সিলেট

লোভাছড়া

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার একেবারে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বালুভরা বেশ কিছু স্বচ্ছ পানির নদী। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লোভাছড়া নদী।এখানে সবুজ পাহাড় আর লোভা নদীর অসাধারণ স্বচ্ছ পানি একবার দেখলে বারবার যেতে ইচ্ছে করবে। সঙ্গে বাড়তি পাওনা লোভাছড়া চা-বাগানের বহু পুরোনো ঝুলন্ত সেতুর সঙ্গে এখানকার খাসিয়া গ্রাম। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমন্তে কানাইঘাট উপজেলায় ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া চা বাগান এবং নানা দর্শনীয় স্থান ঘিরেই লোভাছড়ার অবস্থান। ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, নদী-নালা ও খাল-বিল পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক দর্শনীয় স্থান লোভাছড়া (Lovachora)।

লোভাছড়া থেকে ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয় খুব বেশী দূরে নয়। এখাকার যে কোন উঁচু পাহাড়ে উঠলে মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় খুব কাছে থেকে দেখা যায়। ভোর সকালে লোভাছড়া বাগানে হরিণ, খরগোশ, আর বন মোরগ চোখে পড়ে। লোভাছড়া চা-বাগান বন্যপ্রাণীরও অভয়াশ্রম। বাগান কর্তৃপক্ষের একটি বিশাল আকৃতির পোষা হাতি রয়েছে, যেটি সবসময় বাগানে অবাধ চলাফেরা করে। লোভাছড়ায় পর্যটকের জন্য থাকার কোন সু-ব্যবস্থা না থাকলেও বাগান মালিক কর্তৃপক্ষের জন্য রয়েছে ৪টি বাংলো। বাংলোগুলোর বাহ্যিক দৃশ্যগুলোও বেশ নান্দনিক। লোভাছড়া বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা লোভা নদী থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক পাথর উত্তোলন করেন। এই নদীর পাথর ও বালু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যায়।

এখানকার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে চা বাগান, প্রাকৃতিক লেক ও ঝর্ণা, ঝুলন্তসেতু, মীরাপিং শাহর মাজার, মোঘল রাজা-রানির পুরাকীর্তি, প্রাচীন দীঘি, পাথর কোয়ারি ও বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন ঘুরতে ঘুরতে কখন যে একটা দিন পেরিয়ে যাবে তা বুঝে উঠতে পারবেন না।

লোভাছড়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঝুলন্ত সেতু। সড়ক পথে লোভাছড়ায় আসার পথে পাওয়া যায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই ঝুলন্ত সেতু, স্থানীয়ভাবে যা ‘লটকনির পুল’ নামে পরিচিত। জানা যায়, ১৯২৫ সালে ইংরেজরা লোভাছড়ায় যাতায়াতের জন্য সেতুটি নির্মাণ করে। আকর্ষণীয় এই সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে লোভাছড়ার অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করা সত্যিই অসাধারণ। লোভাছড়ার দক্ষিণ পাশে সুরমা নদী তীরবর্তী মূলাগুল বাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত একটি টিলার ওপর রয়েছে হযরত শাহজালাল(র.)-এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম ওলি হযরত মীরাপিং শাহ (র.) এর মাজার। মাজারটি দেখার জন্য এখানে প্রতিদিন অনেক ভক্ত এসে ভিড় জমান। ভক্তদের ভালোবাসার শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ে মাজার সংলগ্ন এলাকায়।

লোভাছড়া সীমান্তে মোগল সাম্রাজ্যের রাজা-রানিদের অনেক পুরাকীর্তি রয়েছে। চোখাটিলা নামক একটি পাহাড়ের পাদদেশে একটি ঝর্ণার পাশে রয়েছে প্রাচীনকালের দুটি পাথর। এ পাথর দুটিতে বসে রাজা-রানিরা খেলতেন। পাথরে বসে রাজা-রানিরা লোভাছড়ার সৌন্দর্য নিবিড়ভাবে অবলোকন করতেন।

চা বাগানের পাশে রয়েছে একটি বিশাল দীঘি। এককালে দীঘিতে অনেক অলৌকিক জিনিসপত্র যেমন, থালা-বাসন, রৌপ্যমুদ্রা ইত্যাদি পানিতে ভেসে উঠত বলে লোকমুখে বিভিন্ন মুখরোচক কাহিনী প্রচার হয়ে আসছে।

সুরমা নদীর পূর্ব প্রান্তজুড়ে রয়েছে সুবিশাল পাথরের খনি যা লোভা পাথর কোয়ারী। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে। এখান থেকে আহরিত পাথর সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। এখানকার কোয়ারিতে আসার পথে আকর্ষণীয় অনেক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। নৌকায় আরোহণ করার পর পাহাড়, বাগান আর সবুজ বনানী নৌকা আরোহীর দৃষ্টি ও মন কেড়ে নেয়। নৌকায় বসে স্বচ্ছ পানির নিচ দিয়ে নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়।

লোভাছড়া কখন যাবেন

চাইলে যেকোনো মৌসুমে আপনি লোভাছাড়া ঘুরতে পারেন। তবে পুরোটাই সবুজময় লোভাছড়া চা বাগান বর্ষায় এক অপূর্ব রূপ ধারণ করে। বৃষ্টির দিনে লোভাছড়ার সবুজ বুকে ঝাঁপ দেওয়া কিংবা শীতে এপাশ-ওপাশ কুয়াশাময় পাহাড় আর বাগানে রোদের খেলা যেকোনো পর্যটকের হৃদয় জয় করবে।

লোভাছড়া কিভাবে যাওয়া যায়

বাসে সিলেট

ঢাকা থেকে সিলেট এর উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায় গাবতলী এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে৷বাস গুলো সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় পরপর ছেড়ে যায়৷ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে। এ পথে গ্রীন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া এস আলম পরিবহন, শ্যামলি পরিবহন ও এনা পরিবহনের এসি বাস চলাচল করে। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার ১শ’ টাকা। এছাড়া শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনের পরিবহনের নন এসি বাস সিলেটে যায়। ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা। এনা পরিবহনের বাসগুলো মহাখালী থেকে ছেড়ে টঙ্গী ঘোড়াশাল হয়ে সিলেট যায়।

ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট

ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ০৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া দেড়শ থেকে ১ হাজার ১৮ টাকা। ট্রেনে গেলে রাত ৯.৫০ এর উপবন এক্সপ্রেসে জাওয়াটাই সব থেকে ভালো কারন আপনার যেতে যেতে সকাল হয়ে যাবে আর আপনি যদি রাতে ট্রেনে ঘুমিয়ে নিন তাহলে সকালে ট্রেন থেকে নেমেই আপনার ভ্রমন শুরু করতে পারেন আর সময় লাগবে ৭-৮ ঘন্টা।

চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেট

চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৪৫ থেকে ১ হাজার ১৯১ টাকা।ট্রেন এর টিকেট এর দাম: এসি বার্থ ৬৯৮ টাকা, এসি সিট ৪৬০ টাকা, ফার্স্ট ক্লাস বার্থ ৪২৫ টাকা, ফার্স্ট ক্লাস সিট ২৭০ টাকা. স্নিগ্ধা ৪৬০ টাকা, শোভন চেয়ার ১৮০ টাকা, শোভন ১৫০ টাকা, সুলভ ৯৫ টাকা।

ট্রেনের সময়সূচি এখানে দেখে নিন
(Bangladesh Railway/Train Time Schedule)

সিলেট বাই এয়ার / প্লেনে সিলেট

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, নভো এয়ার এবং ইউএস বাংলা এয়ারের বিমান প্রতিদিন যায় সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর অভ্যন্তরীণ রুট ঢাকা-সিলেট এর টিকেট মুল্যঃ
Super Saver: ৩২০০ টাকা
Economy Saver: ৩৭০০ টাকা
Economy Flexible: ৪২০০ টাকা
Business Saver: ৫৯০০ টাকা
Business Flexible: ৬৯০০ টাকা

সিলেট থেকে লোভাছড়া

সিলেট শহর থেকে তিনটি সড়কে কানাইঘাট সদরে পৌঁছার সুযোগ আছে। বাস অথবা সিএনজি-অটোরিক্সায় সরাসরি দরবস্ত-চতুল হয়ে কানাইঘাট সদরে যাওয়া যায়। অন্যদিকে, গোলাপগঞ্জ-চারখাই-শাহবাগ হয়ে জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে কানাইঘাট পৌঁছা যাবে। এছাড়া গাজী বুরহান উদ্দিন সড়ক দিয়ে সিলেট-গাছবাড়ী সড়ক দিয়ে কানাইঘাট সদরে পৌছার সুযোগ রয়েছে। সিলেট শহর থেকে কানাইঘাট সদরে বাসভাড়া সর্বোচ্চ ৬০টাকা এবং সিএনজি-অটোরিকশা ভাড়া সর্বোচ্চ ১শ’ টাকা। রিজার্ভ সিএনজি ৫শ’ ৭শ’ টাকা হবে। তিন পথেই সিএনজিযোগে যাওয়া যাবে কানাইঘাটে। কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে লোভাছড়ার দূরত্ব মাত্র ৯ কিলোমিটার। উপজেলা সদর থেকে সড়ক ও নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়া যায়। লোভাছড়ায় যাতায়াতের রাস্তাটির অর্ধেকের চেয়ে বেশি কাঁচা হওয়ায় খুবই কষ্ট করে সেখানে পৌঁছাতে হয়। তাই নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়াই সহজ রাস্তা। আর লোভাছড়া ঘুরতে সময় লাগবে প্রায় ৩ থেকে ৪ঘন্টা।

কোথায় থাকবেন

সিলেটে থাকার মত অনেকগুলো হোটেল আছে,সিলেটে আপনি আপনার প্রোয়োজন ও সামর্থ অনুযায়ী যে কোন ধরনের হোটেল পাবেন। কয়েকটি পরিচিত হোটেল হল – হোটেল হিল টাউন, গুলশান, দরগা গেইট, সুরমা,কায়কোবাদ ইত্যাদি। লালা বাজার এলাকায় কম ভাড়ায় অনেক মানসম্মত রেস্ট হাউস আছে৷ হোটেল অনুরাগে সিঙ্গেল রুম ৪০০টাকা (দুই জন আরামসে থাকতে পারবেন), তিন বেডের রুম ৫০০টাকা (সাধারনত ৪জন থাকতে পারবেন)। রাত যাপনের জন্য দরগা রোডে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। রুম ভাড়া ৫০০/- টাকা থেকে ৫০০০/- টাকা পর্যন্ত।

  • শহরের শাহজালাল উপশহরে হোটেল রোজ ভিউ (০৮২১-৭২১৪৩৯)।
  • দরগা গেইটে হোটেল স্টার প্যাসিফিক (০৮২১-৭২৭৯৪৫)।
  • ভিআইপি রোডে হোটেল হিলটাউন (০৮২১-৭১৬০৭৭)।
  • বন্দরবাজারে হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল (০৮২১-৭২১১৪৩)।
  • নাইওরপুলে হোটেল ফরচুন গার্ডেন (০৮২১-৭১৫৫৯০)।
  • জেল সড়কে হোটেল ডালাস (০৮২১-৭২০৯৪৫)।
  • লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন (০৮২১-৮১৪৫০৭)।
  • আম্বরখানায় হোটেল পলাশ (০৮২১-৭১৮৩০৯)।
  • দরগা এলাকায় হোটেল দরগাগেইট (০৮২১-৭১৭০৬৬)।
  • হোটেল উর্মি (০৮২১-৭১৪৫৬৩)।
  • জিন্দাবাজারে হোটেল মুন লাইট (০৮২১-৭১৪৮৫০)।
  • তালতলায় গুলশান সেন্টার (০৮২১-৭১০০১৮) ইত্যাদি।

তামাবিল/জৈন্তাপুর এর দিকে বেশ কিছু রিসোর্ট আছে। আপনার থাকার ব্যবস্থা যদি এইদিকে কোথাও হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে হাদারপাড় থেকে আবার আগের মতই গোয়াইনঘাটে আসতে হবে। গোয়াইন ঘাট থেকে যেতে হবে সারি ঘাট। সিএনজি/লেগুনাতে করে যেতে পারেন। ভাড়া জনপ্রতি ৬০টাকা।

কোথায় খাবেন

খাওয়ার জন্য সিলেটের জিন্দাবাজারে বেশ ভালো তিনটি খাওয়ার হোটেল আছে। হোটেল গুলো হচ্ছে পাঁচ ভাই,পানশি ও পালকি। এগুলোতে প্রায় ২৯ প্রকারের ভর্তা আছে।

Leave a Comment
Share