বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মুঘল তাহখানা (Mughal Tahakhana) কমপ্লেক্স একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন যা মুঘল স্থাপত্যের অনন্য সৌন্দর্য প্রকাশ করে। এটি শুধু একটি প্রাসাদ নয়, বরং মসজিদ, মাজার এবং বিশাল দিঘির সংমিশ্রণে একটি পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক কমপ্লেক্স। ইতিহাসপ্রেমী এবং ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এটি এক বিশেষ আকর্ষণ।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা ১৬৩৯ থেকে ১৬৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবাদার ছিলেন। এ সময় শাহ সৈয়দ নিয়ামতউল্লাহ নামে একজন প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক দিল্লি থেকে গৌড় অঞ্চলে আসেন। শাহ সুজা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং তাহখানা নির্মাণের আদেশ দেন। ফারসি শব্দ ‘তাহখানা’ এর অর্থ ‘ঠান্ডা ভবন’, যা মূলত গ্রীষ্মকালে আরামদায়ক থাকার জন্য নির্মিত হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এটি ছিল শাহ সৈয়দ নিয়ামতউল্লাহ’র বাসস্থান এবং কখনো কখনো শাহ সুজাও এখানে অবস্থান করতেন।
মুঘল তাহখানা একটি তিনতলা বিশিষ্ট ভবন। পশ্চিম থেকে একতলা মনে হলেও পূর্বদিকে জলাশয়ের পাশে দোতলা পর্যন্ত স্পষ্ট। ভবনটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল যাতে শীতকালে কক্ষগুলো উষ্ণ থাকে এবং গ্রীষ্মকালে শীতল। ভবনের কক্ষগুলোতে একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল যা পাশের দাফেউল বালাহ নামক জলাশয়ের সাথে সংযুক্ত ছিল। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কক্ষগুলোর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হতো।
ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি দুর্গসদৃশ টাওয়ার রয়েছে, যা ধ্যান বা নামাজের জন্য ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়। মূল ভবনের মধ্যস্থলে একটি বড় কক্ষ ছিল, যেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফোয়ারা স্থাপন করা হয়েছিল। ফোয়ারা থেকে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও ছিল। তবে ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ভবনের বেশ কিছু অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক ভবনটি আংশিক পুনর্গঠন করা হয়েছে।
তাহখানা কমপ্লেক্সের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হলো তাহখানা জামে মসজিদ। এটি একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ যা মুঘল স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। মসজিদটি শাহ সৈয়দ নিয়ামতউল্লাহ নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়। মসজিদের কাছে তার সমাধি অবস্থিত, যা ‘বারদুয়ারী’ নামে পরিচিত।
মুঘল তাহখানা কমপ্লেক্সের পূর্বদিকে অবস্থিত বিশাল জলাশয় তালাবে দাফেউল বালাহ বা রোগমুক্তির পুকুর নামে পরিচিত। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, এর পানি একসময় বিষাক্ত ছিল। শাহ সৈয়দ নিয়ামতউল্লাহ’র দোয়া ও অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে এটি সুপেয় হয় এবং এর পানি রোগ মুক্তির জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
মসজিদের পাশেই রয়েছে শাহ সৈয়দ নিয়ামতউল্লাহ’র সমাধি। এই এক গম্বুজবিশিষ্ট ভবনের চারপাশে রয়েছে ১২টি দরজা। এর সামনে এবং পাশেই আরও কিছু সমাধি রয়েছে, যা তার পরিবারের সদস্য এবং সহচরদের বলে মনে করা হয়। মাজারের পশ্চিমে একটি বিশেষ কবরস্থান রয়েছে যা শুধু নারীদের জন্য নির্ধারিত ছিল। অনেক কবর এখন বিলীন হয়ে গেলেও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
তাহখানায় প্রবেশের জন্য টিকিট মূল্য ২০ টাকা। প্রবেশ করলেই প্রথমে দেখা যাবে প্রাসাদটি। তার উত্তর দিকে রয়েছে মসজিদ এবং মসজিদের উত্তরেই রয়েছে মাজার। পুরো কমপ্লেক্সটি ঘুরে দেখতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। সন্ধ্যার পর আলোক ব্যবস্থা না থাকায় ভ্রমণ শেষ করার জন্য বিকেলের আগে উপযুক্ত সময়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে ছোট সোনা মসজিদ পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। সেখান থেকে অটোরিকশায় মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে তাহখানা পৌঁছানো সম্ভব। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটরসাইকেলেও যাওয়া যায়।
তাহখানার প্রবেশ পথ এবং রাস্তাগুলোর অবস্থা বেশ খারাপ। কোনো পার্কিং ব্যবস্থাও নেই। এছাড়া, পর্যটকদের জন্য তথ্য নির্দেশিকা বা গাইডের অভাব রয়েছে। স্থানটি আরও আকর্ষণীয় করতে রাতের আলোক ব্যবস্থা এবং রাস্তার সংস্কার প্রয়োজন।
মুঘল তাহখানা শুধু একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নয়, এটি বাংলার মুঘল স্থাপত্যের একটি জীবন্ত সাক্ষী। প্রকৃতিপ্রেমী এবং ইতিহাসের অনুসন্ধানীদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। প্রাচীন ঐতিহ্যের সংরক্ষণ এবং উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এটি পর্যটকদের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
তাহখানা থেকে অল্প দূরত্বে উল্লেখযোগ্য আরও স্থাপনা:
Leave a Comment