শ্রীমঙ্গল

রাবার বাগান

সিলেটে বিভাগের অধীনে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, বাংলাদেশের চা-বাগানের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সবুজের এই নগরী শুধু চায়ের জন্যই বিখ্যাত নয়, এখানে রয়েছে বিস্তীর্ণ রাবার বাগানের (Rubber Garden) সমারোহ। হাজার হাজার রাবার গাছের সারি, সবুজ পাতার ছায়ায় ঢাকা মাটি, আর রাবার শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা মিলিয়ে শ্রীমঙ্গলের রাবার বাগানগুলো এক অনন্য সৌন্দর্যের আধার।

শ্রীমঙ্গলে রাবার চাষের ইতিহাস বেশ পুরনো। বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বশিউক) সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় শ্রীমঙ্গলেই অবস্থিত। এই কার্যালয়ের অধীনে রয়েছে চারটি সরকারি রাবার বাগান: হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে শাহজী বাজার রাবার বাগান, বাহুবলে রুপাইছড়া রাবার বাগান, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সাতগাঁও রাবার বাগান এবং কুলাউড়ায় ভাটরার রাবার বাগান। এই চারটি বাগান মিলিয়ে প্রায় ৮,০৮৩ একর জমিতে রাবার চাষ করা হয়। এছাড়াও জেমস ফিনলে টি কোম্পানী, ডানকান ব্রাদার্স সহ প্রায় প্রতিটি বেসরকারি চা-বাগানেই এখন রাবার চাষ করা হচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন অসংখ্য রাবার বাগানও রয়েছে শ্রীমঙ্গলে।

বশিউকের চারটি বাগানে মোট ৮,০১,৪২০ টি রাবার গাছ রয়েছে, যার মধ্যে ৬,৬৫,৮০৯ টি উচ্চফলনশীল এবং ১,৩৫,৬১১ টি কম উৎপাদনশীল। এই বাগানগুলোতে প্রায় ১,১২৭ জন শ্রমিক কাজ করেন। তারা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত: সরকারি শ্রমিক, উৎপাদনভিত্তিক শ্রমিক এবং ঠিকা শ্রমিক। সরকারি শ্রমিকরা মাসিক বেতনে কাজ করেন, উৎপাদনভিত্তিক শ্রমিকরা প্রতি কেজি কষ সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট টাকা পান, আর ঠিকা শ্রমিকরা ঠিকা প্রথায় কাজ করেন।

রাবার গাছ কেন উপকারী

শ্রীমঙ্গলের রাবার বাগানগুলো শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পরিবেশগত দিক থেকেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। রাবার গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। এছাড়াও রাবার বাগান বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর আবাসস্থল।

কোথায় পাবেন রাবার বাগান

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত জেমস ফিনলে টি কোম্পানির রাবার বাগানগুলি প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি। সুউচ্চ রাবার গাছের সারি সারি সজ্জা, যেন স্কেল দিয়ে মেপে একই সমান্তরালে লাগানো যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। কোথাও রাবার বাগানের এক পাশে, কোথাও দুই পাশে চা বাগানের সবুজ সমারোহ, মাঝখান দিয়ে বিস্তৃত সুবিশাল পথ – এই মনোরম দৃশ্য মনকে আপ্লুত করে। লাউয়াছড়া যাওয়ার পথে এক পাশে রাবার গাছের সারি আর অন্য পাশে চা বাগানের বিস্তৃতি এক অনন্য সৌন্দর্য তৈরি করে। কালিঘাট রোডের ফুলছড়া বাগানে যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারেই হাজার হাজার রাবার গাছের সারি দেখে মুগ্ধ হতে হয়।

শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়কের ভৈরববাজারে অবস্থিত মাইজডিহী রাবার বাগান একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। রাস্তার কাছেই অবস্থিত এই বাগানের সৌন্দর্য যেকোনো পথিকের নজর কাড়বে। হাজার হাজার রাবার গাছের সারি, ঘন সবুজ পাতায় ঢাকা মাটি, আর মাঝে মাঝে সূর্যের আলোর ঝলকানি মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি করে।

এই রাবার বাগানের সৌন্দর্য ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যায়। শীতকালে গাছের পাতা ঝরে পড়ে বাগান যেন নির্জীব হয়ে পড়ে। আবার বর্ষার আগমনে নতুন পাতায় সেজে ওঠে, ফিরে পায় তার যৌবন। এই প্রকৃতির রূপান্তর দেখার জন্য প্রতি বছর অনেক দর্শনার্থী শ্রীমঙ্গল ঘুরে যান। রাবার বাগানের এই বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য একে প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

রাবার বাগান ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

রাবার বাগান ঘুরে দেখার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো খুব সকাল। এ সময় রাবার শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা দেখতে পাওয়া যায়। তারা কিভাবে গাছ থেকে রাবারের কষ সংগ্রহ করেন, কিভাবে তা প্রক্রিয়াজাত করে রাবার তৈরি করেন, তা প্রত্যক্ষ করে অনেক কিছু জানা যায়। রাবার শ্রমিকদের জীবন যাপন প্রণালী ও তাদের দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা জানার ও একটা সুযোগ মেলে।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাবার গাছ থেকে বীজ পড়ার একটা অন্যরকম সৌন্দর্য রয়েছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়ালে রাবার বীজের রিমঝিম শব্দ কানে আসবে। এই শব্দ শুনতে শুনতে মনে হবে যেন প্রকৃতি আপনার সাথে কথা বলছে।

রাবার তৈরির গল্প: প্রকৃতি থেকে কারখানায়

সবুজের সমারোহে ঢাকা রাবার বাগানের ভেতরেই থাকে সুবিশাল কারখানা, যেখানে দুধের মতো সাদা কাঁচা রাবার থেকে তৈরি হয় টেকসই রাবার শিট। এই রূপান্তরের গল্পটা বেশ মজার, প্রকৃতি ও মানুষের কর্মযোগের এক অনন্য মিশেল।

সেই ভোর থেকেই শুরু হয় রাবার শ্রমিকদের কর্মব্যস্ত দিন। তারা গাছ থেকে কাঁচা রাবারের কষ সংগ্রহ করেন। ধারালো ছুরি দিয়ে গাছের কাণ্ডে অতি যত্ন সহকারে কাটা ছেঁড়া হয় এবং কষ সংগ্রহ করার জন্য ছোট পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। দুধের মতো সাদা এই কষ ধীরে ধীরে পাত্রে জমা হয়। সংগৃহীত কাঁচা রাবার তারপর বড় বড় হাউসে জমা করা হয়।

কারখানায় নেওয়ার পর শুরু হয় রাবার প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রধান পর্ব। প্রথমে কাঁচা রাবার পাতলা করে বিশাল ট্যাঙ্কে ঢালা হয়। এরপর এতে ফর্মিক এসিড যোগ করে জমাট বাঁধানো হয়। জমাট বাঁধা রাবার রোলার মেশিনের মাধ্যমে চাপ দিয়ে পাতলা শিটে পরিণত করা হয়। এই রাবার শিটগুলো তারপর বিভিন্ন আকারে কাটা হয়।

কাটা রাবার শিটগুলো শুকানোর জন্য বিশেষ চেম্বারে রেখে দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত শুকানোর পর শিটগুলোকে আগুনে তাপ দেওয়া হয়। এই তাপ দেওয়ার ফলে রাবার শিট লালচে বাদামি রঙ ধারণ করে এবং আরও টেকসই হয়ে ওঠে। এভাবেই তৈরি হয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত রাবার শিট।

রাবার তৈরির এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি প্রকৃতি ও মানুষের মিশ্র কর্মযোগের এক অনন্য উদাহরণ। শ্রীমঙ্গলের রাবার বাগান এবং কারখানা ঘুরে দেখলে এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায় এবং প্রকৃতির কাছাকাছি চমৎকার কিছু সময় কাটানো যায়।

রাবার বাগান যাওয়ার উপায়

শ্রীমঙ্গলে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি বাস বা ট্রেন পাওয়া যায়। শ্রীমঙ্গল পৌঁছে সিএনজি, অটোরিকশা বা স্থানীয় বাস যোগে বিভিন্ন রাবার বাগানে যাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে বাগানের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য নিতে পারেন।

কিছু টিপস

পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন। আরামদায়ক জুতা পরিধান করুন এবং সাথে পানি ও ছাতা রাখুন। স্থানীয় লোকজনের সাথে সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার করুন।

শ্রীমঙ্গলে আসলে রাবার বাগান ঘুরে দেখা অবশ্যই উচিত। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রাবার শ্রমিকদের জীবন যাপন প্রণালী, রাবার তৈরির প্রক্রিয়া – সব মিলিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হবে। এই অভিজ্ঞতা আপনার মনে দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Leave a Comment
Share