১৯৭১ সাল, বাঙালি জাতির জন্য এক রক্তাক্ত অধ্যায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও নৃশংসতার কাহিনী আজও আমাদের হৃদয়ে কাঁটা বিঁধায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এলেও সেই সময়ের বীভৎস স্মৃতি মুছে যায়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বধ্যভূমি, যা সেই সময়ের বর্বরতার নির্বাক সাক্ষী। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জল্লাদখানা বধ্যভূমি (Jalladkhana Boddhobhumi) এরকমই একটি স্থান, যা আজ একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে।
একাত্তরে মিরপুর ছিল ঢাকার তুলনামূলক নির্জন এলাকা। বিহারি অধ্যুষিত এই এলাকা পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের জন্য ছিল স্বর্গরাজ্য। নির্বিঘ্নে তারা এখানে তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে ১১ নম্বরের দিকে যেতে বেনারসি পল্লীর পাশেই অবস্থিত এই বধ্যভূমি। প্রবেশপথের ফটকে লেখা “কান পেতে শুনি কী বলতে চাইছে মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি” যেন আমাদের সেই সময়ের বীভৎসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে কবি রবিউল হুসাইনের তৈরি “শূন্য হৃদয়” নামক মাটির স্মারক। এর চারপাশে সারাদেশের ৪৭৭টি বধ্যভূমির নাম লেখা। “জীবন অবিনশ্বর” নামক একটি ফলকচিত্রে গণহত্যার প্রতীকী দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পাশেই একটি সংগ্রহশালা, যার ভেতরে মিরপুরের শহীদদের নামের তালিকা, বধ্যভূমির মাটি সংরক্ষিত কাচের শেলফে। জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠের পূর্বদিকে রয়েছে “স্মৃতি টাওয়ার”।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মিরপুরের বিহারি অধ্যুষিত এলাকাগুলো ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করার পর সেপটিক ট্যাংক ও কূপে ফেলে দেওয়া হতো। পাম্প হাউসের কূপের সামনেই বাঙালিদের শিরচ্ছেদ করা হতো। এ বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি, ৫ হাজার ৩৯২টি অস্থিখন্ড, মেয়েদের শাড়ি, ফ্রক, অলংকার, জুতা, তসবিসহ শহীদদের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
পরিত্যক্ত পাম্প হাউসের ভেতরে ও বাইরে দুটি কূপ ছিল। কম গভীর কূপে শহীদদের মাথা এবং গভীর কূপে দেহ ফেলে দেওয়া হতো। ধারণা করা হয়, খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে এই মিরপুরের জল্লাদখানার আশপাশেই হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছিল।
১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এই বধ্যভূমিতে খননকাজ শুরু করে। ২০০৭ সালের ২১ জুন এই স্থাপনাটির দ্বার উন্মোচন করা হয়। কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রচেষ্টায় “জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ” তৈরি করা হয়।
প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ দর্শনার্থী এই স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করেন। উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষ এখানে এসেছেন। নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং সেই সময়ের বর্বরতার সাক্ষ্য প্রত্যক্ষ করতে সকলের, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের, এই বধ্যভূমি পরিদর্শন করা উচিত। এই বধ্যভূমি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতার মূল্য কত বড় এবং এই স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জল্লাদখানা বধ্যভূমি যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় রয়েছে। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে সহজেই এই স্থানে যাওয়া যায়। গোলচত্বর থেকে ১১ নম্বর সেকশনের দিকে যেতে বেনারসি পল্লীর পাশেই এর অবস্থান। আপনি বাস, রিকশা, অটোরিকশা অথবা ব্যক্তিগত গাড়ী ব্যবহার করতে পারেন। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে যেকোনো রিকশা বা অটোরিকশাওয়ালাকে জল্লাদখানা বধ্যভূমি বললেই তারা আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবে। বাসে করে যেতে চাইলে, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে যেসব বাস ১১, ১২, ১৪ নম্বর সেকশনের দিকে যায় সেগুলোতে উঠতে পারেন। বেনারসি পল্লীতে নেমে কিছুটা হাঁটলেই জল্লাদখানা বধ্যভূমি পৌঁছে যাবেন। গাড়িতে করে গেলে, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ১১ নম্বরের দিকে রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই বেনারসি পল্লীর পাশে জল্লাদখানা বধ্যভূমি দেখতে পাবেন।
Leave a Comment