ঢাকা

আড়াপাড়া জমিদার বাড়ি

সাভার উপজেলার আড়াপাড়া গ্রামে, সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আড়াপাড়া জমিদার বাড়ি (Arapara Jamidar Bari) যার আরেক নাম রাই শশী নিবাস। প্রায় একশত সতেরো বছরের পুরনো এই স্থাপনা, তার নিঃশব্দ উপস্থিতিতে বহন করে চলেছে অতীতের গৌরব, ঐতিহ্য এবং একান্ত ব্যক্তিগত ইতিহাসের স্মৃতি। দুটি প্রাসাদ, একটি মন্দির, একটি পুকুর, ভাস্কর্য এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রবেশদ্বার – সব মিলিয়ে এক বিশাল ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে এক সমৃদ্ধ অতীতের ছবি।

সুতা ব্যবসায়ী থেকে জমিদার

এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। ধনাঢ্য সুতা ব্যবসায়ী দুই ভাই, রাইমোহন সাহা এবং শশীমোহন সাহা, এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। ঢাকা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ এবং এমনকি কলকাতাতেও তাদের ব্যবসা বিস্তৃত ছিল। প্রথম প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয় ১৯০০ সালে, যার নাম “রাই শশী নিবাস”। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে নির্মিত হয় দ্বিতীয় প্রাসাদ “রাই নিকেতন”। এই দুটি প্রাসাদের স্থাপত্যশৈলীতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তৎকালীন সময়ের স্থাপত্যের ধারা। “রাই নিকেতন” এর উপরে ইংরেজিতে লেখা “RM House” তাদের ব্যবসায়িক পরিচয়ের ইঙ্গিত বহন করে। কালক্রমে এই সুতা ব্যবসায়ী পরিবার “জমিদার” হিসেবে পরিচিতি পায়।

প্রবেশদ্বার এবং ভাস্কর্য

জমিদার বাড়ির প্রবেশপথে সিংহ এবং দুটি নারী মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল, যা পাথর দিয়ে তৈরি। কিন্তু সময়ের আঘাতে এই ভাস্কর্যগুলি বর্তমানে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। একটি সিংহ মূর্তির চোয়াল ভাঙ্গা, অন্যটি একেবারেই উধাও। নারী মূর্তি দুটিও অসম্পূর্ণ – একটার হাত নেই, অন্যটার পা নেই। এই ভাস্কর্যগুলির ধ্বংসাবশেষ একদিকে যেমন অতীতের স্মৃতি বহন করে, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের কথাও স্পষ্টভাবে বলে। মূল ফটকের ধ্বংসাবশেষ এবং জীর্ণ লোহার কবজাও একই কাহিনী বলছে।

মন্দির এবং পুকুর

জমিদার বাড়িতে ঢোকার মুখেই দৃষ্টি কাড়ে একটি সবুজ পানা পুকুর। পুকুরের পাড়ে স্থাপিত রাধা-গোবিন্দ মন্দির এই জমিদার পরিবারের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ বহন করে। মন্দিরের প্রবেশদ্বার কাঠের তৈরি এবং সুন্দর কারুকাজ খচিত। ফাল্গুন পূর্ণিমায় এই মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের দোল উৎসব পালিত হত। মন্দিরের পাশে একটি কাঠের দোলনা এই উৎসবের স্মৃতি বহন করে। মন্দির থেকে ডান দিকে একটি কালী মন্দিরের অস্তিত্বও পাওয়া যায়।

প্রাসাদের অভ্যন্তর

প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ সীমিত হলেও, যতটুকু দেখা গেছে, তাতে তৎকালীন সময়ের স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব স্পষ্ট। বারান্দা ঘেরা বাড়ি, মাঝখানে খোলা উঠান, দুই পাশে সিঁড়ি – এই সব মিলে একটি বিশাল এবং ভব্য চিত্র ফুটে উঠে। তবে বর্তমানে প্রাসাদের অনেক অংশ সংস্কার করে রান্নাঘর, শৌচাগার ইত্যাদি বানানো হয়েছে, যা মূল স্থাপত্যের সৌন্দর্য কিছুটা হ্রাস করেছে।

বর্তমান অবস্থা এবং ইতিহাসের অজানা অধ্যায়

বর্তমানে রাইমোহন এবং শশীমোহনের বংশধররা এই বাড়িতে বসবাস করছেন। তারা নিজেদের “জমিদারদের বংশধর” হিসেবে পরিচয় দিলেও, তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে তারা বেশি কিছু জানেন না। এই অজ্ঞতা এক দুঃখজনক বাস্তবতা, যা আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে পড়ছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে এই স্থাপনাটির সংস্কার এবং সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।

আড়াপাড়া জমিদার বাড়ি যাওয়ার উপায়

সাভার বাসস্ট্যান্ড ফুট ওভারব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে ব্যাটারিচালিত অটোগুলো যায় সাভার বাজার। সঙ্গে কিছু অটো যায় আড়াপাড়ার পাশ দিয়ে পোড়াবাড়ী। ১০ টাকা ভাড়ায় ওই অটোতে উঠে আড়াপাড়া নেমে একটু হেঁটে পৌঁছানো যাবে আড়াপাড়া জমিদার বাড়ি বা রাই শশী নিবাসে। রিকশায় গেলে ভাড়া পড়বে ২৫-৩০ টাকা।

আড়াপাড়া জমিদার বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি ঐতিহ্য। এই স্থাপনাটি আমাদের অতীতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, আমাদের ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংরক্ষণ আমাদের সকলের দায়িত্ব। এটি সংরক্ষণ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি সমৃদ্ধ অতীতের উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারব।

Leave a Comment
Share