লুভ্যর মিউজিয়াম

জগৎ বিখ্যাত শিল্পকর্মের আঁধার লুভ্যর মিউজিয়াম (Louvre Museum) যা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘর গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ফ্রান্সের সবচেয়ে প্রাচীন ও ব্যস্ততম এই জাদুঘরটি দেশটির রাজধানী প্যারিস শহরে অবস্থিত। ফ্রান্সে বহু বিখ্যাত জাদুঘর রয়েছে, তবে লুভ্যর মিউজিয়ামের সাথে যে কোনো জাদুঘরের তুলনাই যেন অনেকটাই ভিত্তিহীন। আর এ কারণেই বোধয় এই জাদুঘরটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত জাদুঘর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়াও ফ্রান্সের সবচেয়ে শীর্ষ দর্শনীয় স্থানগুলোর তালিকায়ও লুভ্যর মিউজিয়াম বেশ উল্লেখযোগ্য একটি নাম। ষাট হাজার বর্গমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই জাদুঘরটি আজ বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রদর্শনীকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত। প্রাচীন সভ্যতার সেই শুরুর দিন থেকে আজকের আধুনিক সভ্যতার বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন গুলো রাখা হয়েছে এই জাদুঘরে। আর তাই তো জগৎ বিখ্যাত সব শিল্পকর্মের আঁধার বলা হয় এই জাদুঘরটিকে।

লুভ্যর জাদুঘরের সংগ্রহশালা গুলোকে মূলত আটটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি বিভাগেরই আলাদা আলাদা সুনির্ধারিত  নাম রয়েছে। যেমনঃ

  • নিয়ার ইস্টার্ন এনটিকুইটিস বিভাগ
  • ইট্রাস্কেন এনটিকুইটিস বিভাগ
  • ডেকোরেটিভ আর্ট বিভাগ
  • স্কালপচার বিভাগ
  • গ্রিক এনটিকুইটিস বিভাগ
  • ইজিপশিয়ান এনটিকুইটিস বিভাগ
  • রোমান এনটিকুইটিস বিভাগ
  • ইসলামিক আর্ট বিভাগ।

এগুলো প্রতিটি বিভাগই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। ফ্রান্সে ভ্রমণকারী প্রায় প্রতিটি পর্যটকই এই জাদুঘরটি পরিদর্শন করতে আসে। বিশেষ করে ইতিহাস প্রেমিকদের কাছে এটি এক আদর্শ জায়গা। লুভ্যর জাদুঘরে প্রদর্শনীয় শিল্পসামগ্রী গুলোর মধ্যে ইট্রাস্কেন , রোমান এনটিকুইটিস বিভাগ এবং গ্রিক এনটিকুইটিস বিভাগে প্রদর্শিত ভাস্কর্য গুলো বেশ উল্লেখযোগ্য। নিয়ার ইস্টার্ন বিভাগে তুলে ধরা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সেই মেসোপটোমীয় সভ্যতাকে। ইউফ্রেতিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে উঠা সেই প্রাচীন সভ্যতা যেন এখনো হাত-ছানি দিয়ে যায় নিয়ার ইস্টার্ন বিভাগে। আর ফরাসি রাজাদের জুয়েলারি, অলংকারসহ বেশ কিছু ব্যবহৃত পণ্য-সামগ্রীর দেখা মিলবে ডেকোরেটিভ আর্ট বিভাগে। এরকম নিয়ার ইস্টার্ন ও ডেকোরেটিভ আর্ট বিভাগের মতো প্রতিটি বিভাগেই দেখা মিলবে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রাচীন নিদর্শনের। আর তাই তো প্রতিটি বিভাগেরই নিজস্ব বিশেষ তাৎপর্য বিবেচনায় গোটা জাদুঘরটিই আজ সর্ব বিখ্যাত।

লুভ্যের প্রাচীন ইতিহাস

বিস্ময়কর এই জাদুঘরটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বেশ সুদীর্ঘ। জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার সেই ক্রান্তিলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এর বিভিন্ন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বেশ কয়েকবার। উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তস্বরূপ, জাদুঘরটির ঠিক সামনে কাছের তৈরী পিরামিড বসিয়ে নতুন এক রূপও দেওয়া হয়েছে জাদুঘরটির। কিন্তু তাই বলে জাদুঘরটির ইতিহাস কিন্তু একটুও বদলায় নি। ১২০২ সালে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাসের অধীনে সিন্ নদীর তীরে গড়ে উঠে এই প্রাচীন সভ্যতা। লুভ্যর মিউজিয়ামকে জাদুঘরে রূপান্তর করার আগে এটি রাজাদের বাস ভবন ও প্রদর্শনাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিলো। উদাহরণস্বরূপ, ১৫৪৬ খিষ্টাব্দের পর থেকে জাদুঘরটি ফ্রান্সের রাজা ১ম ফ্রসোঁয়ার রাজকীয় বাস ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রাসাদটিতে রাজবংশের বসবাসের পর ১৬৮২ সালে ফ্রান্সের রাজা ১৬শ লুই তার পূর্ববর্তী বাস ভবন  লুভ্যর প্রাসাদ ত্যাগ করে তার বাস ভবনকে ভেসাইয়ের প্রাসাদে রূপান্তর করে। আর লুভ্যর প্রাসাদকে রাজকীয় সংগ্রহশালার প্রদর্শনাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

যদিও তা ১৬৯২ সালের পর থেকে পরবর্তী ১০০ বছর পর্যন্ত প্রদর্শনাগার হিসেবে “Académie Royale de Peinture et de Sculpture” ও “Académie des Inscriptions et Belles-Lettres” -এর অধীনে ন্যস্ত ছিল। রাজকীয় এই প্রাসাদটিকে (বর্তমানে লুভ্যর মিউজিয়াম) “ফরাসি খোদাই লিপি ও শিল্প সমালোচনা আকাদেমি ” ও “ফরাসি চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্য আকাদেমি “প্রায় ১০০ বছর তাদের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে। তারপর সবশেষে ১৮শ শতাব্দীতে ফ্রান্সের সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রদর্শনাগারটিকে বিশাল এক জাদুঘরে রূপান্তর করার চিন্তাটা মাথায় আসে। আর সেই ধারাবাহিকতায় ১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে তথা ১৭৯৩ সালের ১০ ই আগস্ট জাদুঘরটি উদ্ভোধন করা হয়। শুরুর দিকে মাত্র ৫৩৭ টি শিল্পকর্ম নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই জাদুঘরটি। তবে পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন নিদর্শন ও শিল্পকর্মের সংযোজনের ফলে জাদুঘরটি আজ বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রদর্শনীকেন্দ্র। এই জাদুঘরে স্থান পাওয়া শিল্পীকর্ম গুলোর বেশির ভাগই বেশ পুরনো। এই জাদুঘরে রয়েছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অঙ্কিত জগৎ বিখ্যাত সেই চিত্রকর্ম “মোনালিসা”। এছাড়াও আরো বহু চোখ ধাঁধালো সব চমৎকার নিদর্শনের প্রাণকেন্দ্র এই লুভ্যর মিউজিয়াম।

১৭৯৬ সাল থেকে ১৮০১ সাল পর্যন্ত ভবনের কাঠামোগত সমস্যার কারণে বন্ধ রাখা হয়েছিল এই জাদুঘরটিকে। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের শাসনামলে জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ করণের লক্ষ্যে এর সংগ্রহশালা গুলোকে সংস্করণ করা হয়। সে সময় জাদুঘরটির নাম Musée du Louvre থেকে পরিবর্তন  করে Musée Napoléon রাখা হয়েছিল। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সময় জাদুঘরটি দিন কে দিন সম্মুখ অগ্রগতির দিকে ধাবিত হলেও তার মৃত্যুর পর উন্নয়নের অগ্রগতির ধারা ব্যাহত হয়। সে সময় জাদুঘর থেকে বেশ কিছু শিল্পকর্ম প্রকৃত মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফলস্বরূপ জাদুঘরটির ব্যাপক ক্ষতি সাধন ঘটে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মৃত্যুর পর। যদিও পরবর্তীতে নতুন করে আরো ২০ হাজার শিল্পকর্ম যোগ করা হয় জাদুঘরটিতে। আর এ কারণেই জাদুঘরটি সেকেন্ড ফ্রেঞ্চ এম্পায়ার, অষ্টাদশ লুইস ও দশম চার্লসের সময় সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করে। আর এরই ধারাবাহিকতায় ঐশ্বর্যমন্ডিত এক সর্বোচ্চ প্রদর্শনী কেন্দ্রে পরিণত হয় জগৎ বিখ্যাত লুভ্যর মিউজিয়াম।

লেখকঃ তানভীর রহমান সাইম
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ franceLouvreMuseumparis