম ছোট্ট শহর। চ্যানেল হাইওয়ের একপাশে তাসমানিয়ার ছোটছোট জনপথ ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর অন্যপাশে ডারওয়েন্ট ওয়াটার নদীর D’Entrecasteaux চ্যানেল। ফ্রেঞ্চ ভাইস অ্যাডমিরাল Bruni D’Entrecasteaux ১৭৯২ সালে এই চ্যানেলটি আবিস্কার করেন। তার নাম আনুসারেই এই চ্যানেলের নাম করন হয়েছে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে রাস্তার দুই পাশে মোটামুটি ৪ ফুট উচ্চতার তারের বেড়া দেয়া আছে, যা মূল রাস্তা থেকে প্রায় ১৫ ফুট দুরে। যেন বন্য প্রাণী হঠাৎ না চলে আসে। যদিও রাতে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ওয়ালাবি, ক্যাঙ্গারু সহ অনেক প্রাণীই রাস্তাই চলে আসে এবং গাড়ির ধাক্কায় অনেক প্রাণী আহত বা নিহত হয়। গড়ে প্রতি ১ কিলোমিটারের মধ্যে ৪ – ৬ টি এই রকম বন্য প্রাণীর দেহাবশেষ চোখে পড়লো। যদিও এই সংখ্যা কোন কোন রাস্তায় আরও বেশি। আমরা পৌঁছেগেলাম কেটেরিং নামক আরেকটি ছোট বন্দর শহরে। এখান থেকেই আমরা আমাদের গাড়ি সহ একটি ফেরীতে উঠবো। একটি মাত্র জেটি থেকে ৩০ মিনিট পর পর ফেরীগুলো ব্রূনি আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ফেরীগুলো দোতালা, যার মধ্যে প্রায় ৬০ গাড়ি একসাথে পারাপার করতে পারে। অনলাইনে টিকেট করা যায়। আমরা করিনি কারণ প্রথমত তাৎক্ষনিক টিকেট করার ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয়ত, অগ্রিম টিকেট করলে সময়মত পৌঁছানোর মানসিক চাপ কাজ করে যা আমরা চাইনি। আমরা জেটির দিকে এগুতে থাকলাম। জেটির আসে পাশে অনেক ছোট ছোট মাছ ধরার বিশেষ বোট ও অনেক ইয়ট যে গুলো করে অনেকে সমুদ্রে ভ্রমণে যায়। অনেকগুলো পালতোলা বিশেষ নৌকাও দেখাগেল। পাল নামানো প্রায় শখানেক নৌকা নোঙ্গর করা আছে। বন্দরে পালতোলার নৌকার বিশেষ দড়ি আর বড় লোহার মাস্তল বাতাসের আঘাতে বিশেষ ধরনের সোঁ সোঁ শব্দ তৈরি করছে। দূর থেকে চোখে পড়লো মূল জেটিতে যাওয়ার পথনির্দেশনা। গাড়ির গতি এখন কমে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার। কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েকটি লেনে প্রায় ৫০-৬০ টি গাড়ি হাজির হয়ে গেল। হলুদ পোশাকে ভদ্রমহিলা টিকেট কাউন্টারে দাঁড়ান। জেটি সংযোগ রাস্তার ঠিক পাশেই কাউন্টারটি এমন ভাবে লাগানো যেন আমরা গাড়িতে বসেই প্রয়োজনীয় ডলার পরিশোধ করে টিকেট সংগ্রহ করতে পারি। গাড়ির আকারের ওপর ভিত্তি করে টিকেটের দাম নির্ধারণ করা হয়। যা আমরা আগে থেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে জেনে গিয়েছিলাম।
আমাদের গাড়ির জন্য ৩৮ অস্ট্রেলিয়ান ডলার জমা দিলাম। টিকেটের সাথে আমরা ও আমাদের সব মালামাল নিয়ে যাওয়া ও আসার মূল্য যুক্ত ছিল। পর পর তিনটি লাইনে আমাদের গাড়ি গুলো বহির্গমনের জন্য রাখা হল। সবাই সবার গাড়ির মধ্যে অবস্থান করল। জেটির একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেরী এসে নোঙ্গর করল। একটি ঝুলন্ত স্বয়ংক্রিয় সেতু ফেরী ও জেটিকে এমনভাবে সংযুক্ত করলো যেন গাড়ি চালিয়ে খুব সহজেই ফেরীতে উঠা যায়। প্রথমে একে একে প্রায় ২৫ টি গাড়ি ফেরীর নিচের ডেকে উঠে গেল। এবার আমাদের লাইনের পালা। ইতোমধ্যে ঝুলন্ত সেতুটি ওপরের ডেকের সাথে সংযুক্ত হল। আমি জীবনে এই প্রথম গাড়ি চালিয়ে এত উচ্চতার ফেরীতে উঠলাম। একটু পরই ফেরী চলতে শুরু করল তাসমান সাগরের সাথে সংযুক্ত D’Entrecasteaux চ্যানেল দিয়ে প্রায় ২৫ নট গতিতে। এখন গাড়ি থেকে নামা যাবে। ফেরী ওপারে পৌছুতে সময় লাগবে ১৫ মিনিটের মত। আমরা প্রায় সবাই গাড়ি থেকে নেমে সাগরের নিলাভ জলরাশি আর ঠাণ্ডা বাতাস উপভোগ করলাম। দেখে মনে হচ্ছে দূরে কালমেঘের মধ্যে পাহাড় গুলো যেন গুজে দেয়া আছে। এই চ্যানেলে অনেক ডলফিন দেখা যায় কিন্তু আমাদের ভাগ্যে দেখা জুটল না। আমরা যথা সময়ে ফেরী থেকে ব্রূনি আইল্যান্ডে নামলাম। নেমেই আমরা যাত্রা শুরু করলাম ‘দ্যা নেক ’ এর উদ্দেশ্যে। এখন রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিসিমা ঘণ্টায় ৮০-১০০ কিলোমিটার বা কোথাও কোথাও ৫০ এর মত। ব্রূনি আইল্যান্ডবাসির প্রধান আয় হল ট্যুরিজম খাত থেকে। কিছু কিছু জায়গায় একতলা বিশিষ্ট হোটেল আছে। যারা অনেক সময় নিয়ে দূর থেকে বেড়াতে আসেন তারা মুলত এই হোটেল গুলো বেছে নেন। সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুক, লবস্টার সহ নানা ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এখানকার প্রায় সব রেস্তোরাঁতেই। পথে অনেক মোটরহোম, ক্যাম্পার ভ্যান ও ক্যারাভান দেখা গেল। যারা মূলত কয়েক সপ্তাহ থেকে শুরু করে মাস খানেকের জন্য বেড়াতে আসেন তারা পরিবার সমেত থাকার জন্য এই রকম বাহন ভাড়া নেন। যার মধ্যে রান্না, খাওয়া, গোসল ও ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। যা কিছু কিছু নির্দিষ্ট স্থানে ক্যাম্পিং এরিয়াতে পার্কিং করে রাখা যায়। ক্যাম্পিং এরিয়াতে ক্যাম্পারদের জন্য টয়লেট, পানি ও গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করার ব্যবস্থাও আছে। আমরা ‘দ্যা নেক ’ এ পৌঁছে গেলাম।
‘দ্যা নেক ’ হল D’Entrecasteaux চ্যানেল আর তাসমান সাগরের মধ্যে অবস্থিত সবচেয়ে সরু ভূখণ্ড। একপাশে D’Entrecasteaux চ্যানেলের তুলনামূলক শিথিল জলরাশি আর অন্য পাশে তাসমান সাগরের গর্জন তোলা বিশাল বিশাল ঢেউ যার সীমানা পৃথিবীর সর্ব দক্ষিনে এন্টার্কটিকা পর্যন্ত বিস্তৃত বিস্তৃত। ‘দ্যা নেক ’ এ আমরা গাড়ি পার্ক করে প্রায় ২৫০ টি সিঁড়ি বেয়ে একটি ছোট পাহাড়ে উঠলাম। এখান থেকে D’Entrecasteaux চ্যানেল আর তাসমান সাগরের ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য দেখা যায়। দেখলে মনে হয়, দুই পাশের জলরাশি দিয়ে এই ৪০ মিটারের মত ভূখণ্ডকে গলা চিপে ধরে রেখেছে। এই ৪০ মিটার ভূখণ্ডের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে এডভেঞ্চার বে ও কেপ ব্রূনি লাইট হাউজের দিকে। সে রাস্তায় গাড়ি গুলোকে দেখলে মনে হয়, ব্রূনি আইল্যান্ড তার গলা দিয়ে এই গাড়ি গুলো গিলছে আর গিলছে। আমরা ‘দ্যা নেক ’ এর সৈকতে অনেক সময় কাটালাম। ভিনদেশে আরও কত ভিনদেশী মানুষ ভ্রমনের উদ্দেশ্যে যে এখানে জড় হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কেউ ছবি তুলছে্ন, কেউ ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করছেন আবার কেউ ভিডিও শুট করছেন। এখানে বাতাসের বেগ হোবার্টের থেকে দ্বিগুণ। ড্রোন ওড়ানো বেশ কঠিন। দেখতে দেখতে আমরা নেকরিজার্ভ ক্যাম্পিং এরিয়াতে আসলাম। যা মেইন রোড থেকে কয়েকশ মিটার ভিতরে একটু ঘন বনের মধ্যে। প্রায় ১০-১২ টির মত মোটরহোম, ক্যাম্পার ভ্যান ও ক্যারাভান দেখা গেল। আমরা এখানে দুপুরের খাবার খাব। কিন্তু ক্যাম্পিং এয়ারিয়ার প্রায় সব জায়গায় তাদের দখলে। কেউ রান্না করছেন, কেউ কাপড় ধুচ্ছেন, অনেকে তাদের ভ্যান রেখে বনের মধ্যে ট্রেকিং এ গেছেন। আমরা একটি স্পট পছন্দ করলাম। পাশের ক্যাম্পে ফ্রেঞ্চ পরিবার আড্ডা দিচ্ছিলেন। আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।
কেপ ব্রূনি লাইট হাউজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এখান থেকে আরও ৩৫ কিলোমিটার দূরে। একটু পরেই রাস্তা আরও সরু হয়ে আসলো। এখানে বেশি মানুষের যাতায়াত নেই। ঘন বনের মধ্যে দিয়ে আধা পাকা আঁকাবাঁকা রাস্তা। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা আরও সরু হয়ে গেছে। ঘন বনের ভিতরে দিব্বি গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে যেতে হচ্ছিল। অনেকে রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে বনের মধ্যে ট্রেকিং করছেন। কেউ কেউ ২ -৩ ঘণ্টার জন্য ট্র্যাকিংএ গেছেন কেউ বা আবার সারাদিনের মনে। আমাদের সময় সাহস কোনটায় নেই। আমরা ট্রেকিংএ গেলাম না। এখন প্রায় বেলা গড়িয়ে ৪ টা। কেপ ব্রূনি লাইট হাউজে পার্কিং অনেক কম। বছরের এই সময়টাই এখানকার তাপমাত্রা বেশ ভাল থাকে তাই অনেক দর্শনার্থী আসেন। শীতে তাপমাত্রা অনেক কমে যায়, আর প্রচণ্ড বাতাস, ঠাণ্ডার অনুভুতি কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়। কেপ ব্রূনি লাইট হাউজ হল অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে দ্বিতীয় পুরাতন লাইট হাউজ। ১৮৩৮ সালে মূলত আবহাওয়া ও যোগাযোগের জন্য তৎকালীন গভর্নর জর্জ আরথার এটি নির্মাণ করেন। ডেলরাইট পাথর দিয়ে ওই সময়ের দণ্ডিত কয়েদীদের দ্বারা এই লাইট হাউজটি নির্মাণ করা হয়েছিল। লাইটের প্রধান জ্বালানি হিসেবে স্পারম হোয়েল নামক এক প্রজাতির তিমি মাছের তেল ব্যবহৃত হত। যা পরে ডিজেল জ্বালানি দিয়ে জালানো হত। লাইট হাউজের টাওয়ারের পাশেই গার্ডদের অফিস। এখন সেটি জাদুঘর। জাদুঘরে দেখা গেল তাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র ও অফিসের নথি পত্র। কাঁচের বাক্সে বন্দি আছে তাদের প্রতিদিনের কাজের বিবরণী। বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর বাতাসের গতি, দিক, তাপমাত্রা ও বিশেষ সিগন্যালের বিবরণী লক্ষ্য করলাম। সুশৃঙ্খল দৈনন্দিন কাজের বর্ণনা প্রায় ২৫০ বছর আগে থেকে লেখা হয়েছে। সত্যি অবাক হাওয়ার মত বিষয়। গার্ডদের ব্যবহার করা কেরসিন পাম্প মেশিন ও জেনারেটর তার পাশেই আগের দিনের গ্রাহাম মডেল টেলিফোন বসান আছে। এখন এগুলা অনেক পুরাতন। নতুন টেকনোলজি তাদের স্থান দখল করে নিয়ে তাদের জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। টাওয়ারের ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, বিশাল তাসমান সাগরের জলরাশি দূরে মিলেগেছে আকাশের সাথে। এই প্রান্তে তাসমানিয়া আর অন্য প্রান্তে এন্টার্কটিকা মহাদেশ। সময় এখন সন্ধ্যা ৭ টা হলেও এখনও অনেক বেলা। গ্রীষ্মে তাসমানিয়াতে সূর্য ডুবে প্রায় ৯ টায়। আমরা বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম কারণ দিনের শেষ ফেরিটি আমাদের ধরতে হবে। প্রকিতিকে স্মৃতির বক্সে বন্দী করে চলে আসলাম হোবার্টে।
Leave a Comment