টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি (Delduar Jamindar Bari), যা স্থানীয়দের কাছে “নর্থ হাউস” নামে পরিচিত। এই জমিদার বাড়িটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শন। টাঙ্গাইলের একমাত্র মুসলিম জমিদার বাড়ি হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর এই একতলা বাড়িটি লাল-সাদা রঙের মিশ্রণে মসজিদের কারুকার্যের অনুকরণে নির্মিত, যা দর্শকদের মনে প্রশান্তি এনে দেয়।
যদিও দেলদুয়ার জমিদার বাড়িটির প্রতিষ্ঠার সঠিক তারিখ অজানা, তবে এর ইতিহাস আফগানিস্তানের গজনী থেকে আগত এক মুসলিম বংশের সাথে জড়িত। এই বংশের পূর্বপুরুষ ফতেহদাদ খান গজনভি লোহানি এই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা বলে বিবেচিত। বংশধররা তাদের বংশপরিচয় স্মরণে “গজনভি লোহানি” খেতাব ব্যবহার করতেন।
দেলদুয়ার জমিদার বংশের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিলেন স্যার আবদুল করিম গজনভি এবং স্যার আবদুল হালিম গজনভি। এই দুই ভাই ছিলেন দানবীর, উচ্চশিক্ষিত এবং সফল ব্যবসায়ী। তাদের মাতা করিমু নেসা খানম চৌধুরানী ছিলেন বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং বিখ্যাত কবি বেগম রোকেয়ার বোন।
স্যার আবদুল করিম গজনভি (১৮৭২-১৯৩৯)
ইংল্যান্ড এবং জার্মানিতে শিক্ষিত স্যার আবদুল করিম ১৮৯৪ সালে জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি দুইবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ব্রিটিশ সরকার তাকে “নাইট” (১৯২৮) এবং “নবাব বাহাদুর” (১৯৩৩) উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি Pilgrim Traffic to Hejaz and Palestine, Muslim Education in Bengal এবং The Diearkiyal Education in Bengal নামে তিনটি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেন।
স্যার আবদুল হালিম গজনভি (১৮৭৬-১৯৫৩)
ব্যবসা এবং রাজনীতিতে সক্রিয় স্যার আবদুল হালিম ইন্ডিয়া স্টিমশিপ কোম্পানির চেয়ারম্যান, কলকাতা মুসলিম চেম্বার অব কমার্স এবং ইন্ডিয়া চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হিসেবে কার্যরত ছিলেন। তিনি The Musolman এবং The Star of India পত্রিকার প্রকাশনার সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি “নাইট” উপাধি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে কলকাতা থেকে দেলদুয়ারে ফিরে আসেন এবং ১৯৫৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
বাড়ির মাঝখানে অবস্থিত ছাদটি ছিল নারীদের আড্ডার স্থান। পূর্ব পাশে লোহার গার্ডেন চেয়ার, গোল টেবিল এবং পানির ফোয়ারা, পেছনে আম বাগান, এবং পূর্ব-দক্ষিণ কোণে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এবং একটি বিশাল দালান, সব মিলিয়ে এক অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। বাড়ির সামনে অবস্থিত পারিবারিক কবরস্থান জমিদার বংশের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।
বাড়ির দিকে যাওয়ার রাস্তা, পাশের শতবর্ষী মসজিদ এবং সামনের বিশাল পুকুর, সব মিলিয়ে জমিদারদের প্রভাব ও ঐশ্বর্যের ইঙ্গিত বহন করে। সবুজ খড়ে মোড়ানো কার্পেটের বিশাল উঠান, শতবর্ষী গাছ, এবং পারিবারিক কবরস্থান, সব মিলিয়ে এক অতীত যুগের চিত্রই ফুটে ওঠে। “নর্থ হাউস” নামের এই শতবর্ষী বাড়িটির লাল এবং সাদা রঙের মিশ্রণে চুনকাম করা দেয়াল ব্রিটিশ আমলের স্মৃতির বয়ে আনে যেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এই জমিদারের ব্রিটিশ আমলের মন্ত্রী হওয়ার তথ্য এই বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আরও বহুগুন বাড়িয়ে তোলে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সাথে সাথে এই বংশেরও সমাপ্তি ঘটে। তবে অন্যান্য জমিদার বাড়ির তুলনায় দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি এখনও ভালো অবস্থায় সংরক্ষিত আছে, একজন কেয়ারটেকারের তত্ত্বাবধানে।
দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি, টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত। ঢাকা থেকে বিভিন্ন উপায়ে সেখানে যাওয়া যায়:
বাস
ট্রেন
দেলদুয়ার পৌঁছে জমিদার বাড়ি যাওয়ার উপায়
দেলদুয়ার বাজার থেকে সিএনজি, অটোরিকশা বা রিকশাযোগে সহজেই জমিদার বাড়ি যাওয়া যায়। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করলে তারা “নর্থ হাউস” বলে চিনিয়ে দেবে।
দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি শুধু একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নয়, এটি একটি সময়ের সাক্ষী, যা আমাদের অতীতের সাথে সংযুক্ত করে রাখে। এই বাড়ি নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা এবং সংরক্ষণ এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে।
Leave a Comment