নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলা থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, দুলালপুর ইউনিয়নে অবস্থিত প্রায় ৫৫০ বিঘা আয়তনের বিশাল জলরাশি, যার নাম চিনাদী বিল (Chinadi Beel)। এই বিল শুধুই একটা জলাশয় নয়, এ যেন প্রকৃতির এক অপার ক্যানভাস, যেখানে নীল আকাশ, সবুজ ধানক্ষেত, আর স্বচ্ছ জলের মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয়েছে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। মানিকদী, শিমুলিয়া, দুলালপুর, ভিটি চিনাদী ও দরগাহবন্দ – এই পাঁচ গ্রামের মিলনস্থলে অবস্থিত এই বিল, প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক অভয়ারণ্য।
চিনাদী বিলের উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস অজানা। তবে কথিত আছে যে, একসময় ময়মনসিংহের এক জমিদার এই বিলের মালিক ছিলেন। জমিদার আয়েশা আক্তার বিলের তীরে একটি ঘাট নির্মাণ করেছিলেন, যা “আয়শার ঘাট” নামে পরিচিত ছিল। পরে চিনাদী গ্রামের ৩০ জন জেলে ৫০০ টাকায় এই বিল কিনে নেয়। ১৮৩ একর ৮০ শতাংশ আয়তনের এই বিল ১৮৬৫ সালে জমিদার আয়েশা আক্তারের হাত থেকে বিক্রি হয়ে যায়। স্থানীয়ভাবে “চিনাদী বিল” নামে পরিচিত এই বিলের নাম ২০১৬ সালে নরসিংদীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান “স্বপ্নচিনাদী” রেখেছিলেন।
চিনাদী বিল, যেন এক বিশাল পদ্মের রাজ্য। দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত এই বিলে শুভ্র ও গোলাপি পদ্মফুলের মিশেলে সৃষ্টি হয়েছে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। ঢেউয়ের তালে তালে দোল খাওয়া এই পদ্মফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমান প্রকৃতিপ্রেমীরা। কেউ বিলের ধারে বসে, কেউ আবার নৌকায় চড়ে অন্বেষণ করে এই পদ্ম রাজ্যের প্রতিটি কোণ। বর্ষাকালে বিল জুড়ে পদ্মফুলের প্রস্ফুটনে এ জলাশয় পরিণত হয় এক নববধূর মতো। এই সৌন্দর্যের মাঝে আরও রয়েছে চিল, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, বালিহাঁস সহ নানা জাতের পাখির কলতান, যা পুরো এলাকাকে মুখরিত করে তোলে।
চিনাদী বিলের স্বচ্ছ জলে ভাসমান কচুরিপানা, শাপলা, শালুক, পদ্মপাতা, শিংরা – এসব জলজ উদ্ভিদের সমারোহ আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই জলজ বনের ফাঁকফোকর দিয়ে মাছেরা খেলা করে বেড়ায়, যা দেখলে মন ভরে যায়। বিলের চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত, সরিষা ক্ষেতের হলুদ রঙের ছটা, আর নীল আকাশের মিতালী আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্যলোকে।
শীতকালে চিনাদী বিল পরিণত হয় অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্যে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির আগমনে বিল মুখরিত হয়ে ওঠে। জেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে পাখিরা মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বক, চিল, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, বালিহাঁস সহ অসংখ্য পাখির কলকাকলি আর আকাশে ওড়াউড়ি আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই সময় বিলের সৌন্দর্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমান পর্যটকরা। ঈদ বা অন্যান্য উৎসবেও এখানে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। এই বিল শুধু সৌন্দর্যের আধার নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কেন্দ্র ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিলের চারপাশের সবুজ শস্যক্ষেত ও নীল আকাশ এই সৌন্দর্যকে আরও বর্ধিত করে। নৌকা ভ্রমণ বা পায়ে হেঁটে বিলের তীর ঘেঁষে এই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
বিলের চারপাশে জেলেপাড়া, যেখানকার মানুষ বিল থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এই জেলে পরিবারের সাধারণ জীবনযাপন, তাদের ঘরবাড়ি, আবহমান বাংলার এক প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।
চিনাদী বিলে নৌকা দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা অনন্য। বিলের দু-ধারের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জলের উপর নৌকার টলমল করা অনুভূতি, আর পাখিদের কলরব – সব মিলিয়ে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বিলের তীরে হেঁটে বেড়ানোর মজাও কম নয়। সন্ধ্যায় গোধূলির রক্তিম আভা যখন বিলের জলে পড়ে, তখন সৃষ্টি হয় এক মোহময় পরিবেশ। এই বিলে ঘুরাঘুরির জন্য ঘাটে রয়েছে নৌকা। নৌকা ব্যবহারে প্রতি ঘন্টায় গুণতে হবে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
চিনাদী বিলের মাছের খ্যাতি দূর-দূরান্তে। এখানকার জেলেরা ধরা তাজা দেশীয় প্রজাতির মাছ কিনতে অনেকেই এখানে আসেন। ঢাকা শহর থেকেও অনেকে এই বিলের মাছ কিনতে আসেন।
ঢাকা থেকে নরসিংদীর দূরত্ব মাত্র ৫৪ কিলোমিটার। গুলিস্তান, সায়দাবাদ ও আব্দুল্লাহপুর থেকে নরসিংদীর বাস পাওয়া যায়। বিভিন্ন পরিবহন ৫ মিনিট পর পর নরসিংদীর বাস ছাড়ে। যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। ট্রেনেও নরসিংদী যেতে পারবেন। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে নরসিংদী যেতে ট্রেনে সময় লাগে ১ ঘণ্টার মতো।
নরসিংদী থেকে শিবপুর যাওয়ার জন্য বাস বা সিএনজি পাওয়া যায়। শিবপুর থেকে চিনাদী বিল যাওয়ার জন্য সিএনজি বা রিকশা ভাড়া করতে পারেন।
কিছু টিপস
চিনাদী বিল শুধু একটি বিল নয়, এটি প্রকৃতির এক অনুপম উপহার। এখানে এসে আপনি প্রকৃতির কোলে কিছুটা সময় কাটিয়ে মানসিক শান্তি পাবেন। তাই যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল থেকে বিরতি নিয়ে একবার ঘুরে আসুন নরসিংদীর এই মনোরম চিনাদী বিলে।
Leave a Comment