সাজেক ভ্যালি – ২ দিন ১ রাতের ট্যুর প্ল্যান

সাজেক ভ্যালি (Sajek Valley) ভ্রমণের আজকের এই পর্বটি সাজানো হয়েছে এক রাত দুই দিনের ট্যুর প্ল্যান নিয়ে। কিভাবে যাবেন? কোথায় থাকবেন? কখন কোথায় ঘুরতে যাবেন ও কিভাবে আসবেন? এই সব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে আজকের এই পর্বে।

সাজেকের সৌন্দর্য নিয়ে কিছু কথা

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি বাংলাদেশের মেঘের রাজ্য খ্যাত এই সাজেক ভ্যালি। পাহাড়ি মনোরম দৃশ্য আর মেঘের রাজ্যে মেঘেদের ছুটাছুটির মতো দারুণ সব অভূতপূর্ব চমৎকার দৃশ্য দেখা যায় এখন থেকে। সাজেক বেশ বিরল ও বৈচিত্র্যময় এক ভ্রমণ দর্শনীয় স্থানও বটে।প্রতিটি মুহূর্তেই যেন প্রকৃতি তার রূপ বদলায় এখানে। কখনো বা পরিষ্কার আকাশ , স্বাচ্ছন্দেই দেখা মেলে সবুজ অভয়ারণ্যের মিতালী ঘনিষ্ঠতা ; আবার কখনো কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় চারপাশ , ঘন মেঘের ভীড়ে ধোঁয়াশার চাদরে অনুভূত হয় এক স্পর্শ কাতর অনুভূতি ; আবার কখনও বা মুহূর্তেই শুরু হয় অঝোরে বৃষ্টি , আবির্ভূত হয় এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তের। সাজেকের বৈচিত্র্যময় রূপের এই মিলন মেলায় যেন মুছে যায় জীবনের সকল গ্লানি , অন্তর জুড়িয়ে যায় স্পর্শ কাতর অনুভূতিতে।

সাজেকের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হচ্ছে কংলাক পাহাড় ও হ্যালিপ্যাড। কংলাক পাহাড়ের সৌন্দর্যের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সাজেক ভ্রমণে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে  এক প্রধান আকর্ষণ এই কংলাক পাহাড়। এটি মূলত কংলাক পাড়ায় অবস্থিত। যা সাজেক ভ্যালির একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত লুসাই জনগোষ্ঠীর দ্বারা অধ্যুষিত একটি এলাকা। কংলাক পাহাড়ের পরেই আসে হেলিপ্যাডের কথা। সূর্যোদয়ের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় এই হেলিপ্যাড থেকে। সূর্যোদয়ের অপরূপ এই দৃশ্য উপভোগ করতে সাজেক ভ্রমণে আসা প্রায় প্রতিটি পর্যটকই পারি জমান এই হেলিপ্যাডে। 

সাজেক ভ্যালি যাওয়ার উপায়

আমি আগেই বলেছি আজকের এই পর্বটি সাজানো হয়েছে দুই দিন এক রাতের ট্যুর প্ল্যান নিয়ে। আর তাই সেই ধারাবাহিকতায় আজকে আপনাদেরকে কিছু টিপস শেয়ার করব।

১.ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সাজেক যেতে হলে আপনাকে অবশ্যয় খাগড়াছড়ি হয়ে যেতে হবে। সৌদিয়া , শ্যামলী , ঈগল , বিআরটিসি ও সেন্ট মার্টিন পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি বাস রাত ১০টায়  ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। তাই আপনি এগুলোর যে কোনো একটিতে টিকেট কেটে উঠে পড়ুন।এক্ষেত্রে নন এসি বাসে জনপ্রতি ভাড়া ৫২০ টাকা। আর এসি বাসে ভাড়া জনপ্রতি ৭০০ টাকা।

২.চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি যেভাবে যাবেন

চট্টগ্রাম থেকে আপনি দুইভাবে খাগড়াছড়ি যেতে পারেন। হয়তো কদমতলী থেকে নয়তো অক্সিজেন মোড় থেকে যেতে হবে। কদমতলী থেকে প্রতিদিন ৪ টি বিআরটিসি এসি বাস খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, জনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা। তাছাড়া অক্সিজেন মোড় থেকে ১ ঘন্টা পর পর শান্তি পরিবহনের বাস চলাচল করে, জনপ্রতি ভাড়া ১৯০ টাকা। চট্রগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি যেতে সময় লাগবে ৪-৫ ঘন্টার মতো।

সাজেক ট্যুর প্ল্যান (১ রাত ২ দিন)

১ম দিন

সকাল ৭-৮টার মধ্যে খাগড়াছড়ি পৌঁছে যাবেন। সেখানে পৌঁছে শাপলা চত্বর থেকে প্রথমেই একটি চাঁদের গাড়ি কিংবা জীপ ভাড়া করে ফেলুন। এক্ষেত্রে এক রাত দু ‘ দিনের জন্য চাঁদের গাড়ি ভাড়া পড়বে ৮,১০০ টাকা। আর জীপ ভাড়া পড়বে ৯,৫০০ টাকা। তারপর গাড়ি ভাড়া করেই সকালের নাস্তাটা সেরে ফেলুন। নাস্তা সেরে যত দ্রুত সম্ভব রওনা দিন। কারণ সকাল ৯-৯:৩০ এর মধ্যেই আর্মি এসকোর্ট পৌঁছতে হবে। এসকোর্ট ছাড়া আপনি কোনো ভাবেই সাজেক যাওয়ার অনুমতি পাবেন না। তাই যেভাবেই হোক সকালের এসকোর্ট মিস করবেন না। যদিও আর্মি এসকোর্ট দুই বার বসে, একবার সকালে আরেকবার বিকেলে। সকালের এসকোর্ট মিস করলে বিকেল অবদি অপেক্ষা করতে হবে। তাই কোনো ভাবেই সকালের এসকোর্ট মিস করবেন না। তারপর এসকোর্ট শেষ করে যাত্রা শেষ করুন সাজেকের উদ্দেশ্যে, এক্ষেত্রে সাজেক পৌঁছতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা।

সাজেক পৌঁছেই হোটেল বুকিং করে ফেলুন। তবে আগে থেকেই হোটেল বুকিং করে রাখা ভালো। তারপর খাবার হোটেল গুলোতে গিয়ে কতজন কি খাবেন তা অর্ডার করে আসুন। কেননা সেখানকার খাবার হোটেল গুলোতে আগে থেকে অর্ডার করা ছাড়া কোনো খাবার পাবেন না। দুপুরে খাওয়া শেষ করে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে রওনা দিন কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। কংলাক পাহাড়ে আপনি হেঁটে কিংবা জীপে চড়ে যেতে পারেন। তবে এই পথটুকু জিপে না গিয়ে হেঁটে যাওয়ায় শ্রেয়। সেখানে পৌঁছে পুরো বিকেলটাই কংলাক পাহাড়ে কাটিয়ে দিন। সাজেকের সবচেয়ে উঁচু জায়গা এই কংলাক পাহাড় থেকে আপনি প্রকৃতির সৌন্দর্যটা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।

পুরো বিকেলটা কংলাক পাহাড়ে কাটানোর পর সন্ধ্যায় চলে আসুন সাজেকে। সাজেকে ফিরে সাজেকের চারপাশটা একটু ঘুরে দেখুন। সাজেকে বারবিকিউ অর্ডার নেয়া হয়, চাইলে বারবিকিউ আয়োজনও করতে পারেন। যাইহোক, তারপর রাতে যতদ্রুত সম্ভব খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ুন। কেননা পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে।        

 ২য় দিন

সকাল সাড়ে ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে পড়ুন। উঠেই চলে যান হেলিপ্যাডে, সূর্যোদয়ের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে। তারপর হেলিপ্যাডে কিছুটা সময় কাটিয়েই হোটেলে চলে আসুন। সেখানে সকালের নাস্তা শেষ করে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করুন। মনে রাখবেন সকাল ১০ টা থেকে ১০:৩০ এর মধ্যেই আর্মি এসকোর্টে  পৌঁছতে হবে। তারপর আর্মি এসকোর্ট শেষ করে সাজেক থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথেই দেখতে পাবেন হাজাছড়া ঝর্ণা। সেখানে একটা বিরতি নিয়ে হাজাছড়া ঝর্ণাটা একটু ঘুরে দেখুন। আপনি চাইলে হাজাছড়া ঝর্ণার উপর থেকেও একবার ঘুরে আসতে পারেন।

তারপর হাজাছড়া ঝর্ণা দেখেই খাগড়াছড়ি চলে আসুন। সেখানে এসে যে কোনো হোটেলে দুপুরের খাবারটা সেরে ফেলুন। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ড্রাইভারকে বলে রিসাং ঝর্ণা ঘুরে আসুন। এখানে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, ড্রাইভারকে বললেই আপনাকে রিসাং ঝর্ণা নিয়ে যাবে। তারপর সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে চলে যান আলুটিলা গুহায়। এ গুহায় আপনি রোমাঞ্চকর এক অনুভূতির মুখোমুখি হবেন। তবে সেই জন্য আপনাকে অবশ্যয় মশাল নিয়ে যেতে হবে। চিন্তার করার কোনো কারণ নেই, সেখানে মশালের ব্যবস্থাও রয়েছে। গুহাতে ঢুকতে জনপ্রতি মোট ৩০ টাকার মতো খরচ হবে। তারপর সবশেষে আলুটিলা গুহা থেকে বেরিয়েই চলে যান ঝুলন্ত ব্রীজ। সেখানে পুরো বিকেলটা কাটিয়েই চলে আসুন শাপলা চত্বরে। সেখান থেকেই টিকেট কেটে ফেলুন। একটা কথা মাথায় রাখবেন, খাগড়াছড়ি থেকে দূর পাল্লার বাস গুলো রাত ৮ টার মধ্যেই ছেড়ে যায়। কাজেই কিছুটা আগেই খাগড়াছড়ি পৌঁছে টিকেট কেটে ফেলুন। তবে এ সকল  ক্ষেত্রে আগে থেকেই বাসের টিকেট বুকিং দিয়ে রাখা ভালো।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ

  • ছুটির দিন গুলোতে সাজেক ভ্রমণ করতে চাইলে কমপক্ষে ১৫-২০ দিন আগে বাসের টিকেট ও হোটেল বুকিং দিয়ে রাখবেন। নয়তো বা আপনি কোনো ভাবেই বাসের টিকেট পাবেন না। হ্যাঁ , তবে ভাগ্য ভালো হলে পেতেও পারেন, কিন্তু এ ধরণের ঝুকি না নেয়াই  ভালো।
  • সাজেক যাওয়ার আগে সাথে করে রবি ও টেলিটক সিম নিয়ে যেতে পারেন। কারণ রবি টেলিটক সিম ছাড়া অন্য কোনো সিমে সেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।
  • আপনি যে ঋতুতেই সাজেক ভ্রমণ করুন না কেন সাথে অবশ্যয় শীতের পোশাক রাখবেন। কারণ আমি আগেই বলেছি যে, সাজেকের প্রকৃতি বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ।

যে সকল বিষয়ে অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন

  • আপনি যেন কারও বিরক্তির কারন না হন সেই বিষয়ে অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন। আর তাই অধিবাসীদের সাথে সর্বদা ভালো ব্যবহার করুন।
  • সাজেকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পানির অভাব। তাই এখানে গিয়ে খুব সীমিত পানি ব্যবহার করুন। অন্যকেও এ বিষয়ে অবগত করুন।
  • ময়লা-আবর্জনা, উদাহরণস্বরূপ চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, প্লাষ্টিক কিংবা পলিথিন ব্যাগসহ ইত্যাদি সকল ধরণের ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট কোনো ফেলুন।
  • উক্ত সকল নিয়ম-কানুন গুলো যথাযথ পালন করার মাধ্যমে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকেও নিরাপদ রাখুন।
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ guidelinessajekTour Plan