উচ্চতা যখন চ্যালেঞ্জ: অ্যাক্লিমাটাইজেশন এবং পাহাড়ি পথের নিরাপত্তা

সেপ্টেম্বর মাসের এক উজ্জ্বল সকাল। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত কামেট বেসক্যাম্পে তখন কর্মব্যস্ততা। গতকালই সকলে বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে, তাই আজকের দিনটি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। কিচেন টেন্টে ব্রেকফাস্ট তৈরির তোড়জোড় চলছে, আর কিছু সদস্য উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন সময়ে হঠাৎ একটি চিৎকার, “আরে ইয়ে পাগলা গিয়া!!”

মুহূর্তের মধ্যে কিচেন টেন্ট থেকে এক শেরপা ছুটে বেরিয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখা গেল, এক সাহেব হাতে বরফের কুঠার (আইস এক্স) ধরে পাগলের মতো ছুটছেন। তাঁর চোখ লাল, দৃষ্টি ঘোলাটে, যেন কোনো ঘোর লেগে আছে। উপস্থিত সকলে হতবাক। সাহেব কিছুক্ষণ ইতস্তত তাকিয়ে চিৎকার করে তেড়ে গেলেন তাঁরই এক সঙ্গীর দিকে, তারপর অন্য একজনকে। বোঝা গেল, তাঁর রাগটা আসলে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর নয়, বরং সকলের ওপর। মিনিট দশেক পর ক্লান্ত হয়ে বরফের কুঠারটি ছুঁড়ে ফেলে একটি পাথরের ওপর ধপ করে বসে পড়লেন তিনি।

সবচেয়ে বয়স্ক শেরপা বিড়বিড় করে বললেন, “সাব কো অল্টিটিউড লাগ গ্যায়া।”

এই ঘটনাটি একটি চরম উদাহরণ হলেও, পাহাড়ি পথে এমন পরিস্থিতি অস্বাভাবিক নয়। উচ্চতার সাথে শরীরকে মানিয়ে নিতে না পারলে অনেকেই ‘অ্যাকিউট মাউন্টেন সিকনেস’ (AMS)-এর শিকার হন। মাথা ধরা, বমি বমি ভাব, খাবারে অনীহা, রাতে ঘুম না হওয়া, ঝিমঝিম করা – এগুলো AMS-এর সাধারণ লক্ষণ। পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ১৫-৪০% ট্রেকার বা পর্বতারোহী ৯০০০ ফিটের বেশি উচ্চতায় উঠলে AMS-এ আক্রান্ত হন।

অ্যাক্লিমাটাইজেশন (Acclimatisation ) কি?

সহজ ভাষায়, অ্যাক্লিমাটাইজেশন হল উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরে অক্সিজেনের অভাব পূরণের জন্য ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব কমতে থাকে। আমাদের শরীর তখন এই কম অক্সিজেনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত সময় না পেলে AMS দেখা দিতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, পাসের কাছাকাছি পৌঁছনোর দিন ট্রেকাররা অসুস্থ হয়ে পড়েন, কারণ ওই দিনটিতে উচ্চতা খুব দ্রুত বাড়ে এবং শরীর পর্যাপ্ত সময় পায় না।

তাই AMS এড়ানোর প্রধান উপায় হল সঠিক অ্যাক্লিমাটাইজেশন। এর জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলা আবশ্যক।

ছবি সংগ্রিহীত

অ্যাক্লিমাটাইজেশন: লক্ষণ ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া

অ্যাক্লিমাটাইজেশন একটি জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে আমাদের শরীর উচ্চতার সাথে সাথে অক্সিজেনের অভাবের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় শরীর বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত ৯০০০ ফিটের বেশি উচ্চতায় উঠলে অ্যাক্লিমাটাইজেশনের লক্ষণগুলো দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণগুলো হলো মাথা ধরা, বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া, খাবারে অনীহা, শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি। অনেকের ক্ষেত্রে রাতে ঘুম আসতে সমস্যা হয়, আবার কারো কারো ঝিমঝিম লাগতে পারে। এছাড়াও, অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, এবং মাথা ঘোরা ইত্যাদি লক্ষণও দেখা যেতে পারে। এই লক্ষণগুলো হালকা থেকে তীব্র হতে পারে এবং ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে এই লক্ষণগুলো দেখা গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে না যায়।

অ্যাক্লিমাটাইজেশন এড়িয়ে চলার উপায়

  1. ৯০০০ ফিটের বেশি উচ্চতায় প্রতিদিন ১৫০০ ফিটের বেশি ওঠা উচিত নয়। ধীরে ধীরে উচ্চতা বাড়াতে হয়, যাতে শরীর অক্সিজেনের অভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।
  2. প্রতি ৩০০০ ফিট উচ্চতা বৃদ্ধির পর অন্তত দুই রাত সেখানে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। এতে শরীর নতুন উচ্চতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়।
  3. পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা শরীরকে ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করে। ডিহাইড্রেশনের কারণেও মাথা ব্যথা হতে পারে। ক্যাম্পসাইটে পৌঁছে অন্তত আধ লিটার জল ধীরে ধীরে পান করা উচিত।
  4. ক্লান্তিকর হাঁটার শেষে গরম পানীয় শরীরকে চাঙ্গা করে তোলে। ক্যাম্পে পৌঁছে গরম স্যুপ, চা অথবা জুস পান করলে শরীরে শক্তি আসে এবং ক্লান্তি দূর হয়। গরম পানীয়ের সাথে বিস্কুট বা কেক শরীরকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে।
  5. পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে দ্রুত মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। রাতে ভালো ঘুমের জন্য রাতের খাবারের পর কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করা ভালো। ঘুমানোর সময় মাথা হালকা কাপড়ে ঢেকে রাখা উচিত এবং পা গরম রাখা প্রয়োজন।
  6. পর্বতারোহণের একটি পরিচিত প্রবাদ হল “ক্লাইম্ব হাই, স্লিপ লো” (Climb high, Sleep low)। এর অর্থ হল দিনের বেলায় বেশি উচ্চতায় আরোহণ করে রাতে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় বিশ্রাম নেওয়া। ট্রেকিংয়ের ক্ষেত্রে এটি সবসময় সম্ভব না হলেও, ক্যাম্পে পৌঁছে বিশ্রাম নেওয়ার পর একটু হেঁটে আসা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ক্যাম্পের আশেপাশে অল্প উচ্চতায় হেঁটে শরীরকে আরও ভালোভাবে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া যায়।
  7. ঠান্ডা বাতাস খুব বেশি না বইলে কান খোলা রাখা এবং হাতে গ্লাভস না পরা শরীরকে ঠান্ডার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।

অ্যাক্লিমাটাইজেশনে আক্রান্ত হলে কি করবেন?

যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে ধরে নিতে হবে সেটি AMS, যতক্ষণ না অন্য কিছু প্রমাণিত হয়। AMS-এর লক্ষণ দেখা গেলে আর উপরে ওঠা উচিত নয়। সেখানেই বিশ্রাম নিয়ে শরীরকে ঠিক করার চেষ্টা করতে হবে। অবস্থার অবনতি হলে এবং HAPE (High Altitude Pulmonary Edema) বা HACE (High Altitude Cerebral Edema)-এর লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত রোগীকে নিচে নামিয়ে আনতে হবে।

অনেক সময় ট্রেকাররা অসুস্থতা গোপন করেন, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। পাহাড় হিরোগিরি দেখানোর জায়গা নয়। অসুস্থ বোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে দলের অন্য সদস্যদের জানানো উচিত।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চলুন

অভিজ্ঞ গাইড বা শেরপাদের পরামর্শ মেনে চললে এবং নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হলে পাহাড়ের অনেক বিপদ এড়ানো সম্ভব। মনে রাখবেন, পাহাড়ের পথে তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে এগোনোই বুদ্ধিমানের কাজ।

এই পোষ্টে ওষুধের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হয়নি, কারণ একজন সাধারণ ভ্রমণকারী হিসেবে রোগ প্রতিরোধের ওপর জোর দেওয়াই উচিত। এছাড়াও, ওষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

পরিশেষে, মনে রাখতে হবে যে পাহাড় প্রকৃতি মায়ের এক রূপ, যেখানে সামান্য ভুলচুকও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই সমস্ত নিয়মকানুন ও নিরাপত্তা বিধি মেনে চলুন এবং পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করুন।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Acclimatisation