মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে বীরদের নাম। ত্যাগ, আত্মত্যাগ আর অদম্য সাহসিকতার গল্প আমাদের অনুপ্রাণিত করে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এমনই এক বীর, যার নাম বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান। মাত্র আঠারো বছর বয়সে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন দান করে তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের গর্ব, আমাদের অনুপ্রেরণা। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই চা বাগানে অবস্থিত তার স্মৃতিসৌধ (Bir Shrestho Hamidur Rahman Monument) শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি এক বীরের অমর কাহিনীর প্রতীক, দেশপ্রেমের এক অনুপ্রেরণার উৎস।
১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হামিদুর রহমান। ছোটবেলা থেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হামিদুর ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ‘৭১ এর মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর আক্রমণের মুখে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন এবং সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৪ নম্বর সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেন অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে সিলেটের কমলগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করার সময় ধলই বিওপিতে পাকিস্তানি ঘাঁটি দখলের অভিযানে অংশ নেওয়ার নির্দেশ পান হামিদুর রহমান। ২৮ অক্টোবর সকালে একটি মেশিনগান নিয়ে জীবন বাজি রেখে একাই দুটি পাকিস্তানি যুদ্ধ ট্যাংক ধ্বংস করেন এই কিশোর বীর। শত্রুঘাঁটির অধিনায়ক সহ বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয় তার হাতে। কিন্তু এই যুদ্ধেই শত্রুদের পাল্টা আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন হামিদুর রহমান। তার আত্মত্যাগের কয়েকদিনের মধ্যেই ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের অধীনে চলে আসে। সহযোদ্ধারা তার মরদেহ সীমান্তের ওপারে ভারতের আমবাসা গ্রামের একটি মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করেন।
হামিদুর রহমানের অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তার স্মৃতি রক্ষার্থে ধলই চা বাগানে একটি স্মৃতিসৌধ, জাদুঘর ও আর্কাইভ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের একদিকে বিজিবি ক্যাম্প, অন্যদিকে চা বাগান, আর দক্ষিণে ভারত সীমান্ত। জাদুঘরে রয়েছে তার ছোটবেলার ছবি, পারিবারিক তথ্য ও ছবি সহ বিভিন্ন স্মারক।
ঢাকা থেকে সরাসরি বাস বা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল এসে সেখান থেকে স্থানীয় পরিবহনে কমলগঞ্জ এবং পরে ধলই চা বাগানে যেতে হবে। ভানুগাছ রেলস্টেশন থেকেও স্থানীয় পরিবহনে স্মৃতিসৌধে যাওয়া যায়।
শ্রীমঙ্গল শহর থেকেে সিএনজি যোগে যেতে পারেন। যদি হাতে সময় কম থাকে তাহলে লাউয়াছড়া বন, মাধবপুর লেক আর ধলই সীমান্ত একদিনের একটা রুট বানিয়ে নিতে পারেন। লাউয়াছড়া বন দেখে ভানুগাছ বাজার হয়ে মাধবপুর লেক দর্শন করে ঐ রাস্তাতেই ধলই সীমান্ত। তবে ধলই চা বাগানের মধ্যদিয়ে ২/৩ কিলোমিটার রাস্তা কিছুটা খারাপ কিন্তু রাস্তার দুই পাশের চা বাগানের সৌন্দর্য্য আপানাকে এই খারাপ লাগা অনুভব করতে দেবে না। পারিপার্শ্বিক সুন্দর পরিবেশে বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়ালে গর্বে বুকটা ভরে যাবে।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক অনন্য নাম। তার স্মৃতিসৌধ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা কোনো সহজ প্রাপ্তি নয়। এর জন্য রক্ত ঝরাতে হয়, প্রাণ দিতে হয়। আমাদের উচিত বীরদের স্মৃতি চির স্মরণীয় করে রাখা এবং তাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সেবা করা।
Leave a Comment