হাইপোথার্মিয়া: পর্বতের নীরব ঘাতক

হাইপোথার্মিয়া (Hypothermia) একটি মারাত্মক শারীরিক অবস্থা। যখন শরীর তার স্বাভাবিক তাপমাত্রা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) নিচে নেমে যায়, তখন হাইপোথার্মিয়া হয়। এটি শুধু পর্বতারোহীদের জন্য নয়, বরং যেকোনো পরিস্থিতিতে যে কেউ শিকার হতে পারে, বিশেষ করে ঠান্ডা আবহাওয়ায়।

হাইপোথার্মিয়া কি

হাইপোথার্মিয়া হলো এমন একটি অবস্থা, যখন শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়ে স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারাতে শুরু করে। আমাদের শরীর একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা (সাধারণত ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বজায় রাখতে সক্ষম। যখন শরীর দ্রুত তাপ হারাতে থাকে এবং সেই অনুযায়ী তাপ উৎপাদন করতে না পারে, তখন হাইপোথার্মিয়া দেখা দেয়।

হাইপোথার্মিয়া কেন হয়ে থাকে

  • ঠান্ডা আবহাওয়া: অতিরিক্ত ঠান্ডায় দীর্ঘক্ষণ থাকলে শরীর তাপ হারাতে শুরু করে।
  • ভেজা কাপড়: ভেজা কাপড় শরীরের তাপ দ্রুত কমিয়ে দেয়।
  • দুর্বল স্বাস্থ্য: দুর্বল বা অসুস্থ শরীর ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করতে পারে না।
  • অপর্যাপ্ত খাবার ও পানীয়: পর্যাপ্ত খাবার এবং পানীয়ের অভাবে শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং তাপ উৎপাদন কমে যায়।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি: শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি হাইপোথার্মিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
  • অ্যালকোহল ও মাদক দ্রব্য: এগুলোর কারণে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হতে পারে।
  • বয়স: শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা দ্রুত হাইপোথার্মিয়ার শিকার হতে পারে।

হাইপোথার্মিয়া এর লক্ষণগুলো কি কি

হাইপোথার্মিয়ার লক্ষণগুলো সাধারণত তিনটি পর্যায়ে দেখা যায়:

মৃদু হাইপোথার্মিয়া (৩৫-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস)

  • কাঁপুনি: শরীর কাঁপুনি শুরু করে তাপ উৎপাদনের চেষ্টা করে।
  • দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস: শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়।
  • দুর্বলতা: শরীর দুর্বল লাগতে শুরু করে।
  • বিভ্রান্তি: সামান্য মানসিক বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে।:

মাঝারি হাইপোথার্মিয়া (৩২-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস)

  • কাঁপুনি কমে যাওয়া: কাঁপুনি কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।
  • মাংসপেশির অনমনীয়তা: মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়।
  • ঝিমুনি: অতিরিক্ত ঘুম আসতে পারে।
  • অস্পষ্ট কথা বলা: কথা বলতে অসুবিধা হয়।
  • স্মৃতিভ্রংশ: স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে।

মারাত্মক হাইপোথার্মিয়া (২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে)

  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া: রোগী জ্ঞান হারাতে পারে।
  • দুর্বল নাড়ি: নাড়ি দুর্বল হয়ে যায়।
  • অগভীর শ্বাস-প্রশ্বাস: শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে এবং অগভীর হয়।
  • হৃদস্পন্দন কমে যাওয়া: হৃদস্পন্দন अनियमित হয়ে যেতে পারে, এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

হাইপোথার্মিয়া হলে কি ধরনের চিকিৎসা নিতে হবে

হাইপোথার্মিয়ার জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এটি মারাত্মক হতে পারে।

প্রাথমিক চিকিৎসা

  • রোগীকে গরম করুন: রোগীকে ঠান্ডা থেকে সরিয়ে উষ্ণ স্থানে নিয়ে যান।
  • ভেজা কাপড় সরান: ভেজা কাপড় দ্রুত খুলে ফেলুন এবং শুকনো কাপড় পরান।
  • গরম পানীয় দিন: রোগীকে গরম পানীয় (চা, কফি, স্যুপ) দিন। তবে অ্যালকোহল দেওয়া উচিত না।
  • গরম সেঁক দিন: বগল, কুঁচকি এবং ঘাড়ে গরম সেঁক দিন।
  • শরীর মুড়িয়ে দিন: রোগীকে কম্বল বা গরম কাপড় দিয়ে ভালোভাবে মুড়িয়ে দিন।

জরুরী চিকিৎসা

  • হাসপাতালে নিয়ে যান: রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।
  • ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড: হাসপাতালে গরম স্যালাইন দেওয়া হয়, যা শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
  • অক্সিজেন: শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য অক্সিজেন দেওয়া হয়।
  • অন্যান্য চিকিৎসা: প্রয়োজনে হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য অন্যান্য ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

হাইপোথার্মিয়া প্রতিরোধের উপায়

  • সঠিক পোশাক: ঠান্ডা আবহাওয়ায় শরীর গরম রাখার জন্য স্তরযুক্ত পোশাক পরুন। জলরোধী এবং বাতাসরোধী পোশাক ব্যবহার করুন।
  • শুকনো থাকুন: শরীর ভেজা থাকলে দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই শরীর শুকনো রাখার চেষ্টা করুন।
  • পর্যাপ্ত খাবার ও পানীয়: শরীরকে উষ্ণ রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালোরি গ্রহণ করুন এবং ডিহাইড্রেশন এড়াতে প্রচুর পরিমাণে তরল পান করুন।
  • বিশ্রাম: শারীরিক ক্লান্তি কমিয়ে শরীরকে বিশ্রাম দিন।
  • অ্যালকোহল পরিহার করুন: অ্যালকোহল শরীরকে দ্রুত ঠান্ডা করে।
  • সতর্কতা অবলম্বন: আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে চলুন।

হাইপোথার্মিয়া একটি মারাত্মক অবস্থা, যা দ্রুত শনাক্ত করে সঠিক চিকিৎসা শুরু করলে জীবন বাঁচানো সম্ভব। বিশেষত যারা ঠান্ডা অঞ্চলে কাজ করেন বা ভ্রমণ করেন, তাদের এই বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

Leave a Comment
Share