মৌলভীবাজার

পাখিবাড়ি

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরপারের হাল্লা পাখিবাড়ি (Pakhibari) দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত। বারো মাস ধরে এ বাড়িতে পাখিরা ঘর বেঁধে বসবাস করছে। এই পাখিবাড়ির অবস্থান বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরের হাল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাগোয়া। এক সময় এই বাড়িটি মনোহর আলী মাস্টারের বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু বিগত প্রায় ৪০ বছর ধরে দেশি-বিদেশি পাখির দখলে যাওয়ায় বাড়ির প্রকৃত মালিকের নাম চাপা পড়ে গেছে। এখন এটি ‘পাখিবাড়ি’ নামেই পরিচিত।

শীত, বর্ষা কিংবা গ্রীষ্ম—পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হাল্লা পাখিবাড়ি

শীত, বর্ষা কিংবা গ্রীষ্ম—বছরের প্রতিটি ঋতুতেই পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরের পাশে অবস্থিত এই অনন্য পাখিবাড়ি। তবে শীত মৌসুমে এ বাড়িতে পাখির সমাগম আরও বেড়ে যায়। প্রায় দুই একর আয়তনের এই বাড়ির চারপাশে রয়েছে নানা জাতের গাছ, যা দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির পাখির আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। পাখিদের কলতান, ওড়াউড়ি আর এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান এই পাখিবাড়িতে। বিশেষ করে ছুটির দিনে এখানে মানুষের ভিড় একটু বেশি থাকে।

পাখিবাড়ির ইতিহাস: মনোহর আলী মাস্টারের বাড়ি থেকে পাখিদের অভয়াশ্রম

প্রায় ২২ বছর আগে হাকালুকি হাওরপারের হাল্লা গ্রামের মনোহর আলী মাস্টারের বাড়িতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এসে আশ্রয় নিতে শুরু করে। বাড়ির গাছপালায় পাখিরা বসত শুরু করে। শুরুতে পাখির বিষ্ঠার গন্ধে বাড়ির লোকজন বিরক্ত হলেও ধীরে ধীরে পাখির সব আচরণই সহনীয় হয়ে ওঠে। পাখির কারণে বাড়ির ফলফলাদিসহ বিভিন্ন গাছপালার ক্ষতি হয়েছে, গাছ মরে গেছে, বাড়ির টিনের চাল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু বাড়ির মানুষ সবই মেনে নিয়েছেন। এখন পানকৌড়ি, সাদা বক, ঘুঘু, শালিক, বুলবুলি এ বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা এসে ভিড় করে। পাখি সংরক্ষণের জন্য পাখিবাড়ি জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছে।

শীত মৌসুমে অতিথি পাখির সমাগম

প্রতি বছর শীত মৌসুমে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে অতিথি পাখির দল। তখন হাওরের পাশাপাশি হাল্লা গ্রামের মনোহর আলী মাস্টারের বাড়িও অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। তবে শুধু শীত মৌসুমেই নয়, বছর জুড়েই পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে বাড়িটি। অবাক করার মতো বিষয় হলো, মনোহর আলী মাস্টারের বাড়ি ছাড়া অন্য কোনো বাড়ির গাছে একটিও পাখি বসে না।

পাখিদের অবাধ বিচরণ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

সারাদিন হাওরের বিভিন্ন বিলে খাবার শেষে সন্ধ্যার দিকে নিশিবক, সাদাবক, লালবক, হাঁস, পানকৌড়ি, জলকুড়া, সরালি, কুদালীসহ নানা প্রজাতির হাজার হাজার পাখি আকাশের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে বসলো মনোহর আলী মাস্টারের বাড়ির হিজল, করস ও জারুলসহ বিভিন্ন গাছে। পাখিদের এই অবাধ বিচরণ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ভিড় জমান।

পাখিবাড়ি: প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য অপার বিস্ময়

পাখিবাড়ি শুধু পাখিদের আবাসস্থলই নয়, এটি প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য এক অপার বিস্ময়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পাখিদের অবাধ বিচরণ দেখতে আসা প্রতিটি মানুষই মুগ্ধ হন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ বাড়িটিকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলা হলে এটি পর্যটন ও প্রকৃতি সংরক্ষণের একটি আদর্শ স্থান হয়ে উঠতে পারে। পাখিবাড়ি প্রকৃতির সাথে মানুষের সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ, যা আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণের গুরুত্বকে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয়।

হাল্লা পাখিবাড়ির ভবিষ্যৎ: ইকোট্যুরিজম ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ

হাল্লা পাখিবাড়িকে ঘিরে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও হাওরকেন্দ্রিক ইকোট্যুরিজম উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এর আওতায় পাখিদের বাসা বাঁধা ও বিশ্রামের উপযোগী গাছপালা সংরক্ষণ, পর্যটকদের জন্য আবাসিক সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার ব্যবস্থা করা হবে। এই উদ্যোগ হাল্লা পাখিবাড়িকে শুধু পাখিদের অভয়াশ্রমই নয়, বরং ইকোট্যুরিজমের একটি আদর্শ স্থান হিসেবে গড়ে তুলবে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা পাখিবাড়ি যাওয়ার উপায়

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পাখিদের কলকাকলিতে ভরপুর মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাল্লা পাখিবাড়ি একটি অনন্য গন্তব্য। এই পাখিবাড়ি হাকালুকি হাওরের পাশে অবস্থিত, যা প্রকৃতি প্রেমিক ও পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। যদি আপনি পাখি ভালবাসেন এবং এই অপূর্ব স্থানটি দেখতে চান, তাহলে এখানে যাওয়ার বিস্তারিত উপায় জেনে নিন।

ঢাকা বা সিলেট থেকে বড়লেখা যাওয়ার উপায়

যদি আপনি ঢাকা বা সিলেট থেকে বড়লেখা যেতে চান, তাহলে নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করতে পারেন:

ঢাকা থেকে বড়লেখা
  • বাসে করে: ঢাকার ফকিরাপুল বা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি বড়লেখার উদ্দেশ্যে বাস পাওয়া যায়। এপেক্স, শ্যামলী বা হানিফ এন্টারপ্রাইজের মতো বাস সার্ভিস রয়েছে। ভাড়া পড়বে ৫০০-৭০০ টাকা
  • ট্রেনে করে: প্রথমে ট্রেনে করে সিলেট আসতে হবে। এরপর সিলেট থেকে বড়লেখা যেতে পারেন বাস বা সিএনজি করে।
সিলেট থেকে বড়লেখা
  • বাসে করে: সিলেটের কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে বড়লেখার উদ্দেশ্যে বাস পাওয়া যায়। ভাড়া পড়বে ১০০-১৫০ টাকা
  • সিএনজি করে: সিলেট থেকে বড়লেখা যাওয়ার জন্য সিএনজি ভাড়া নিতে পারেন। ভাড়া পড়বে ৮০০-১০০০ টাকা

বড়লেখা থেকে হাল্লা পাখিবাড়ি যাওয়ার উপায়

হাল্লা পাখিবাড়ি বড়লেখা পৌর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে হাকালুকি হাওরের হাল্লা গ্রামে অবস্থিত। বড়লেখা থেকে পাখিবাড়ি যাওয়ার জন্য নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করতে পারেন:

সিএনজি চালিত অটোরিকশা
  • সাধারণ সিএনজি: বড়লেখা থেকে হাল্লা পাখিবাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি চালিত অটোরিকশা সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম। সাধারণ সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৪০ টাকা।
  • রিজার্ভ সিএনজি: যদি আপনি রিজার্ভ করে যেতে চান, তাহলে ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। রিজার্ভ সিএনজিতে যাওয়া আরামদায়ক এবং সময়ও কম লাগে।
প্রাইভেটকার

আপনার যদি প্রাইভেটকার থাকে, তাহলে বড়লেখা থেকে হাল্লা পাখিবাড়ি যাওয়া খুবই সহজ। রাস্তার অবস্থা ভালো হওয়ায় গাড়ি নিয়ে যেতে কোনো সমস্যা হয় না। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় গুগল ম্যাপ বা স্থানীয় লোকজনের সাহায্য নিতে পারেন।

মোটরসাইকেল

অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়রা মোটরসাইকেল নিয়েও হাল্লা পাখিবাড়ি যেতে পারেন। বড়লেখা থেকে পাখিবাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মোটরসাইকেল চলাচলের জন্য উপযোগী। তবে নিরাপত্তার জন্য হেলমেট ব্যবহার করতে ভুলবেন না।

হাল্লা পাখিবাড়ি ভ্রমণের কিছু টিপস

  • সকাল বা বিকেলে যান: পাখিদের ওড়াউড়ি ও কলকাকলি উপভোগ করতে সকাল বা বিকেলে যাওয়া সবচেয়ে ভালো।
  • পানি ও খাবার নিয়ে যান: পাখিবাড়ির আশেপাশে খাবারের দোকান তেমন নেই, তাই প্রয়োজনীয় পানি ও খাবার সঙ্গে নিয়ে যান।
  • ক্যামেরা নিয়ে যান: পাখিদের সুন্দর মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে ভুলবেন না।
  • স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিন: পাখিবাড়ি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিতে পারেন।

মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাল্লা পাখিবাড়ি প্রকৃতি প্রেমিক ও পর্যটকদের জন্য একটি অপূর্ব গন্তব্য, প্রকৃতির সাথে মানুষের সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ। সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই স্থানটি দেখতে আজই প্ল্যান করুন। পাখিদের কলকাকলি আর হাকালুকি হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই স্থানটি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা গেলে এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকোট্যুরিজমের একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

পাখি শিকার আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। পাখি শিকার, উত্যক্ত করা, হত্যা করা থেকে নিজে বিরত থাকুন, অন্যজনকেও বিরত রাখুন।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ borolekhamoulovibazarPakhibari