টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে হেমনগর জমিদার বাড়ি (Hemnagar Zamindar Bari), স্থানীয়ভাবে “পরীর দালান” নামে পরিচিত, তার অনন্য স্থাপত্য এবং রোমহর্ষক ইতিহাসের জন্য বিশেষ স্থান দখল করে আছে। গোপালপুর উপজেলায় অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি ১৮৮০ সালে জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী প্রায় ৩০ একর জমির উপর নির্মাণ করেন।
এই জমিদার বংশের উত্থান শুরু হয় মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়া থেকে। ১২৫৪ বাংলা সনে পদ্মলোচন রায় পুখুরিয়া পরগনার জমিদারি ক্রয়ের মাধ্যমে এই বংশের ভিত্তি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র কালীচন্দ্র রায় এবং পৌত্র হেমচন্দ্র রায় (পরে চৌধুরী) ক্রমান্বয়ে জমিদারি বিস্তৃত করেন উত্তর টাঙ্গাইল এবং সিরাজগঞ্জ জেলা জুড়ে, প্রায় চার লক্ষ একর জমি তাদের অধীনে আসে।
হেমচন্দ্র চৌধুরীর সময়ে নিকটবর্তী ধনবাড়ির মুসলিম জমিদার নওয়াব নওয়াব আলী চৌধুরীর সাথে বিরোধ উদ্ভব হয়। এই বিরোধের মূলে ছিল রাজকাচারি, প্রজাস্বত্ব এবং মৌজার সীমানা সংক্রান্ত বিতর্ক। দুই প্রতাপশালী জমিদারের মধ্যে এই বিরোধ ক্রমশ গভীর হতে থাকে।
১৮৮০ সালে হেমচন্দ্র চৌধুরী আমবাড়িয়া রাজবাড়ি ত্যাগ করে গোপালপুর উপজেলার সুবর্ণখালী গ্রামে নতুন রাজবাড়ি স্থাপন করেন। যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এই বন্দর নগরী কোলকাতার সাথে যোগাযোগের সুবিধার জন্য তৎকালীন বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। কোলকাতা থেকে আসা স্টীমার এবং বাণিজ্যিক জাহাজ এখানে ভিড় জমাত। ১৯০৫ সালে হেমচন্দ্র চৌধুরীর প্রচেষ্টায় ময়মনসিংহ থেকে জগন্নাথগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ হয়, যা পরে সিরাজগঞ্জ হয়ে কোলকাতার সাথে সংযুক্ত হয়। এই রেলপথ নির্মাণে তার অবদান অস্বীকার্য।
দুর্ভাগ্যবশত, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যমুনা নদীর ভাঙনে সুবর্ণখালী বন্দর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং হেমচন্দ্রের রাজবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়। তিনি পরে ১৮৯০ সালে (১৮৮০ নয়) শিমলাপাড়া মৌজায় পরীর দালান (Porir Dalan) নামে একটি নতুন দ্বিতল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা বর্তমানে হেমনগর জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই জমিদার বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
হেমনগর জমিদার বাড়ি এর স্থাপত্য চমৎকার। বাড়ির সামনের দেয়ালের চিনি-টিকরি কাজ চোখে পড়ার মতো। বালি ও চুনের প্লাস্টারের উপর নানা রঙের সিরামিক্স, কাঁচ এবং আয়নার টুকরো দিয়ে তৈরি জ্যামিতিক এবং ফুল-লতাপাতার নকশা অসাধারণ। এই নিখুঁত কারুকাজ দিল্লী ও কোলকাতা থেকে আনা কারিগরদের দক্ষতার প্রমাণ। প্রবেশদ্বারের উপরের ভাস্কর্য এবং দুই পাশের পরীর মূর্তি “পরীর দালান” নামকরণের কারণ।
দুই সারি বারান্দা, বিশাল দরবার হল এবং প্রায় ১০০ টি কক্ষ বিশিষ্ট এই দোতলা প্রাসাদটির স্থাপত্যশৈলী চমৎকার। সামনের অংশ দোতলা হলেও পেছনের অংশ একতলা। ভেতরে রয়েছে উঠান। প্রাসাদের সামনে বিশাল মাঠ, বাগান, চিড়িয়াখানা, হাতিশাল এবং জলসাঘর একসময় জমিদার পরিবারের ঐশ্বর্যের প্রতীক ছিল। কোলকাতা থেকে প্রখ্যাত শিল্পীরা এখানে আসতেন বিনোদন পরিবেশন করতে। এক বাইজীকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া এক নাটকীয় ঘটনা এখনও জনশ্রুতিতে জীবিত। রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে হেমনগর বাজার।
ঢাকা থেকে হেমনগর জমিদার বাড়ি বা “পরীর দালান” ভ্রমণে প্রথমে টাঙ্গাইল যেতে হবে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল ৮৩ কিলোমিটার দূরে। সড়কপথে, কমলাপুর থেকে বিভিন্ন এসি/নন-এসি বাসে টাঙ্গাইল যাওয়া যায়, ভাড়া ৪০০-১০০০ টাকা এবং সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা। বিকল্প হিসেবে, কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ধূমকেতু, একতা, সিল্কসিটি, সিরাজগঞ্জ, চিত্রা, দ্রুতযান, লালমনি ও পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনে টাঙ্গাইল যাওয়া যায়। শ্রেণিভেদে ভাড়া লাগবে ৯৫-৩৯৭ টাকা।
টাঙ্গাইল পৌঁছানোর পর, গোপালপুরের উদ্দেশ্যে বাস বা অন্যান্য স্থানীয় পরিবহন ব্যবহার করুন। টাঙ্গাইল থেকে হেমনগর ৪৭ কিলোমিটার এবং গোপালপুর থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে। গোপালপুর থেকে সিএনজি, অটোরিকশা বা অন্যান্য স্থানীয় যানবাহনে করে হেমনগর রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন জমিদার বাড়ি/পরীর দালানে পৌঁছানো সহজ।
দেশ বিভাগের পর জমিদার পরিবার কলকাতায় চলে যান। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক রাজবাড়ি একটি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক এই স্থাপনা ঘুরে দেখতে আসেন। এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি সংরক্ষণ এবং পরিচর্যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আবশ্যক।
Leave a Comment