পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলের এক ছোট্ট পাহাড়ী হ্যামলেট রঙ্গো (Rongo) যা ভুটান সীমান্তের কাছে অবস্থিত যা শিলিগুড়ি থেকে ৯৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাহাড়ি নদীর ধারে সুন্দরী অফবিট এবং এক মনোরম ঠিকানা রঙ্গো, যেখানে ভিড় কম আবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। কয়েক দিনের জন্যে আপনার নিরিবিলি ঠিকানা হতে পারে এই রঙ্গো। এই ছোট্ট মনোরম গ্রামটি একটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। গৈরিবাস থেকে সাত কিলোমিটার একটি চড়াই রাস্তা আপনাকে আপনার গন্তব্যে নিয়ে যাবে এবং চালসা থেকে কুমানি গৈরিবাস হয়ে পথ গিয়েছে ঝালং-এ। কালিম্পং মহকুমার অধীনে এবং ঝালং নদীর তীরে অবস্থিত, রঙ্গো একটি ছোট গ্রাম যা তার সিনচোনা বাগানের জন্য বিখ্যাত। ঝালং থেকে রঙ্গোর দূরত্ব ১৩’কিমি। এটি নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের অন্যতম দ্বার।
ঝালংয়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে জলঢাকা নদী। ঝালং থেকে পাহাড়ি পথে ছোট্ট গ্রাম প্যারেন হয়ে ভুটান সীমান্তে ভারতের শেষ জনপদ বিন্দু। পথে পড়বে ঝালং-এ জলঢাকা হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্ট, প্যারেনে রঙিন রঙিন কাঠের বাড়িঘর আর রাস্তার ধারে কমলালেবুর বাগান। ছবির মতো পাহাড়ি গ্রাম বিন্দু। বিন্দুতে জলঢাকা ব্যারেজের ওপারে ভুটান। বাঁধের ওপর পায়ে হেঁটে ওঠা যায়, ছবি তোলা নিষেধ। হেঁটে আসা যায় ওপারে ভুটানের চৌহদ্দি থেকেও। নদীর গা থেকে খাড়াই উঠে গেছে ভুটান পাহাড়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিন্দু থেকে হিমালয়ের বরফশৃঙ্গ দেখা যায়।
বিস্তৃত মেঘেদের সারির ছবি এখানকার আকাশে যেন রং-তুলি দিয়ে আঁকা থাকে। পাহাড় ঘেরা সবুজের আড়ালে নিজেকে যদি লুকিয়ে ফেলতে চান দুটো দিন, কিম্বা পাহাড়ী কোন পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখতে চান মোহময়ী সূর্যোদয়, রঙ্গো হতে পারে আপনার ঠিকানা। যারা হিমালয়ান বার্ডের খোঁজ করেন তাদের জন্য ও এক আদর্শ লোকেশন এই রঙ্গো। নানা ধরনের হিমালয়ান বার্ডের দেখা মেলে এখানে। বিশেষ করে যারা হর্ণবিল, ব্রডবিল দেখবার আশায় ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়ান পাহাড়ের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, একবার আসুন রঙ্গোতে। কোন কুয়াশা মোড়া সকালে প্রিয় সঙ্গীর হাতে হাত রেখে হেঁটে যেতে পারেন রঙ্গোর আঁকাবাঁকা পথ ধরে। হারিয়ে যাবেন এক অদ্ভুৎ ভালোলাগার দেশে। পথে দেখা মেলা পাহাড়ী মানুষেরা হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাবে। এখানকার মানুষদের উষ্ণ আতিথিয়তা, হোমস্টেতে নিজের বাড়ীতে থাকার মতো আনন্দ দেবে। এই হোমস্টের বারান্দায় বসে গরম চায়ের সাথেই কেটে যাবে ঘন্টার পর ঘন্টা। আপনার পরিবারের ছোট সদস্যেরও প্রিয় জায়গা হয়ে যাবে সবুজে ঘেরা লন। এক কথায় আপনার দুদিনের ছুটি কাটানোর এই আস্তানা আপনার মনের কোণে জায়গা করে নেবেই।
কাছে পিঠে দর্শনীয় বলতে, মাত্র চার কিমি দূরেই ঝালংখোলা। রঙ্গো ভিউ পয়েন্ট, কিউই গার্ডেন, জিরো পয়েন্ট, নেওড়া ভ্যালি, রঙ্গো গুম্বাদাড়া সবই খুব কাছেই। দিনে দিনেই ঘুরে আসা যায়। এছাড়া ৫ কিমি দূরে দলগাঁও ভিউ পয়েন্ট, ১০ কিমি দূরে জলঢাকা বিন্দু এবং ২৭ কিমি দূরে সুনতালে খোলা, রকি আইল্যান্ড সব এই রঙ্গো থেকে দিনে দিনেই ঘুরে আসা যায়। তাই একটা গাড়ী ভাড়া করে বেড়িয়ে পড়লেই হলো, দেখবার জায়গার অভাব নেই। প্রকৃতির অপরূপ সবুজতায় হারিয়ে যাবেন নিমেষেই।
রঙ্গোতে যেদিন পৌঁছাবেন, সেদিন প্রথমেই নদীটিকে একবার দেখে আসুন। শান্ত নির্জন পরিবেশে নদীর গম্ভীর আওয়াজ আপনাকে আকর্ষণ করবেই। নদীর ঠিক পাশেই ছোট্ট একটি কাঠের সেতু। পায়ে হেঁটে ওপারে গিয়ে পাহাড়ী জঙ্গলে আরো একবার নিজেকে নতুন করে চিনে নিন। ফিরতি পথে গুটি গুটি পায়ে যতদূর সম্ভব গ্রামটি একবার ঘুরে দেখতে পারেন। স্কুল ফেরত শিশুরা, ছোট ছোট দোকান, রংবাহারী ফুল ও পাতার সমাহার, নিপুন হাতে লাগানো শাক সব্জির বাগানখানি, গ্রামের হাসিখুশি লোকজন, পোষা চারপেয়েদের দেখতে দেখতে সময় যে কখন পেরিয়ে যাবে তা বুঝতে পারবেন না। এসবের সাথে উপরি পাওনা হিসাবে আমরা পেয়েছিলাম অঝোর ধারায় পাহাড়ী বৃষ্টি।
পরেরদিন সকাল সকাল নাস্তা সেরে পায়ে হেঁটে দেখতে পারেন সুবিশাল মাঠে লেমন গ্রাসের জঙ্গল। এরপর গাড়ি করে বেড়িয়ে পড়ুন কাছাকাছি দেখবার জায়গাগুলিতে। সিঙ্কোনা চাষ। সিঙ্কোনা গাছের ছাল শুকিয়ে কিভাবে ওষুধ প্রস্তুত করা হয় একনজরে তা জেনে নিতে পারেন।
এরপরে চলে আসুন “দলগাঁও ” ভিউ পয়েন্ট। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে নীচের দিকে তাকালে দেখা যাবে সাদা ফিতের মতো তিরতিরে জলঢাকা নদীটিকে। নদীর ওপারে খাড়াই পাহাড় বেষ্টিত ভুটান। দুই পা দেশের মাটিতে অথচ চোখদুটি অন্য দেশে। কি অদ্ভুত তাইনা!
মনের মতো ছবি ক্যামেরাবন্দী হলে চলে আসুন “জিরো পয়েন্ট।” আলো আঁধারি পাইনে ঘেরা জঙ্গল। এখান থেকে দুই ঘন্টা ট্রেক করলে নাকি চীনের বর্ডার দেখতে পাওয়া যায়।
হারানো পাইনের বনে রাস্তা খুঁজে এরপর সোজা চলে আসুন রঙ্গো ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ধোঁয়ামাখা সাদা মেঘগুলি কেমন বিচরণ করছে তা দেখে মন খুশিতে ভরে উঠবে। নীচ থেকে শোনা যাবে নদীর কলকল সুর। পথে পরবে একটি মোনাস্ট্রি। ব্যাস এরপর ফিরে আসুন হোমস্টেতে। দুপুরের খাওয়া সেরে টানা ঘুমটা দিতে কিন্তু একদম ভুলবেননা।
সান্ধ্যকালীন স্নাক্স পর্ব সেরে রাতে পাহাড়ী গ্রামটির কাছেপিঠে আরো একবার ঘুরে আসুন। আলো আঁধারিতে নদীর রূপটি বড়ো মায়াময়।
হাতে যদি আরও একটি দিন সময় থাকে তাহলে পরেরদিন গাড়ি নিয়ে চলে যান ঝালং, বিন্দু, প্যারেন। পথে যেতে যেতে পরবে কমলালেবুর বাগান। জলঢাকা নদীর পাওয়ার প্রজেক্ট। রাস্তার ধারে ধারে কাঠ দিয়ে তৈরী, রঙবেরঙের ফুল ও পাতাবাহার দিয়ে সাজানো বাংলোগুলিও কিন্তু বেশ চোখ টানবে।সময় থাকলে প্যারেন থেকে একঝলকে দেখে আসতে পারেন তোদে গ্রামটিকেও। ভারত ভুটান সীমান্তের মাঝে অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম হোলো বিন্দু। ভুটানের বর্ডার। আকাশ স্বচ্ছ থাকলে বিন্দু থেকে হিমালয়ের বরফ ঢাকা শৃঙ্গগুলি দেখতে পাবেন।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রঙ্গোর এর দূরত্ব ৯৭ কিমি। গাড়ীতে সময় লাগে ৪-৪.৩০ ঘন্টা। বড় গাড়ী ভাড়া ৪৫০০/- টাকা, ছোট গাড়ী ভাড়া ৩৫০০/- টাকা। নিউ মাল জংশন থেকে রঙ্গোর বড় গাড়ী ভাড়া ৩০০০/- টাকা, ছোট গাড়ী ভাড়া ২২০০/- টাকা।
হোমস্টেতে থাকার খরচ- ১৫০০/- জনপ্রতি প্রতিদিন সমস্ত মিল সহ (নূন্যতম দুজন)। ড্রাইভারের থাকার খরচ ৮০০/- জনপ্রতি।
Rongo Riverside Farmstay
ভাড়া প্রতিদিন প্রতিজন ১১০০ রুপী অফারে। থাকা এবং চারবেলা খাওয়া সমেত। ব্রেকফাস্টে কোনোদিন ম্যাগি, ডিমসেদ্ধ আবার কোনদিন রুটি তরকারি। সঙ্গে চা তো আছেই। দুপুরে দুই রকমের ভাজা, তরকারি সহ ডাল এবং ডিমকষা। সন্ধ্যেবেলা চা, পকোড়া, ভুট্টা তো কোনোদিন ম্যাগি। রাতের বেলা একটি তরকারি সাথে গরম গরম মুরগির মাংস আর রুটি অথবা ভাত। এমনিতে ভাড়া ১৪০০ রুপী তবে সিজন অনুযায়ী কমবেশি হয়।
ফোন নম্বর -7076909924
Atithi Riverside Homestay
এটি একদম নদীর পাশেই। তবে বর্ষায় যখন নদীর জল বেশ খানিকটা বেড়ে যায় তখন বেশ চিন্তাই বটে।
ফোন নম্বর – 7407914217 অথবা 8945884160
Rongo Riverview Homestay
এই হোমস্টের ছাদ থেকে নদীটি দেখা যায়।
ফোন নম্বর – 8660111789
Leave a Comment