সুন্দরবনের করমজলে একদিন

মানুষ সুন্দরের পুজারী, পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর সবই মানুষের জন্য সৃষ্টি। সৃষ্টি সুন্দরের অন্বেষনে মানুষ খুঁজে ফিরে এধার থেকে ওধার। আর এই অপার দৃষ্টিনন্দন সুন্দর সৃষ্টি স্থানের নামই যদি হয় সুন্দরবন তাহলে আর নতুন করে বলার প্রয়োজন থাকে না কতটা সুন্দর ঐ বনটি। মনের মাঝে অনেক আগেই বনটি দেখার বাসনা জেগেছিল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলা দৈনন্দিন জীবন যখন পায় না শ্রান্তি বিনোদনের সামান্য সুযোগ তখন সুন্দরটা বড় অসুন্দর হয়ে মনের খিড়কী দুয়ার দিয়ে পালিয়ে রক্ষা পায়। তবুও আশায় বাঁধি বুক, একদিন ঠিকই সুন্দরের পুজা দিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবো সুন্দরবনে।

গত মার্চের মাঝা-মাঝি বন্ধু হালিমের ইচ্ছার কাছে সময়কে হার মানিয়ে যাত্রা শুরু করি সুন্দরবনে। সকাল ৮টা নাগাদ মংলা পৌছে ৪০০ টাকায় ঠিক করা হলো বিভিন্ন রংয়ের কারুকাজে সাজানো একটি ইঞ্জিন চালিত পানসী নৌকা। শর্ত বিকাল ৫টা পর্যন্ত যতক্ষন ইচ্ছা সময় কাঁটাতে পারবো সুন্দরবনের করমজল ফরেষ্ট রেঞ্জের ইকো ট্যুরিজম ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র এলাকায়। সংগে নেওয়া হলো হালকা খাবার আর পানীয় জল। অজস্র ঢেউ ভেঙ্গে বাসযোগ্য এলাকাকে পিছনে ফেলে গহীন পানিতে নোঙ্গর করা বড় বড় জাহাজ দেখতে দেখতে প্রায় ৪০ মিনিট পর পৌছে গেলাম নয়নাভিরাম দৃষ্টিনন্দন করমজল ফরেষ্ট রেঞ্জে।

নৌকা নোঙ্গর করার জন্য কাঠ দিয়ে তৈরী দারুন সব ঘাটে রং বেরংয়ের নৌকা আর চোখ জুড়ানো সবুজ গাছের সমারোহ চোখের সামনে এঁকে দিলো নতুন এক পৃথিবী। একটি দৃশ্য দেখে চোখ আটকে গেলো পাশের আরেকটি নৌকায়। একজন লোক একটি হরিক শাবক নিয়ে বসে আছে নৌকাটিতে। কৌতুহল মিটাতে কাছে গিয়ে জানা গেলো হরিণ শাবকটি পথ ভুলে লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় এলাকার লোকজন তাড়া করে হরিণ শাবকের একটা পা ভেঙ্গে দিয়েছে। সংবাদ পেয়ে বনরক্ষীরা তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। হরিন শাবকের পা দিয়ে ঝরছে রক্ত আর দু’চোখ দিয়ে ঝরছে কান্নার জল।

নৌকার মাঝি পথ প্রদর্শক হিসাবে আমাদের সাথে নেমে কুমির প্রজনন কেন্দ্রের প্রবেশ মূখের দিকে যেতেই বাঁধ সাদলো এক বনরক্ষী। কারন জিজ্ঞাসা করতে জানালেন মুরগী নিয়ে কুমির প্রজনন কেন্দ্রে প্রবেশ নিষেধ। আমরা শখ করে কুমিরকে খাওয়ানোর জন্য একটা মুরগী কিনে নিয়েছিলাম মংলা থেকে। উদ্দেশ্য ছিলো মুরগী খেতে দিয়ে কুমিরকে কাছ থেকে দেখা। বনরক্ষী আরো জানালেন মুরগী নিয়ে প্রবেশ করতে হলে প্রানী বিশেষজ্ঞ আঃ রব সাহেবের অনুমতি নিতে হবে। বনরক্ষীর সাহায্যে পাশেই কাঠ দিয়ে নির্মিত দ্বিতল একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে আঃ রব সাহেবকে পাওয়া গেল। বিষয়টা জানতে পেরে তিনি স্মিত হেসে বললেন “মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী”। আমরা হতবাক তার কথা শুনে। চোখ মূখ দেখে তিনি বিষয়টা আঁচ করতে পারলেন কতটা আঘাত পেয়েছি আমরা। পরিচয় পর্ব শেষে তিনি আমাদেরকে সোফায় বসতে বলে শুরু করলেন মায়ের দরদের কাহিনী। ভুল ভাঙ্গলো আমাদের, চিনতে পারলাম মা’কে। এই মা আর কেউ নয়, আমাদের সদাশয় কর্তৃপক্ষ। যাদের অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায় আজ বাংলাদেশের একমাত্র সরকারী কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি শেষ সিড়ি ভেঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে ধ্বংশের দারপ্রান্তে। চাহিদার তুলনায় প্রাপ্তির অপ্রতুলতায় অনাহারে থাকা কুমিরগুলো যে কোন সময় প্রজনন কেন্দ্রের মানুষ খেতে আক্রমন করতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। তিনি অত্যান্ত ক্ষোভের সাথে জানান যেখানে কুমিরের পরিচর্যার জন্য মাসে এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকার প্রয়োজন সেখানে বরাদ্দ মাত্র আট হাজার টাকা। এই স্বল্প টাকা দিয়ে কুমির পালন, প্রজনন ও প্রজননকৃত কুমির ছানাদের সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া অত্যান্ত ঝুকি পূর্ণ হচ্ছে দিন দিন। এক সময় খাবারের অভাবে কুমির মানুষ খাওয়ার জন্য আক্রমন করতেই পারে। আমাদের মুরগীটি হয়তো কুমিরের খামারে নিয়ে গেলে মুরগীটি খাওয়ার জন্য কুমিরে কুমিরে যুদ্ধ শুরু করে দিতো।

শুরু হয় আলাপচারিতা আঃ রব সাহেবের সাথে। তিনি ওইল্ড লাইফ ব্রিডিং সেন্টার, করমজল, সুন্দরবন ইষ্ট ডিভিশন, বাগেরহাটে ডেপুটি রেঞ্জার পদে কর্মরত আছেন ২০০০ সাল থেকে। কথিত করমজল পর্যটন কেন্দ্রটি ওইল্ড লাইফ ব্রিডিং সেন্টার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে বন্য প্রানী হাসপাতালও আছে। ১২৫টি ফরেষ্ট অফিসের অধীন জব্দকৃত অসুস্থ বন্য প্রাণীর চিকিৎসা দেওয়া হয় এখানে। কিন্তু নেই পর্যাপ্ত ঔষুধ সরবরাহ। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমির প্রজনন কেন্দ্রে প্রজননক্ষম ২টি কুমির (রোমিও এবং জুলিয়েট) দ্বারা চলছে কুমিরের বংশ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। পৃথিবীর মোট ২৬ প্রজাতীর কুমিরের মধ্যে বাংলাদেশে ৩ প্রজাতীর কুমির ছিল। ২টি প্রজাতী বিলুপ্ত হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে কেবলমাত্র বিলুপ্ত প্রায় ১টি প্রজাতী সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত এই বন্য প্রানী হাসপাতালে ১২৯টি হরিণ, ৫৩টি বানর, ১২টি মেছো বাঘ, ৮টি সাপ ও ৬টি বিভিন্ন প্রজাতীর পাখি চিকিৎসা শেষে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হইয়াছে। সাপ নিয়ে তার গবেষণার ফলাফল আমাদের ধারনাকে পাল্টে দেয়। ৩ প্রজাতির কোবরা সহ ৩০ প্রজাতির সাপ আছে সুন্দরবনে। এ পর্যন্ত সুন্দরবনের কোন সাপ মানুষ দংশন করিয়াছে বলিয়া তাহার জানা নাই। সেই সূত্রে তিনি দাবী করেন সাপ কখনো মানুষের সত্রু নয়, বরং সাপের সত্রু মানুষ। সুন্দরবনের সাপ মানুষকে কখনো প্রতিপক্ষ মনে করে না। তাই সুন্দরবনের সাপ মানুষকে দংশন করে না। গ্রামে গঞ্জে যেসব সাপ মানুষকে প্রতিপক্ষ হিসাবে চিনে সেসব সাপই কেবলমাত্র মানুষকে দংশন করে।

এ পর্যায়ে আমরা আঃ রব সাহেবের সাথে রওনা হই কুমির দেখার জন্য। একটি বড় পুকুরের চারিপার্শ্বে পাড় প্রায় ৩ ফুট উচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। পুকুরের পানির রং দেখে খুব সহজে অনুমান করা যায় পুকুরটির পানির গভীরতা অনেক। সেখানে গিয়ে আঃ রব সাহেব রোমিও, জুলিয়েট, পিলপিল নাম ধরে পানির মধ্যে থাকা কুমিরকে ডাকতে শুরু করলেন। মুহুর্তেই রোমিও এবং পিলপিল নামক দুইটি বড় কুমির পুকুর পাড়ে উঠে আসে। আঃ রব সাহেব জানান জুলিয়েট গর্ভধারন করায় সে এখন পুকুর পাড়ে উঠে না। অবাক দৃষ্টিতে অবলোকন করি কুমিরের মানুষ্য বন্ধু কন্ঠ সনাক্তকরনের বিরল শিক্ষা। নিজের কাছে কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল ঘটনাটা। হয়তো নিজের চোখে না দেখলে এটাকে গল্পই মনে করতাম।

তারপর চলে যাই কুমির প্রজনন কেন্দ্রের কুমির ছানার খামারে। সেখানে বিভিন্ন বয়সের শতাধিক কুমির ছানা আঃ রব সাহেবের কন্ঠ শুনতেই খুব কাছে চলে আসে খাবার খাওয়ার লোভে। আঃ রব সাহেব তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে যেন ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসে অশ্রু শিক্ত নয়নে। কান্না কন্ঠে তিনি জানান কুমিরের এই অনাহারে থাকা তাকে অনেক কষ্ট দেয়। তিনি তাহার সন্তানদের চেয়েও বেশী ভালবাসেন এই কুমির ছানাদের। আক্ষেপ করে বলেন তার সন্তান হয়তো খাবার না জুটলে ভিক্ষে করে খেতে পারবে কিন্তু এই খাচায় ঘেরা বন্য কুমির সেটা পারে না। পাবনার অধিবাসী আঃ রব সাহেব ১ ছেলে ১ মেয়ের জনক। তার সন্তানদের তিনি তেমন সময় দিতে পারেন না। মাঝে মাঝে সন্তানরা এসে তাকে দেখে যায় আর দুঃখ করে বলে “আমরা যদি বাবার সন্তান না হয়ে কুমির ছানা বা বন্য প্রাণী হতাম তাহলে বাবা আমাদেরকে অনেক বেশী আদর করে অনেক সময় দিত”। কথাগুলো বলতেই আঃ রব সাহেবের দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।

এরপর বানর আর হরিনের চিকিৎসা খাচায় নিয়ে যান আমাদেরকে। সেখানেও একই অবস্থা। আঃ রব সাহেবকে দেখে বানরের যত অভিযোগ আর হরিনের মুক্তি পাওয়ার ফরিয়াদ। এমন সময় নৌকায় দেখা পা ভাঙ্গা হরিনটি নিয়ে আসে কয়েকজন বনরক্ষী। আঃ রব সাহেব হরিনটি চিকিৎসার জন্য অস্বীকৃতী জানান। তাহার নিকট পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় তিনি অসহায়ের মত হরিনটি রাখতে নারাজ। তথপি আমাদের আর বনরক্ষীদের অনুরোধে তিনি শুরু করেন স্বল্প পরিসরে চিকিৎসা। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন হরিনটির একটি পা কেঁটে ফেলতে হবে এবং তাহাকে আর কখনো বনে অবমুক্ত করা যাবে না। কেন বনে অবমুক্ত করা যাবে না প্রশ্নের উত্তরে জানালেন হরিনটির পা কেঁটে ফেললে সে আর দৌড়াইতে পারবে না, তখন হরিনটিকে বনের বাঘে খেয়ে ফেলবে। এই হরিনটিকে চিকিৎসা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে আজীবন তার দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া। কথাগুলো বলেই একটা দির্ঘশ্বাস ফেলে বললেন যেখানে দেশের মানুষের জন্য হাজার হাজার হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স সেখানে বন্য প্রাণীর জন্য নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা সম্বলিত হাসপাতাল।

এরপর আমরা একজন বনরক্ষী সাথে নিয়ে প্রবেশ করলাম বন এলাকায়। সুন্দরী, কেওয়া, জারুল, ধুন্দল সহ নাম না জানা অসংখ্য গাছের সমরোহ মাঝে কাঁঠ দিয়ে নির্মিত প্রায় ১ কিঃমিঃ পুলের উপর দিযে হেটে হেটে বনের ভিতর যাওয়ার পর পুল শেষ হয়ে যায়। এরপর পায়ে চলা আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ। পথের দু’পার্শ্বে বড় বড় গাছে বানরের লাফা-লাফি আর ভেংচি কাটা উপভোগ করতে করতে অনেকটা পথ বনের গহীনে চলে এসেছি কথাটা ভুলে গেলে বনরক্ষী স্মরন করিয়ে দিলেন নরম মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখিয়ে। বেশ কিছু পায়ের ছাপ দেখে বাঘের পদচারনা অনুভব করলাম সেখানে। হঠাৎ একটা গর্জন ধ্বনি শুনে ভয়ে গাঁ ছমছম করে ওঠে। বনরক্ষী জানালেন এটা এক ধরনের বন্য পাখীর ডাক। বিভিন্ন রংয়ের পাতায় মোড়ানো বৃক্ষরাজি আর তৃণলতা সোভিত গহীন অরণ্য মাঝে বনরক্ষীদের নির্মিত একটা কাঠের চৌকি (পাহারা দেওয়ার ঘর) পেয়ে ক্লান্ত শরীরে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে বসলাম। গোলাকৃতি ঘরের উপরে গোলপাতার ছাউনি। পাশ দিয়ে ছোট্ট একটি নালা দিয়ে জোয়ারের পানি কুল-কুল শব্দে গড়িয়ে যাচ্ছিল। তখন সবে দুপুর ২টা। বাহারী নাম না জানা পাখির কলরব ছন্দ আর মৃদু শীতল হাওয়ায় ক্লান্ত শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল। বন্ধু হালিম চৌকিতে হেলান দিয়ে নিদ্রাদেবীর নিকট আত্মসমর্পন করে। মোবাইলের কল্যানে রবীন্দ্র সংগীত আর নজরুলগীতী শুনতে ছিলাম আনমোনা হয়ে। সাথে থাকা খাদ্য আর পানীয় জল সুযোগ মত সদব্যবহার হচ্ছিল নিয়মিত তাই পেটে ছিলনা ক্ষুদার তাড়না। ফিরে যাওয়ার কথা প্রায় বেমালুম ভুলতে বসেছিলাম। এমন সময় নৌকার মাঝি রুবেল ফিরে আসার জন্য তাগিদ দিলে বাঁধ সাদলাম আমরা। কারন রুবেলের সংগে আমাদের সারা দিনের জন্য চুক্তি হয়েছে। রুবেলের কথা “স্যার সকলেই সারা দিনের জন্য চুক্তি করে কিন্তু আপনাদের মত কেউ অহেতুক বসে সময় কাটায় না এই জঙ্গলে”। অহেতুক শব্দটায় আমাদের চরম আপত্তি থাকলেও তাকে সময় বেঁধে দেওয়া হলো আর ১ ঘন্টা পরে আমরা রওনা দেবো। এবার অন্য পথে বনের মধ্যে দিয়ে হেটে হেটে পৌছে গেলাম করমজল ফরেষ্ট রেঞ্জের ক্যান্টিনের কাছে। এখানে কাঠের পুলের উপর অনেক দেশী বিদেশী পর্যটকের ভিড় দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখি বন্য হরিণের একটি দল দর্শনার্থীদের হাত থেকে চিপস্ নিযে খাচ্ছে। আমরাও সুযোগ পেয়ে বন্য হরিণের মূখে চিপস্ তুলে দিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে ভ্রমনের শেষ আনন্দের রেশটা সংগে করে ফিরে এলাম অনেক স্মৃতী সাথে নিয়ে।

লেখকঃ ব্লগার অনুলেখা

Leave a Comment
Share