আফ্রিকা ভ্রমন (পর্ব ১) – মাসাইমারা জঙ্গল সাফারি

এমিরেটস এর বোয়িং ৭৭৭ যখন দমদম বিমান বন্দর থেকে আকাশে উড়ল তখন গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম যে বিদেশযাত্রার স্বপ্নটা আর স্বপ্ন নয় সত্যি হলো তবে। গত একবছরের প্রচেষ্টা স্বার্থক। আমি আর শুভাশিস চলেছি মাসাইমারার উদ্দেশ্যে। বিমানের মধ্যে বেশ ভালই কাটল। খাওয়া দাওয়া সিনেমা দেখা সে এক এলাহী ব্যাপার। ঠিক ৪ঘন্টা ১০ মিনিট পর এসে পৌঁছলাম দুবাইতে। তখন ভারতীয় সময় দুপুর ২.৩০।

বিমানবন্দরে নেমে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কেন দুবাইকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিমানবন্দর বলে তা বুঝতে পারলাম। আমি আর শুভাশিস ইতস্তত ঘুরতে লাগলাম। সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে হয়ে উঠেছে “বিশ্ব ভরা প্রাণ”। প্রায় ঘন্টা তিনেক এখানে কাটাবার পর আবার এমিরেটসেরই বোয়িং ৭৭৭ এয়ারবাসে করে ৪ ঘন্টা ১৫ মিনিট পরে এসে পৌঁছলাম নাইরোবির জোমো কেনিয়াট্টা বিমানবন্দরে। তখন ভারতীয় সময় রাত ১০ টা ২৫ মিনিট। বেশ ঠান্ডা তখন। প্রায় ঘন্টাখানেক লাগল প্রশাসনিক কাজকর্ম সারতে। তারপর বাইরে বেরিয়ে দেখি আমাদের জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ২০ মিনিট পর এসে পৌঁছলাম হোটেল মেলিলিতে।

একটা কথা এখানে বলে রাখি কেনিয়া (Kenya) আফ্রিকার অন্যতম দরিদ্র দেশ। চুরি, ছিনতাই লেগেই আছে রাস্তাঘাটে। কিন্তু সাধারন মানুষ বেশ সুশৃঙ্খল। আমরা জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছি আর সব গাড়ি নিজে থেকেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যা আমাদের এখানে কল্পনারও অতীত। দেখে ভাল লাগল “সেইফ ড্রাইভ, সেইভ লাইফের” অনুপ্রেরনামূলক প্রচার চারিদিকে না থাকলেও লোকজন তা মানছেন।

মাসাইমারা জঙ্গলে জিরাফ

হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিয়েই দুজনে চলে গেলাম ঘুমের দেশে। পরের দিন অর্থাৎ ২৯শে জুলাই ভারতীয় সময় সকাল ৯.৩০ শে ঘুম থেকে উঠলাম।স্নান সেরে প্রাতরাশ করে নিলাম দুজনে। একটু বাদে গাড়ি চলে এল। আমরাও ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম জিরাফ রেসকিউ সেন্টারে। এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে জিরাফদের উদ্ধার করে আনা হয়। বেশ কিছু জিরাফ এখানে আছে। সকালের দিক গেলে দর্শকরা হাতে করে জিরাফদের খাওয়াতেও পারেন। আমরাও খাওয়ালাম। সে এক মজার অভিজ্ঞতা।

এরপর গেলাম এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজে। এখানে মাতৃহারা শাবকদের রাখা হয়। প্রত্যেকদিন সকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্ছাগুলো জঙ্গল থেকে দৌড়ে আসে দুধ খাবার জন্য। কর্মীরা নিজেদের হাতে বড় বড় ফিডিং বোতলে বাচ্ছাগুলোকে দুধ খাওয়ান। ওরা দুধ খায়, মাটি মেখে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে খেলা করে। সে এক অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য। এখান থেকে বেরিয়ে একটা শপিং মলে ঢুকে জল, বিস্কুট, কেক, স্ন্যাকস অল্প করে কিনে নিলাম। মলের মধ্যে বাটার বিশাল দোকান দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সবশেষে গেলাম আমাদের ট্রাভেল এজেন্সী কেনিয়া ওয়াকিং এর অফিস। ট্রাভেল এজেন্সীর এত বড় অফিস দেখিনি আগে। মালিক মি. ওটিনো একজন অমায়িক মানুষ। ওখান থেকে ফিরে এলাম মেলিলি হোটেলে। আগামীকাল থেকে শুরু হবে পৃথিবী বিখ্যাত মাসাইমারা সাফারি।

৩০শে জুলাই সকাল আটটায় নাইরোবি ছাড়লাম। যাবার পথে পড়ল The great rift valley. পাহাড়ী জায়গায় দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে এসে পৌঁছলাম নারক বলে একটা ছোট শহরে। এখানেই লাঞ্চ সারলাম। এখান থেকেই গাড়ি পরিবর্তন হোলো। আমরা টয়োটা ছেড়ে উঠলাম ছাদখোলা বড় সাফারি গাড়িতে। ড্রাইভার হলো মাসাইমারার অন্যতম সেরা রুবেন। প্রায় সাড়ে চারটের সময় মাসাইমারার (Masai Mara National Park) জঙ্গলে পদার্পন করলাম।

প্রথমেই একদল জেব্রা আর ইম্পালা হরিনের দল আমাদের স্বাগত জানাল। এরপর কিছুটা এগোতেই এক বিশাল দেহী দাঁতাল হাতির সঙ্গে মোলাকাত হলো। সে তার ওই বিশাল শরীর নিয়ে আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মনে হোলো যেন ওই আমাদের দেখতে এসেছে। তরপরই রুবেন গাড়ি ছোটালো অন্যদিকে যেখানে দুই শৃঙ্গের এক গন্ডার মহাশয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তিনি যেন লজ্জাবতী লতা। আফ্রিকার বিখ্যাত সাভানা ঘাসের আড়ালে লুকিয়েই থাকলেন। তবে যা দেখলাম তা আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট।

সেদিন আরো কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘোরাঘুরি করে কিছু ওয়াইল্ড বিস্ট, বুনো মহিষ আরো ইম্পালা, অ্যান্টিলোপ দেখে ফিরে এলাম মারা সোপা লজে। এসে তো চোখ পুরো তালের বড়া। এ কোথায় এলাম। এ যেন “বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান”। সারা পৃথিবীর লোক বোধহয় এক ছাদের তলায় এসে হাজির হয়েছে। ইউরোপীয়ান, বৃটিশ, চাইনীজ, জাপানীজ, শ্রীলঙ্কান আরা সঙ্গে আমরা দুই বিখ্যাত (!!) বাঙালী পলাশ আর শুভাশিস। ঠিক যেন শঙ্কর আর শঙ্করলাল। মোট ১০১ টা ঘর লজে। বিশাল রিসেপশান লাউঞ্জ। বিভিন্ন ভাষার মানুষের কলকাকলিতে জায়গাটা মুখরিত হয়ে উঠেছে। সুইমিংপুল পেরিয়ে আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত ঘরে গেলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে রিসেপশানে এসে চা খেলাম। চাই রয়েছে ৩/৪ রকমের, সঙ্গে কফি, চকোলেট আরও কত কি। ঘন্টাখানেক বাদে পাশের ডাইনিং রুমে গেলাম ডিনার করতে। সেখানেও চোখ ছানাবড়া। কি খাব। কোথা থেকে শুরু করব বুঝতেই পারছিলাম না। প্রায় ৫০/৬০ রকমের খাবার। জিভের সঙ্গে চোখেও জল এসে গেল। শরীরটা ভাল থাকলে ওদের বুঝিয়ে দিতাম খাওয়া কাকে বলে। কি আর করা যাবে? ডিনারা শেষে ঘরে ফিরে ঘুমের দেশে চলে গেলাম।

৩১শে জুলাই সকাল সাড়ে ছটায় packed breakfast আর লাঞ্চ নিয়ে বের হলাম সারাদিনের সাফারির জন্য। সাফারি শুরুর সঙ্গে জিরাফ আর জেব্রারা অভ্যর্থনা জানাল। আর একটু এগোতেই দেখি সব গাড়ি একটা নির্দিষ্ট দিকে দৌড়াচ্ছে। আমরাও দৌড়ালাম সেই দিকে। গিয়ে দেখি ৮জন সিংহ পত্নী মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যেই সাংসারিক আলোচনায় ব্যস্ত মনে হলো। সকালে বাচ্ছাদের ইম্পালা না জেব্রা–কার মাংস দেবে সেই নিয়েই চিন্তিত। তাদের চারিদিকে প্রায় ২৫/৩০ টা গাড়িতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্বাদের এত নধর নধর মাংস রয়েছে সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই। আমরাই মনের সুখে ছবি তুলতে লাগলাম। সিংহীদের মর্নিং আড্ডা পর্ব শেষ হলে তেনারা হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন।

এরপর ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল জিরাফ দম্পতি মনের সুখে গাছের পাতা খেতে খেতে প্রতরাশ সারছেন। আমাদেরও মনে হলো যে প্রাতরাশটা সেরে নিলে হয়। একটা বড় গাছের তলায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা প্রাতরাশ সেরে নিলাম। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। চারিদিকে ধূ ধূ প্রান্তর, তার মাঝখানে একটা গাছের তলায় আমরা প্রাতরাশ করছি। প্রাতরাশ শেষে আবার সাফারি শুরু হোল। কত যে জন্তু জানোয়ার দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। জিরাফ, জেব্রা, ইম্পালা, থমসনস গ্যাজেল, অ্যান্টিলোপ, বাফেলো ইত্যাদি। তবে তার মধ্যে সেরা ঘটনা হলো The Grear Migration দেখা।

দুপর বারোটা নাগাদ হঠাৎ খবর পাওয়া গেল যে স্যান্ড নদীর ধারে wild beast রা জমায়েত হয়েছে নদী পেরনোর জন্য অর্থাৎ মাইগ্রেশানের জন্য। রুবেনও আমাদের গাড়ি ছোটালো সেইদিকে। মিনিট কুড়ি বাদে অকুস্থলে গিয়ে দেখি গাড়ির মেলা নদীর ধারে। আমরাও অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই হাজার হাজার ওয়াইল্ড বীস্টের সাথে। প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষা করার পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তানজানিয়ার সেরেঙ্গিটির জঙ্গল থেকে হাজার হাজার ওয়াইল্ড বীস্ট কেনিয়ার মাসাইমারার জঙ্গলে ঢুকতে লাগল স্যান্ড নদী পেরিয়ে। অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ লাগল। যা এতদিন দেখেছি animal planet, national geographic channelএ, তাই আজ স্বচক্ষে দেখলাম। আমাদের জীবন স্বার্থক।

এরপর গাড়িতে বসেই লাঞ্চ সারলাম মারা নদীর ধারে। নদীতে বেশ কিছু জলহস্তী ও কুমীর দেখলাম। এই মারা নদী দিয়েও migration হয়। দুপুর দুটোর পর আবার সাফারি শুরু হোলো। একটা গাছের ওপর লেপার্ডের ভুক্তাবশেষ হরিনের দুটো পা ঝুলছে দেখলাম। একদল শকুন একটা পশুর মৃতদেহ মহানন্দে ভোজন করছে। জিরাফ, জেব্রার কথা নাই বা বললাম। ফিরে আসার পথে আবার ব্রেকিং নিউজ। এক জায়গায় দেখি দুটো মেয়ে আর একটা পুরুষ উটপাখী খুব নাচানাচি করছে। রুবেন গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। বলল এখুনি ওদের মিলন শুরু হবে হলোও তাই। এই আফ্রিকার প্রত্যন্ত প্রান্তরে আমরা উট পাখীর মিলনের সাক্ষী থাকলাম।

১লা আগষ্ট আবার সকাল সাতটায় বের হলাম সাফারিতে। প্রথমেই এক শিয়াল দম্পতির সাথে দেখা। তারপর কিছুটা এগোতেই দেখি একপাল দাঁতাল ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের সুখে। ঘুরতে ঘুরতেই খবর এল চিতারা আজ প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়েছেন। এইবার দেখলাম রুবেনের কেরামতি। জল, কাদা ভরা এবড়ো খেবড়ো প্রান্তরের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালালো একদম রাজধানীর গতিতে। ওই রকম মাঠের মধ্য দিয়ে যে ওরকম গাড়ি চালানো যেতে পারে তা না বসে থাকলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রায় ২৫ মিনিট পর আমরা হাজির হলাম চিতাস্পটে। বেশ কিছু গাড়ি এসে হাজির। খবর পেয়ে আরো গাড়ি আসছে। আর তার মধ্যে দিয়েই তিনটে চিতা দুলকি চালে দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে। কোনোদিকে কোনো হেলদোল নেই।

এখানে আবার রুবেন তার কেরামতি দেখাল। সব গাড়ি যেদিকে দাঁড়িয়ে ও তার উল্টোদিকে গাড়ি ছোটালো ফল পেলাম আমরা। ও এমন জায়গায় গাড়িটাকে দাঁড় করাল যে কিছুক্ষণ বাদে ওই তিনটে চিতাই আমাদের গাড়ির একদম পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেল। ভাল করে দেখে বুঝলাম যে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একদল ইম্পালার দিকে ওদের নজর। আর প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেলা অতদূর থেকে হরিনগুলোও চিতা তিনটেকে দেখে সতর্ক হয়ে পালাতে লাগল। আমরা বেশ কিছুক্ষন চিতাদের পদচারনা দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম। এরপর একটা গাছের তলায় একটা সিংহ পরিবারকে দেখলাম বিশ্রাম নিচ্ছে। এরপর উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম।

তারপর যখন দুপরবেলা লাঞ্চ করার জন্য লজে ফিরছি তখন আবার একটা BIG BREAKING NEWS. হঠাৎ রুবেন গাড়ি থামিয়ে অদূরে ঘাসের জঙ্গলের দিকে ইঙ্গিত করল। দেখি এক সিংহ রমনী ঘাসের জঙ্গলে লুকিয়ে বসে সামনের গাছের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই গাছের তলায় থমসনস গ্যাজেলের এক পরিবার মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে। সিংহীদেবী খুব সন্তর্পনে ঘাসের জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে নিজেকে প্রস্তুত করল। প্রায় ২০ মিনিট ধরে অপেক্ষা করার পর ও বাচ্ছা হরিনটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথমেই কিন্তু মারল না। বাচ্ছাটা তিন চার বার সিংহীর পায়ের তলা থেকে বেরিয়ে গেল ছুটে কিন্তু পরমুহুর্তেই আবার সিংহীর দখলে। তারপর শিকার সম্পূর্ন করে মুখে করে নিয়ে তিনি চলে এলেন নিজের শাবকদের মুখে খাবার তুলে দিতে। আর আমরা মনের মধ্যে রোমাঞ্চ এবং বিষাদ দুটো নিয়েই ফিরে এলাম লজে।

এরপর বিকালে গেলাম মাসাইদের গ্রামে। বড় অদ্ভুত তাদের জীবনযাত্রা। এক জায়গায় ৮ বছরের বেশী থাকে না। সারাদিনে দুবার খায়। গরুর রক্তের সাথে দুধ মিশিয়ে খায় শক্তি অর্জনের জন্য। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঘরে পরিবার নিয়ে তারা থাকে। আজও লাঠি ঘষে আগুন জ্বালে। তবে ইদানীং বাচ্ছাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে তারা। এরপর সন্ধ্যেবেলা মারা লজে ফিরে এলাম। আমাদের মাসাইমারা ভ্রমন শেষ হলো। এরপর যাবো লেক নাইভাসা, এমবোসেলি ন্যাশনাল পার্ক ( যেখান থেকে মাউন্ট কিলিমাঞ্জরো—চাঁদের পাহাড় দেখা যায়) আর সবশেষে জাঞ্জিবার সমুদ্রতটে।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ africakenyamasai marasafari