আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী…………(সাজেক)

সেমিস্টার ব্রেকের ছুটি, সেপ্টেম্বরের শেষে এখানে যাব, সেখানে যাব, কে যাবে? কে যাবেনা? এইসব হিসেব মেলাতে, মেলাতে মেজাজ নষ্ট হয়ে গেল। শেষমেশ দুই সহকর্মী মিলে শুরু করলাম অন্য আর এক সহকর্মীর বাড়ি খাগড়াছড়ির দিকে যাত্রা। কারণ থাকাটা তো ফ্রি পাওয়া যাবে, খাওয়া না হয় নিজেরাই করলাম। টিকেট আগেই কাঁটা ছিল, তাই সে নিয়ে তেমন চিন্তা ছিলনা। বাসে উঠেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, কারণ অনেক নোংরা ছিল, ভ্রমনে এটা আমার একটা মানসিক সমস্যা। অর্থ, পথ, দুরত্ত, সময়, শরীর যেমনই হোক, বাহনটা যদি পছন্দ হয় বা পরিচ্ছন্ন হয়, অনেক কিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায় আর সেটা না হলেই মনটা বিস্বাদ ও সাময়িক বিষণ্ণতায় ভরে যায়।

যাইহোক, একসময় ঘুমের শেষে ঘুম ভাঙলো, তখন সবে খাগড়াছড়ির পথ শুরু হয়েছে, সূর্য সবে উঠি- উঠি করছে, রাতের বৃষ্টি আর ভোরের হালকা মেঘে সে তার আগমনের জানান দিতে পারছেনা। তাকিয়েই ছিলাম, কখন মেঘ সরে, গাছের পাতার ফাঁকে দুরে সূর্যের স্বপ্নিল রঙ চোখে পড়ে। কিছুদূর যেতেই, গাছের সারির মাঝে, ছোট্ট টিলাদের পেরিয়ে আর বেহায়া মেঘকে সরিয়ে, সে উঁকি দিল, দেখা দিল, শত রঙের বর্ণিলতা বুকে বেঁধে, এই প্রথম মনটা বেশ প্রফুল্ল হল। মেঘ, লতা-পাতা, আর টিলাদের সাথে সূর্যকে নিয়ে লুকোচুরি খেলাতে, যেন শিশু হলাম খানিকক্ষণের জন্য! শেষ হল সেই রেশ, সূর্যের দীপ্ততায়, দৃষ্টির অপারগতায় আর মনে হল এই প্রথম, নাহ, বোধয় ভালো কিছুই পাবো, ছুটছি সামনের সেই সম্ভাবনায়………….

সেদিন, রিছাং, আলুটিলা গুহা আর খাগড়াছড়ি শহরে ঘুরেই কাটিয়ে দিলাম, রাতে প্ল্যান হল, আগামীকাল ভোঁর, ভোঁর সাজেক দেখে আর কিছু বাগান, ঝর্ণা, পুকুর আর পাহাড় দেখবো, সেভাবেই শুরু করলাম।

পরদিন সকাল… সাজেকের উদ্দেশ্যে সিএনজিতে যাত্রা শুরু, আকাশটা আজ বেশ মেঘলা, মেঘলা, যে কারনে মনেও মেঘের মেলা, দুরের পাহাড় আর আকাশের নীলিমারা দৃষ্টির সাধ্য সীমায় ধরা দেবেনা বলে। দীঘিনালা যেতে, যেতেই প্রকৃতি তার খেয়ালের পরিবর্তন ঘটালো, মেঘগুলো মুছে গেল, আকাশরা নীলে, নীলে নিচে নেমে এলো! যেন, ওই পাহাড়টা ডিঙোলেই ছুঁয়ে দেবে আমি ও আমাকে! বলবে হারাতে তার নীল, নীলিমাতে! ঘাসগুলো সবুজ হল আরও সবুজ! গাছগুলো যেন তার পাতাদের নাচ দিয়ে আমাকে স্বাগত জানাল! দুপাশের বড়, বড় ঘাসের সারি যেন, সারাটা পথ জুড়ে সবুজ গালিচা! পাখিদের উদ্বেগহীন কিচিরমিচির যেন, সম্মোহিত সঙ্গীতের মূর্ছনা! আর কাছে-দুরের ছোট মাঝারি পাহাড় গুলো এক-একটা, এক-একজনের সাথে রেশা-রেশিতে মত্ত, কার কাছে আগে যাব আর কাকে আগে ছোঁব! কার কোলে মাথা দেব! কার আঁচল ছায়ায় শরীর জুড়িয়ে শীতল হব!

আর ওই পথ, যা পাঁচ কিলো দুরেও যেমন! আর তার পরের পাঁচ কিলো দুরেও তেমন, দূর থেকেই দেখা যায়, যতদূর চোখ যায়! যেন গ্রামের মেঠো পথ, যে পথে কোন খাঁদ নেই, ভয়ানক বাঁক নেই, পাহাড়ের খাঁদে পড়ার ভয় নেই, সামনে থেকে অন্য যানবাহন চলে আশার দুশ্চিন্তা নেই, পিছন থেকে ধাক্কা খাবার আশংকা নেই, মেঘ, আকাশ, কুয়াশার আর শিশিরের মত মসৃণ…… একরাশ স্নিগ্ধতা মেখে দেবে, আপনার, সারা শরীর, মন আর মনন জুড়ে……………

ওই যে সাঁজেক! ওই পাহাড়ের চুড়ায়, এখানে একটু দাড়াই? আকাশ এতো নীল কেন? এমন মেঘহীন স্বচ্ছ নীল আকাশ এর আগে কোনোদিনই চোখে পড়েনি! কখনই না, কত ছবি যে তুলেছি, তার হিসেব নেই, শুধুই আকাশের আর আকাশের সাথে নিজের সেলফি! নীল আকাশ, লাল গেঞ্জি, সবুজ প্রকৃতি আর কলো আমি! অদ্ভুত সংমিশ্রণ!

চলেন, এখানে আর কতক্ষণ? “সুন্দর তো সামনে পইরা রইছে!” ড্রাইভারের ডাক, সাথে সহযাত্রীদেরও…

“আমি আর সিএনজি তে যাবনা! তোমরা যাও” এই পথটুকু আমি হেটেই যেতে চাই, এই পথের আর এক বিন্দু সুখও আমি হারাতে চাইনা! আমি হেটে, হেটে, দেখে, দেখে, মন ভরাতে, ভরাতে যেতে চাই, এই নীল-সবুজের সম্মোহন আর অদ্ভুত পথের সবটুকু সুখ আমি শুষে নিতে চাই, সাধ্যের সবটুকু দিয়ে!

এভাবে হেটে-হেটে, গান গেয়ে, সুখে আহ্লাদিত হতে, হতে পৌঁছে গেলাম সেই “স্বপ্নপুরী” সাজেকে! এটা আসলেই “স্বপ্নপুরী” অন্তত আমার কাছে, সাজেকে যেতে, যেতেই শুধু এই নামটাই আমার মনে পড়েছে, এটাই! যদিও অনেক পুরনো একটি নাম, তবুও এই নাম ছাড়া আর কোন নামই আমার মন ভরাতে পারেনি, তাই সেই পুরনো নামই নতুন করে “আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী” সাজেক এর চূড়াতে উঠে এর চেয়ে ভাল আর কোন উপলব্ধি আমার হয়নি, বারবার মনে হয়েছে, আসলেই “আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী”

যখন পা রাখলাম, সাজেকের হৃদয়ে হাহাকার তোলা হেলিপ্যাডে…… এই মেঘে মিশে যাই! তো এই নীলে হারাই! এই সবুজে জড়াই! তো এই হাওয়ায় ভেসে যাই! বুঝতে পারছিলাম না আমি কি করবো? বসে থাকব, না দাড়িয়ে থাকব! চোখ খুলে দেখবো না চোখ বুজে অনুভব করবো! কোথায় দৃষ্টি দেব, সামনে না পিছনে? ডানে না বায়ে! আসলে এটাই তো বুঝতে পারিনি, কোনটা সামনে? কোনটা পিছনে? কোনটা ডান? আর কোনটা বাম; সুখে, আনন্দে, আবিলুপ্ততায় অবরুদ্ধ হলে যা হয় আর কি? বসে, শুয়ে, গড়িয়ে, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, হারিয়ে গয়েছিলাম, উন্মাদ আর উম্মত্ত হয়ে গিয়েছিলাম আবেগে, আকুলতায়, সুখের যন্ত্রণায়…..

আরও কি করতাম কে জানে?
যদি না থাকতো ঘর আর ঘরণী!
ছানা আর ছানার দুষ্টমি!
আমি আর আমার আগামী…..!

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ kahinisajekstorytravelvromon