লাক্ষাদ্বীপ (Lakshadweep) ভারতের পশ্চিম দিকে কেরালার মালাবার উপকুল থেকে প্রায় ৩২৪ কিলোমিটার দূরত্বে ৩৬ টি ছোট ছোট প্রবাল দ্বীপ নিয়ে অবস্থিত যা অনেকের কাছে ‘লিটল মালদ্বীপ’ বা ক্ষুদ্র মালদ্বীপ নামেও পরিচিত। লাক্ষা, আমিনদিভি ও মিনিকয় দ্বীপপুঞ্জের সরকারি নাম রাখা হয়েছে লাক্ষাদ্বীপ যার মোট আয়তন ৩২ বর্গকিলোমিটার মাত্র। লাক্ষাদ্বীপ ভারতের সব চাইতে ক্ষুদ্র ইউনিয়ন টেরিটরী যার মধ্যে ২৭ টি দ্বীপ মোটামুটি বড় আকারের। এই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড়ো দ্বীপ হল মিনিকয় দ্বীপ যার আয়তন ৪.৫০ বর্গ কিমি। এছাড়াও ১২ টি রিং দ্বীপ (এটল), ৩ টি প্রবাল প্রাচীর এবং অসংখ্য প্রবাল টিলা আছে। প্রধান ৩৬ টি দ্বীপের মধ্যে জনবসতি আছে ১০ টি দ্বীপে। বাকী দ্বীপগুলোতে ঈদানীং কিছু হোটেল, রিসর্ট এবং টুরিস্ট ক্যাম্প গড়ে তুলেছে ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম কর্পোরেশন এবং প্রাইভেট পর্যটন কোম্পানী।
লাক্ষাদ্বীপের দক্ষিনে স্বাধীন দ্বীপ রাস্ট্র মালদ্বীপ। লাক্ষা দ্বীপের রাজধানীর নাম কাভারাট্টি বা কাভারাত্তি এবং একটি মাত্র এয়ারপোর্টের নাম আগাট্টি (আগাট্টি একটি দ্বীপেরও নাম)। আয়তন ৩২ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা কমবেশি ৬১ হাজার। শিক্ষিতের হার শতকরা ৯০ ভাগ! ভাষা-মালায়লাম, হিন্দী এবং ইংরেজী। নৃতাত্তিক দিক থেকে এখানকার অধিবাসীরা কেরালার সমজাতীয়।
দেশী বিদেশী ট্যুরিস্টদের কল্যাণে লাক্ষা দীপপুঞ্জের মোটামুটি সবাই ইংলিশে কথা বলতে পারে। আবহাওয়া নর্মালী ঠান্ডা। তবে মে-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কিছুটা গরম আবহাওয়া। এই দ্বীপ পুঞ্জের কয়েকটি দ্বীপ মুসলিম বসতি প্রধান এলাকা। এখানে অনেক মসজিদ আছে। শুধু মাত্র কভরট্টিতেই ৫২ টি মসজিদ আছে। সব চাইতে বড় মসজিদের নাম আজ্জারী মসজিদ। জন সংখ্যা অনুপাতে পৃথিবীর আর কোথাও এত বেশী মসজিদ আছে কিনা জানা নেই।
লাক্ষাদ্বীপের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল, নীল সমুদ্র আর সমুদ্রতট। তবে পর্যটকদের আনাগোনা এখানে কোরাল রিফকে কেন্দ্র করেও হয়ে থাকে। স্বচ্ছ জলের সমুদ্র আর নৈসর্গিক প্রকৃতি পর্যটকদের আকর্ষণ করে এই দ্বীপে।
লাক্ষাদ্বীপের গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার এই আগাত্তি। লাক্ষাদ্বীপের এক্কমাত্র বিমানবন্দরটাও এখানে অবস্থিত হোয়ায় এই দ্বীপের গুরুত্ব এমনেই অনেকাংশে বেশী। বিশ্বের অন্যতম সুন্দর লেগুনগুলোর মধ্যে একটি হল এই আগাত্তি। এখানকার সুন্দর সমুদ্র সৈকত আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। এখানে সুইমিং, স্নরকেলিং, কায়াকিংয়ের মতো ওয়াটার স্পোর্টস করার সুযোগ রয়েছে। আগাত্তি থেকে কাভারত্তি দ্বীপ যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টার সার্ভিসও পাওয়া যায়।
তবে ইচ্ছে হলেই আগাতি দ্বীপ ঘুরে বেড়ানো যায় না। এর জন্য নির্দিষ্ট অনুমতি নিয়ে নিতে হয়। স্থানীয় প্রশাসনের নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ মেনে দ্বীপটি দেখার অনুমতি দেওয়া হয়। দ্বীপে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে লাক্ষাদ্বীপ প্রশাসনের কাছ থেকে প্রবেশের অনুমতি নিতে হবে। তবে জেনে রাখা ভালো যে, আগাতি দ্বীপে প্রবেশের জন্য কোনও ফি নেই।
স্বচ্ছ্ব নীল জলের সঙ্গে নীল আকাশ মিলে যে দীগন্ত তৈরি করে তা লাক্ষাদ্বীপের প্রকৃতির আলাদা সম্পদ। মালদ্বীপের থেকে কোনও অংশে কম নয় কালপেনি দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জেও আপনি সুইমিং, স্নরকেলিং ইত্যাদি ওয়াটার স্পোর্টস করতে পারবেন।
লাক্ষাদ্বীপের কদমত দ্বীপটি সাধারণত এলাচ দ্বীপ নামে পরিচিত। এর দৈর্ঘ্য মাত্র ৯.৩ কিলোমিটার। দ্বীপের একমাত্র জনবসতিপূর্ণ গ্রাম হল কদমত। পর্যটকরা এখানে মাঝে মধ্যেই ভিড় জমান। দ্বীপের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি হল মাছ ধরা। আপনি এখানে এসে ঘোরাঘুরি করার পাশাপাশি গ্রামের মানুষের সঙ্গে দেদার আড্ডা দিতে পারেন। শুধু তাই নয়, এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল কায়াকিং, স্নরকেলিং এবং স্কুবা ডাইভিং।
অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জ থেকে মিনিকয় একটু দূরে। বলা যায় মূল অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন এই মিনিকয় দ্বীপপুঞ্জ। উত্তর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মিনিকয়। এটাও লাক্ষাদ্বীপের অন্যতম বড় লেগুন। এখানে ১১টি গ্রামের ক্লাস্টার রয়েছে যা আভাহ নামে পরিচিত। লোকালয় এবং ভিড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আলাদাভাবে নিজের সঙ্গে নিজের সময় কাটাতে চাইলে মিনিকয় একটি আদর্শ জায়গা।
মিনিকয়ের ১০০ ভাগ অধিবাসী শিক্ষিত। তাদের ভাষার নাম “মহল”। আরবী ভাষার সাথে মহল ভাষার ৮০% সামঞ্জস্য। মুলত আরবী ভাষা থেকেই হিন্দীর সাথে মিশ্রন ঘটে মহল ভাষার সৃস্টি হয়েছে। মিনিকয় দ্বীপটি যদিও ইন্ডিয়ান অধিভুক্ত, কিন্তু দ্বীপটি মালদ্বীপের খুব নিকটে।
লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসনিক কার্যালয় রয়েছে কাভারাত্তিতে। এই সুন্দর লেগুনটি পর্যটকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এখানকার স্থানীয় বাজার থেকে শুরু করে মসজিদ দর্শনীয় স্থান। মারিন অ্যাকোরিয়াম, উজরা মসজিদ ইত্যাদি ঘুরে দেখতে পারেন এখানে।
অশ্রুবিন্দুপর আকৃতির বাঙ্গারাম দ্বীপপুঞ্জ পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আগাত্তির খুব কাছেই অবস্থিত এই বাঙ্গারাম দ্বীপ। এটা লাক্ষাদ্বীপের একমাত্র দ্বীপ যেখানে কোনও জনবসতি নেই। ফসফোরেসেন্ট প্লাঙ্কটনের জন্য বাঙ্গারাম দ্বীপ আসেন পর্যটকেরা। অর্থাৎ, এই সমুদ্র সৈকত রাতে নীলাভ হয়ে ওঠে প্রবাল বালির কারণে। এশিয়ান ডলফিন, ফ্রগফিশ, অক্টোপাস দেখতে হলে সেরা জায়গা হল বাঙ্গারাম দ্বীপ। লাক্ষাদ্বীপ বেড়াতে হলে এই জায়গা ভুলেও মিস করা যাবে না।
সমুদ্রপথে
সমুদ্রপথে লাক্ষাদ্বীপ যেতে চাইলে প্রথমে আপনাকে কেরালার রাজধানী কোচি বন্দরে যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে লাক্ষাদ্বীপ যাওয়ার জন্য আপনি একাধিক জাহাজ পেয়ে যাবেন। কোচি থেকে লাক্ষাদ্বীপ যেতে ১৫ থেকে ২০ ঘন্টার মতো সময় লাগে।
আকাশ পথে
আকাশপথে লাক্ষাদ্বীপে যেতে চাইলে আপনাকে আগাতি বিমানবন্দরে নামতে হবে। এছাড়া, আপনি আচিলে কোচি বিমানবন্দরেও নামতে পারেন। সেখান থেকে সামুদ্রিক জাহাজের সাহায্যে আপনি যেতে পারেন লাক্ষাদ্বীপে। কেরালার রাজধানী কোচি থেকে বিমান ভাড়া জন প্রতি আসা যাওয়া ৮৪০০ ইন্ডিয়ান রুপী। কোচির বিমানবন্দর থেকে লাক্ষাদ্বীপের আগাট্টি বিমানবন্দরে সপ্তাহে ৬টি ফ্লাইট চলে এয়ার ইন্ডিয়ার।
লাক্ষাদ্বীপে যেতে হলে আপনার পকেটে জনপ্রতি কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা রাখতে হবে। তবে এর চেয়ে কম বাজেটেও লাক্ষাদ্বীপ ঘুরে আসা যায়, সেক্ষেত্রে ঘোরার দিন সংখ্যা কমানো দরকার। লাক্ষাদ্বীপ ঘোরার বাজেট সম্পূর্ণটাই নির্ভর করে পর্যটক কতদিন ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন, কী ধরনের ভ্রমণ প্যাকেজ নিতে চান এবং সেখানে গিয়ে কী কী অ্যাডভেঞ্চারমূলক কার্যকলাপ করতে চান উপর নির্ভর করে।
লাক্ষাদ্বীপে বহু কটেজ রয়েছে থাকার জন্য। কাভারেত্তি, কালপেনি, কাদমাত , বাঙ্গারাম ইত্যাদি দ্বীপে একাধিক হোটেল, রিসোর্ট এবং হোমস্টে রয়েছে থাকার জন্য। সঙ্গে রয়েছে সরকারি লজও। আগাট্টিতে সরকারি গেস্ট হাউসের ফোন নম্বর – ০৪৮৯৪ ২৪২ ৯৩৩
লাক্ষা দ্বীপে জন প্রতি মিডিয়াম স্টান্ডার্ড হোটেল/রেস্ট হাউজ ভাড়া এবং খাওয়া দৈনিক ৫০/৫৫ ডলার সমমানের পড়বে।
যার যেমন অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে থাকা খাওয়ার সর্বোচ্চ সুবিধাদি বিদ্যমান এই দ্বীপে। এখানে কমন রান্নাগুলো সাউথ ইন্ডিয়ানদের মতই। নারিকেলের তেলে রান্না হয়। প্রচুর পরিমান নারিকেল উৎপন্ন হয় বলে এখানে নারিকেল আশ থেকে তৈরীর বেশকিছু শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এছারাও সুপারী এবং কলা জন্মে প্রাকৃতিক ভাবেই। তবে বর্তমানে কলার চাষ হচ্ছে আধুনিক কৃষি উৎপাদন পদ্ধতিতে। এখানে উন্নত মানের প্রচুর কলা উতপন্ন হয় যা বিদেশে রপ্তানী করা হয়। কারো বাড়ীতে গেলে অবশ্যই অন্যান্য খাবারের সাথে ডাবের পানি, ডাবের শাশ এবং কলা খেতে দেবেই। এখানকার বেশীর ভাগ মানুষেরই পেশা কৃষি ও মাছ শিকার এবং সেই সব পন্য রপ্তানী। সামুদ্রীক মাছ এখানে খুব সস্তা। ফলের মধ্যে তরমুজ পাওয়া যায় সারা বছর। তবে এখানকার তরমুজের সাথে আমাদের দেশীয় বহুল পরিচিত তরমুজের অনেক পার্থক্য। আমাদের দেশীয় বিশাল সাইজের তরমুজ বাহির দিক সবুজ-সাদা মিক্সড কালার, ভিতরে লাল। কিন্তু লাক্ষা দীপের তরমুজ সাইজে খুব ছোট ছোট এবং গোলাকার। বিচিহীন তরমুজের বাহিরের রঙ ঘন সবুজ আর ভিতরের রঙ পিংক। খেতে খুব মিস্টি।
তবে লাক্ষাদ্বীপ বেড়াতে যাওযার জন্য কোচি থেকে ট্যুরিজিম পারমিট লাগবে। না হলে দ্বীপে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ভারতীয়দের লাক্ষাদ্বীপের ৩৬ টি দ্বীপে বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে সেই অনুমতি বিদেশীদের নেই। বিদেশীরা কেবলমাত্র এই দ্বীপপুঞ্জের ৩ টি দ্বীপেই ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি পান।
Leave a Comment