পাহাড়ে গেলে কিছু সতর্কতা

আজকাল রাস্তা হওয়ায় অনেক পর্যটক অনেক উচ্চতায় যাচ্ছেন। একটু উচ্চতা, নয় বা দশ হাজারের ওপর হলে, পর্যটকই হোন বা ট্রেকার, আপনাকে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।

আপনার শরীর ঐ উচ্চতা বা ঠাণ্ডা বা আকস্মিক দুর্যোগ পাল্লা দিতে পারবে কিনা সে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব মূলত আপনার। কারোর কথা শুনে তা ধরে নেবেন না। সমস্যা হতে পারে মনে হলে ডাক্তারের এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিন। দলপতি বা ম্যানেজার অবশ্যই দেখে নেবেন যে প্রতিটি সদস্যের সেই শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা আছে কিনা। প্ল্যান সেইভাবেই করতে হবে।

উচ্চতায় বায়ুর ঘনত্ব ফলত বায়ুর চাপ কম। বুকভরে নিশ্বাস নিলেও যেটুকু বাতাস বা অক্সিজেন ঢোকে, তাতে শরীরের প্রয়োজন মেটে না। অক্সিজেনের শতকরা ভাগ বাতাসে একই থাকে, কিন্তু বাতাসের ঘনত্ব কম হওয়ায়, এক লিটার বাতাসের ভর কম হয়, অক্সিজেনও সেই অনুপাতে কম হয়। ফলে প্রয়োজন মেটে না। ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কিন্তু আরও বেশি করে যেটা হয় সেটা হল এই অক্সিজেনের ঘাটতি মেটানোর জন্য ফুসফুস ও হার্ট দ্রুত কাজ করতে থাকে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা যাদের আছে, তাদের সমস্যা হতেই পারে। হার্ট অ্যারেস্ট হতে পারে।

এছাড়া যেটা হতে পারে তা হল শরীর উচ্চতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা। এই খাপ কার শরীর খাইয়ে নেবে আর কার নেবে না, তা আগে থেকে বলা মুশকিল, তবে উচ্চ রক্তচাপ বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা আগে থাকতে থাকলে খাপ খাওয়াতেও সমস্যা হবে। শরীর যাতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তার জন্য সময় দিতে হবে। একে বলে acclimatization.

নয় বা দশহাজারের ওপর একদিনে বেশি হাইট অতিক্রম করা বিপজ্জনক যদি না আপনার শরীর তার জন্য প্রস্তুত থাকে। সময় দিয়ে, ভেঙে ভেঙে, রাত কাটিয়ে, এগোন যাতে আপনার শরীর আবহাওয়া ও উচ্চতার সাথে মানিয়ে নিতে পারে। শরীর ফিট না হলে রেস্ট নিন, এগোবেন না। বিশেষ করে বাড়তি উচ্চতায় এগোবেন না বা এমন জায়গার দিকে এগোবেন না যেখান থেকে নীচে নামা দুরূহ।

পর্যাপ্ত পানি পান করুন। এটা ডিহাইড্রেশন এড়াতে এবং উচ্চতার প্রভাবকে সামলাতে ভীষণ জরুরী।

উচ্চতাজনিত অসুস্হতাগুলোর তিনটে ধাপ আছে –

  • বমি, মাথা ধরা, অস্বস্তি।
  • তীব্র মাথা ধরা, খাওয়ার ইচ্ছে কমে যাওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, প্রচণ্ড কাশি, গা পাক দেওয়া, অত্যন্ত দ্রুত হার্টবীট।
  • তীব্র শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘুরতে থাকা, অসংলগ্ন কথাবার্তা, চোখে ভালো ঠাহর না হওয়া, বুকে ঘড়ঘড় আওয়াজ, তীব্র ব্যথা বুকে বা মাথায়।

এই শেষ ধাপ হয় হ্যাপ বা হ্যাস-এর জন্য, high altitude pulmonary eodema (hape) বা high altitude cerebral eodema (hace). এতে ফুসফুসে বা মস্তিষ্কে জল জমে যায়। এর ফল মৃত্যু। এর কোন ওষুধ নেই। একমাত্র প্রতিকার হল নীচে নামিয়ে আনা। এর সাথে শরীর থেকে জল বের করার জন্য ডায়ামক্স বা আরও আধুনিক ওষুধ বা ইনজেকশনের ব্যবহার।

এই শেষ ধাপের আগের ধাপ হল acute mountain sickness (ams). এর লক্ষণগুলো দেখতে পেলেই সাথে সাথে এগোনো বন্ধ করে নীচে নামতে হবে, অবশ্যই। অনেকেই বলেন কর্পূর বা হোমিওপ্যাথির কিছু ওষুধ বা শ্বাসকষ্টের জন্য ডেরিফাইলিন ইত্যাদি উচ্চতার প্রভাবকে এড়াতে পারে। এর জবাব হল না পারে না। ডেরিফাইলিন শ্বাসকষ্ট কমাতে পারে কিন্তু উচ্চতাজনিত কারণে শ্বাসকষ্ট বা সেইকারণে দ্রুত হৃদস্পন্দন-উচ্চরক্তচাপজনিত শ্বাসকষ্টের সমাধান ডেরিফাইলিন নয়। আর কর্পূর বা হোমিওপ্যাথির ওষুধের কোন পরীক্ষিত সত্যতা নেই।

মাথায় রাখুন আপনি পাহাড়ে যাচ্ছেন, পাহাড় আপনার ঘরে আসছে না। হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম বা বিজ্ঞাপনের চটকে নিজের ক্ষমতাকে বুঝবেন না। পারছেন, তাই একদিনে তিনহাজার ফুট মেরে দেবেন, এটাও করবেন না, সে হেঁটে হোক বা গাড়ি চেপে। ওটা বিশেষ কিছু ব্যক্তির জন্যই তোলা থাক।

যখন হাঁটছেন, তখন ঘাম হবে, তাই হালকা পোষাক ব্যবহার করলেও বিশ্রামের সময় ভারী পোষাক পরুন, ঘাম শরীরেই। মাথা ঢেকে রাখার চেষ্টা করুন, কান কিছুটা খোলা রাখার চেষ্টা করুন। তবে বারো হাজার ফুটের ওপর ভারী পোষাকই পরিধেয়। ট্রেক বা জার্নি শেষ করেই সাথে সাথে গিয়ে লেপকম্বলের তলায় ঢুকবেন না, একটু হাতপা খেলিয়ে নিন।

গাইড অভিজ্ঞ নিন। গাড়ি যায় কিন্তু তার মানে বারো বা চোদ্দ হাজার ফুটটা আটহাজার হয়ে যায় না, হেঁটে গেলেও নয়।

কিছু জায়গা, সবার জন্য নয়। সবার শারীরিক বা মানসিক ক্ষমতা, পাহাড়ের প্রেক্ষিতে সমান নয়, কাজেই ওটা চেষ্টা না করাই ভালো।

উচ্চতায়, বিশেষত ১০,০০০ ফুটের ওপর মদ্যপান এবং ধূমপান নিয়ন্ত্রিত রাখুন।

আবারও বলছি ডাক্তারের এবং অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিন। পর্যাপ্ত জল খান। ভেঙে ভেঙে এগোন। শরীরকে সইয়ে নেওয়ার সময় দিন। শারীরিক অসুবিধা হলে নীচে নামুন, নীচে নামুন, নীচে নামুন। সঙ্গে ওষুধ রাখুন, কিন্তু সেটা সমাধান নয়, এটাও মাথায় রাখুন। প্ল্যান করুন সবকিছু হিসেবে নিয়ে, গাইডও তার মধ্যে একটা।

পাহাড় আপনাকে ডাকছে (Mountain is Calling), ডাকবেও। কতটা সাড়া দেবেন সেটা নিজের ওপর নির্ভর করছে। আপনার পাহাড়যাত্রা আনন্দের হোক।

Leave a Comment
Share