সবুজের সমারোহে ঘেরা, চা পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা এক টুকরো স্বর্গ – ক্যামেলিয়া লেক (Camelia Lake) যা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর চা বাগানের বুকে অবস্থিত। এই ক্যামেলিয়া লেকটি স্থানীয়দের কাছে “বিসলার বান” নামেও পরিচিত। চারদিকে উঁচু-নিচু টিলা, সবুজ চায়ের সমারোহ, মাথার উপরে নীল আকাশ আর তার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠা লেকের টলটলে পানি – সব মিলিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
ক্যামেলিয়া লেকের অবস্থান ব্রিটিশ কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন শমশেরনগর চা বাগানে। প্রায় ৪৩২৬.৪৭ একর জুড়ে বিস্তৃত এই চা বাগানের মাঝখানে অবস্থিত এই লেকটি যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি। চা বাগানগুলোতে সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে চা গাছে পানি সেচের জন্য ছোট-বড় লেক তৈরি করা হয়। ক্যামেলিয়া লেকও তেমনি একটি লেক। তবে এর সৌন্দর্য অন্যান্য লেকের থেকে অনেকটাই আলাদা।
লেকের চারপাশে ছড়িয়ে আছে সবুজ চা গাছের সমারোহ। উঁচু-নিচু টিলায় সারি সারি চা গাছ যেন সবুজের এক অসাধারণ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। মাথার উপরে নীল আকাশ, আর তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে লেকের টলটলে পানিতে। আকাশের সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, আর সেই মেঘের প্রতিচ্ছবিও দেখা যায় লেকের পানিতে। লেকের পানিতে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে অতিথি পাখির দল। সব মিলিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
লেকের দুই পাশে রয়েছে ঘন জঙ্গল। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় ভরপুর এই জঙ্গল লেকের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। লেকের পানিতে মাছের খেলা দেখা যায়। লেকের পাশে বসে পাখির কলকাকলি শুনতে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে এক শান্ত ও নির্মল পরিবেশ। লেকের দুই পাশে রয়েছে অনেক গাছপালা। লেকের পানির ওপর একটি পাকা পাটাতন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
ক্যামেলিয়া লেকের নামকরণ করা হয়েছে ডানকান ব্রাদার্সের মূল কোম্পানি ক্যামেলিয়া পিএলসির নামানুসারে। এই কোম্পানির ১৫টি চা বাগানের শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারের সদস্য, কর্মচারী ও ব্যবস্থাপকদের চিকিৎসাসেবা দানের জন্য ১৯৯৪ সালে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। এই হাসপাতালটিও ক্যামেলিয়া লেকের কাছেই অবস্থিত।
ক্যামেলিয়া লেকে যাওয়ার পথটিও বেশ মনোরম। শমশেরনগর-চাতলাপুর চেকপোস্ট সড়ক ধরে দক্ষিণে তিন কিলোমিটার সামনে গেলেই পাওয়া যায় ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতাল। হাসপাতালটিকে পেছনে রেখে আরও দুই কিলোমিটার চায়ের গালিচার মধ্য দিয়ে মাটির রাস্তা ধরে এগোলেই চোখে পড়ে অপরূপ ক্যামেলিয়া লেকটি। পথে দেখা মিলবে সবুজ চা বাগান, উঁচু-নিচু টিলা, আর গাছে গাছে ঝুলন্ত বানরের দল।
ক্যামেলিয়া লেক থেকে ফেরার পথে দেখা মিলবে শমশেরনগরের মনোমুগ্ধকর গলফ মাঠের। এখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন পর্যটক-ভ্রমণপিপাসুরা। সেখানে বসে সঙ্গে আনা খাবার খেতে আনন্দ যেন দ্বিগুণ বাড়ে।
ক্যামেলিয়া লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চা বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। তবে শমশেরনগর চা বাগান কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, সাধারণত লেক ও গলফ মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে সহজে কাউকে, বিশেষ করে বড় দলকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তবে আগাম যোগাযোগ করে কিছু শর্তাবলি মেনে আসলে ছোট ছোট দলকে ক্যামেলিয়া লেকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেনে মৌলভীবাজার জেলা সদর, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ ও শমশেরনগর আসা যায়। এরপর শমশেরনগর বাজার থেকে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার বা মাইক্রো নিয়ে সহজেই ক্যামেলিয়া লেকে যাওয়া যায়। লেক পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য অটোরিকশা বা সিএনজি রিজার্ভ করা সবচেয়ে সহজ এবং সুবিধাজনক মাধ্যম। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি বা বাইক নিয়ে সরাসরি লেক পর্যন্ত যাওয়া যায়। রাস্তাটি চা বাগানের ভেতর দিয়ে যাওয়ায় যাত্রাপথও বেশ মনোরম।
ক্যামেলিয়া লেক প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক অপূর্ব গন্তব্য। সবুজের সমারোহে ঘেরা, চা পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা এই লেকটি আপনাকে মুগ্ধ করবে তার অপার্থিব সৌন্দর্যে। একবার গেলে মনে হবে বারবার ফিরে আসতে।
Leave a Comment