নিঝুম দ্বীপ (Nijhum Dwip), নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা ছোট্ট একটি ভূ-খণ্ড। বল্লার চর, কামলার চর, চর ওসমান ও চর মুরি এই চারটি প্রধান দ্বীপ ও বেশ কয়েকটি ছোট চরের সমন্বয়ে নিঝুম দ্বীপ, যার আয়তন প্রায় ১৪,০৫০ একর। নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ইছা মাছ (চিংড়ি মাছ) ধরা পড়তো বিধায় জেলেরা এই দ্বীপের নাম দেয় ইছামতির দ্বীপ। এই দ্বীপটিতে মাঝে মাঝে বালির ঢিবি বা টিলার মত ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বা বালুয়ার চর বলেও ডাকতো যা পরবর্তীতে বল্লার চরে রূপান্তরিত হয়। দ্বীপটি সম্পূর্ণ নিরব হওয়ায় এর নামকরণ করা হয় নিঝুম দ্বীপ। দ্বীপের প্রধান সড়ক একটি। দ্বীপের এক পাশে থেকে আরেক পাশে সোজা চলে গেছে। বাজার আছে তিনটি এর মত। নিঝুম দ্বীপের মূল জনবসতির নাম হলো নামা বাজার। নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। নামা বাজার এলাকায় রাত এগারোটা পর্যন্ত জেনাটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ থাকে। দ্বীপের ভেতর যাতায়াতের জন্য রিক্সা এবং মোটর সাইকেল রয়েছে। তবে মোটর সাইকেলই বেশি। অনেক দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়। দ্বীপে ঘুরার জন্য এ মোটর সাইকেল ভাড়া করা যায়। এ ক্ষেত্রে দুটি লাভ। মোটর সাইকেল যে চালাবে, সে গাইডের কাজ ও করবে। মোটর সাইকেল চালাতে পারলে নিজে নিজে চালানো যায়।
আপনি যদি প্রকৃতিপ্রেমী হন, তাহলে তো কথাই নেই। মূল দ্বীপসহ আশপাশের দ্বীপগুলোতে শীতকালে আসে হাজার হাজার অতিথি পাখি। এদের মধ্যে আছে সরালি, লেনজা, জিরিয়া, পিয়ং, চখাচখি, রাঙ্গামুড়ি, ভূতিহাঁসসহ নানারকম হাঁস, রাজহাঁস, কাদাখোঁচা, জিরিয়া, বাটান, গুলিন্দাসহ জলচর নানা পাখি, হরেক রকমের গাংচিল, কাস্তেচরা ইত্যাদি। কদাচিৎ আসে পেলিক্যান। আর বছরজুড়ে সামুদ্রিক ঈগল, শঙ্খচিল, বকসহ নানা স্থানীয় পাখি তো আছেই। দ্বীপের আশপাশের জঙ্গলেই আছে হরিণ, শেয়াল, বন্য শূকর, নানা রকম সাপ ও বানর।
পাখি বা হরিণ দেখতে হলে খুব ভোরে উঠতে হবে। হরিণ মূল দ্বীপেই স্থানীয় গাইডদের সাথে গিয়ে দেখে আসতে পারবেন। নিঝুম দ্বীপে এখন হরিণের সংখ্যা ৪০ হাজাররের মত। তারপরও হরিণ দেখতে হলে বনে ঢুকলে নিঃশব্দে চলাচল করতে হবে। সামান্য হৈ চৈ করলে এখানে হরিণের দেখা মেলা দুস্কর। জঙ্গলে ট্রেকিং এর সময় যথা সম্ভব সবাই হালকা রঙের সুতি পোশাক পড়বেন। বন্য প্রাণীদের দৃষ্টি খুব প্রখর। অতি উজ্জ্বল পোশাকের কারণে দূর থেকেই আপনার আগমন টের পেয়ে যাবে ওরা। হরিণের দল দেখতে বা ছবি তুলতে চৌধুরী খালের শেষ মাথা ভালো, ওই দিকটায় হরিণ বেশি দেখা যায়। নিঝুম দ্বীপের মতো দেশের অন্য কোন বনে এত কাছাকাছি থেকে এত বেশি চিত্রা হরিণ দেখা যায় না।
পাখি দেখতে হলে ট্রলারে করে পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলোতে যেতে হবে, পেরোতে হবে অনেকটা কাদা। কবিরাজের চর ও দমার চর পাখি দেখার জন্য বেশ উত্তম জায়গা। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখি।
আপনি যদি হাতে সময় নিয়ে যান তবে ট্রলার রিজার্ভ নিয়ে ভোলার ঢালচর, চর কুকরি – মুকরি থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
অক্টোবর থেকে এপ্রিল ১৫ তারিখ এখনকার আবহাওয়া অনুযায়ী নিঝুম দ্বীপ ভ্রমনের জন্য সব থেকে ভালো। অন্য সময় বর্ষা থাকে ও ঝড়ের কারনে মেঘনা নদী ও সাগর উত্তাল থাকে।
নৌপথে
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সহজ রুটটি হলো – সদরঘাট থেকে লঞ্চে হাতিয়ার তমরুদি। এ পথে দুটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে। এমভি পানামা-২ ফোন- ০১৯২৪-০০৪৬০৮ এবং এমভি টিপু-৫, ফোন-০১৭১১৩৪৮৮১৩। ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকেল সাড়ে ৫ টায় আর তমরুদি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে দুপুর সাড়ে বরোটায়।
এছাড়া প্রতিদিন ঢাকার সদরঘাট থেকে এম.ভি তাসরিফ-১, তাসরিফ-২ এবং এম.ভি ফারহান-৩, ফারহান-৪ ছেড়ে যায়। তাসরিফ-১ ও তাসরিফ-২ বিকাল ৫:৩০ মি. ও সন্ধ্যা ৬.০০ টায় হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ডেকের ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা প্রতিজন এবং কেবিন ১২০০ টাকা ( সিংগেল) এবং ২২০০ টাকা ( ডাবল) তবে এই ভাড়া মাঝে মাঝে কমে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক।
তমরদ্দি থেকে স্কুটারে বন্দরটিলা ঘাট। যাওয়া যাবে ৩/৪জন। স্কুটার ছাড়া বাস+রিকসা করে বন্দরটিলা ঘাটে যাওয়া যায়। বন্দরটলা ঘাট থেকে ট্রলারে চ্যানেল পার হলেই নিজুম দ্বীপের বন্দরটিলা। চ্যানেল পার হতে সময় লাগবে ১৫ মিনিট। এটা নিঝুম দ্বীপের এক প্রান্ত, আসল গন্তব্য অন্য প্রান্তের নামা বাজার। বন্দরটিলা থেকে নামা বাজার যেতে হবে রিক্সায়।
ঢাকায় ফেরত যাবার লঞ্চ ছাড়ে দুপুর ১২ টায়।
সড়ক পথে
ঢাকার মহাখালী, কমলাপুর ও সায়েদাবাদ থেকে এশিয়া লাইন, এশিয়া ক্লাসিক, একুশে এক্সপ্রেস ও হিমাচল এক্সপ্রেসের বাস যায় নোয়াখালীর সোনাপুর। ভাড়া ৩৫০-৪৫০ টাকা। সেখান থেকে সিএনজিতে চেয়ারম্যান ঘাট। ভাড়া ১০০ টাকা। এরপর ট্রলারে চড়ে যেতে হবে নলচিরা ঘাট। ভাড়া ১৫০ টাকা। সেখান থেকে আবার বাসে জাহাজমারা বাজার। ভাড়া ৭০ টাকা। জাহাজমারা বাজার থেকে মোটরসাইকেলে মুকতারা ঘাট। ভাড়া ৭০ টাকা। মুকতারা ঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকায় নিঝুম দ্বীপ ঘাট। ভাড়া ১০ টাকা। সেখান থেকে আবার মোটরসাইকেলে যেতে হবে নামার বাজার (নিঝুম দ্বীপ)। ভাড়া ৬০ টাকা। তবে সময়ের বিবর্তনে ভাড়ার ক্ষেত্রে তারতম্য হতে পারে। তাই যাতায়াতের শুরুতেই পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ভাড়া জেনে নিয়ে বাহনে চড়বেন।
এছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অনেকগুলো চেয়ারকোচ সরাসরি নোয়াখালীতে যাতাযাত করে। চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টায় এগুলো সরাসরি মাইজদী সোনাপুর এসে পৌঁছে ভাড়া ২৫০ টাকা মত।
ট্রেনে
সকাল সাতটায় কমলাপুর থেকে ছাড়ে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন।
ট্রেনের সময়সূচি এখানে দেখে নিন
(Bangladesh Railway/Train Time Schedule)
নোয়াখালী সোনাপুর পৌঁছে সেখান থেকে যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাট। বাস, টেম্পু বা বেবীতে সরাসরি ৪০ কিঃমিঃ দক্ষিণে সুধারামের শেষ প্রান্তে চর মজিদ স্টিমার ঘাট। তার পরেই হাতিয়া যাবার চেয়ারম্যান ঘাট। সোনাপুর থেকে একটি বেবী রিজার্ভ নিলে ৩০০-৪০০ টাকায় যাওয়া যায়। টেম্পো, বাসে জনপ্রতি ভাড়া আরো কম। চর মজিদ ঘাট থেকে ট্রলার কিংবা সী-ট্রাকে করে হাতিয়া চ্যানেল পার হয়ে যেতে হবে হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে। সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। নলচিরা বাজার থেকে যেতে হবে হাতিয়ার দক্ষিণে জাহাজমারা। সময় নেবে আধা ঘন্টা। জাহাজমারা থেকে ট্রলারে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ। সময় নেবে ৪০-৫০মিনিট। তবে দলবেঁধে গেলে ট্রলার রিজার্ভ করে সরাসরি চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। ঘাট থেকে নদীপথে হাতিয়া অথবা নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে জোয়ারের জন্য।
চট্টগ্রাম থেকে বাধন পরিবহনে নোয়াখালীর সোনাপুর যেতে হবে। ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা। সোনাপুর থেকে সি এন জি নিয়ে যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাট। এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ১০০ টাকা। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ট্রলারে করে যেতে হবে হাতিয়া। এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ১২০ টাকা। হাতিয়া পৌঁছে ট্রলার ঘাট থেকে ১৫০ টাকা জনপ্রতি দিয়ে বাইক নিয়ে চলে যাবেন মোক্তারিয়া ঘাট। মোক্তারিয়া ঘাট থেকে ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা ঘাটে যেতে হবে, ভাড়া ৩০ টাকা। বন্দর টিলা থেকে আবার মোটর বাইকে করে নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার যাবেন, ভাড়া ৫০ টাকা।
এছাড়া যারা নৌপথে যেতে চান – চট্টগ্রাম সদরঘাট থেকে হাতিয়ার জাহাজ আছে। সময়টা একটু বেশি লাগলেও যাত্রাটা বেশ রোমাঞ্চকর। সকাল ৮টায় হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, ভাড়া ২০০ টাকা। হাতিয়া নেমে মক্তারিয়া ঘাটে চলে যাবেন। খেয়া পার হলেই নিঝুম দ্বীপ।
নিঝুম দ্বীপে থাকার জন্য একমাত্র ভালো মানের জায়গা হলো অবকাশ পর্যটনের নিঝুম রির্সোট (Nijhum Resort)। এখানে ২ বেডের রুম ভাড়া ২০০০ টাকা, ৩ বেডের রুম ১৮০০ টাকা, ৪ বেডের রুম ২০০০ টাকা, ৫ বেডের ফ্যামিলি রুমের ৩০০০ টাকা, ৫ বেডের ডরমিটরির ভাড়া ১৮০০ টাকা ও ১২ বেডের ডরমিটরি ৩০০০ টাকা। ঢাকা থেকে নিঝুম রিসোর্টের বুকিং দেয়া যায়। ডরমিটরিতে অতিরিক্ত কেউ থাকলে জনপ্রতি গুনতে হবে ২০০ টাকা। সবগুলো রুমে এটাচ বাথরুম আছে। জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ পাবেন সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০.৩০ পর্যন্ত। এছাড়া সারা রাত লাইট ইউজ করতে পারবেন সোলার প্যানেল থেকে। এছাড়া সারাদিন ১-২ ঘন্টা পর পর ৩০ মিনিট এর জন্য বিদ্যুৎ পাবেন। অফ সিজনে রুম ভাড়ায় ৫০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় (১৫ এপ্রিল ১৫ – ৩০ সেপ্টেম্বর)
নিঝুম রিসোর্ট এর ঢাকায় যোগাযোগঃ অবকাশ পর্যটন লিমিটেড, শামসুদ্দিন ম্যানশন, ১০ম তলা, ১৭ নিউ ইস্কাটন, ঢাকা। ফোন- ৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ৯৩৫৯২৩০, ০১৫৫২৩৭২২৬৯।
নিঝুম দ্বীপে নিঝুম রিসোর্টে যোগাযোগঃ সবুজ ভাইঃ ০১৭২৪-১৪৫৮৬৪, ০১৮৪৫৫৫৮৮৯৯, ০১৭৩৮২৩০৬৫৫
এখানকার স্থানীয় বাজারে খুব সস্তায় অল্প দামে চার পাঁচটি আবাসিক বোডিং আছে। তাছাড়া বন বিভাগের একটি চমৎকার বাংলো আছে। পাশেই আছে জেলা প্রশাসকের ডাক বাংলো। এগুলোতে আগে ভাগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। তাছাড়া রেড-ক্রিসেন্ট ইউনিট ও সাইক্লোন সেন্টারেও থাকার ব্যবস্থা করা যায়।
নিঝুম রিসোর্টে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। নামার বাজারে তেমন ভালো কোন খাবার হোটেল নেই। যেগুলো আছে সেগুলোতে খেতে পারেন, তবে আগেই কথা বলে নেবেন। এতে তাজা খাবার পাওয়া যাবে। বিভিন্ন ধরনের মাছ দিয়ে খেলেও ৫০-৬০ টাকার বেশি খরচ হবে না।
লোকাল কিছু খাবারের হোটেল আছে। যেমন- হোটেল সি-বার্ড, দ্বীপ হোটেল এবং ভাই-ভাই হোটেল। এখানে আপনি মাছ, মুরগি,হাস, কাকড়া, শুটকি খেতে পারবেন। তবে ভালো মিষ্টি জাতীয় খাবার পাবেন না।
এছাড়া নিজেরাও বাজার করে রান্না করে খেতে পারেন। নিঝুম দ্বীপ থেকে ফেরার পথে এখানকার বিখ্যাত শুঁটকি কিনে নিতে পারেন।
নিঝুম দ্বীপ এ ক্যাম্পিং (Camping) এর সুবিধা প্রচুর। পুরো দ্বীপে আপনার পছন্দের জায়গায় তাঁবু টানাতে পারবেন। জন্তু জানোয়ারের তেমন কোনো ভয় নাই, শুধু বুনো মহিষ থেকে সাবধান। ক্যাম্পিং এর জন্যে সবচেয়ে ভালো যায়গা হলো নামার বাজারে নিঝুম রিসোর্ট এর পাশের খাল পার হয়ে সাগর পাড়ের বিশাল (৫/৬ মাইল) খোলা মাঠটি। ক্যাম্পিং এর মোটামুটি সব কিছুই এখানে পাওয়া যাবে। তেমন কিছুই নেয়া লাগবে না। এরপরও যদি কিছু লাগে তাহলে জাহাজমারা বাজারে পাওয়া যাবে।
এছাড়াও নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান এলাকায় ক্যাম্পিং এর জন্যে তাবু ভাড়া পাওয়া যায়। এছাড়া ঘোরার জন্যে ফাইবার বোটও ভাড়া পাওয়া যায় যার ধারন ক্ষমতা ৪০ জন।
যোগাযোগঃ
নিঝুম দ্বীপ এ শুধুমাত্র রবি এবং গ্রামীনফোন এর নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
Leave a Comment