আইফেল টাওয়ার (Eiffel Tower) পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিস্ময়কর এই স্থাপনাটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে অবস্থিত। WTO (World Tourism Organization) – এর বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র ফ্রান্স। আর ফ্রান্স এই সর্বোচ্চ পর্যটন নগরীতে পরিণতি হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুতপূর্ণ অবদান রেখেছে যেই স্থাপনাটি তা হলো আইফেল টাওয়ার। কেননা প্রতিবছর প্রায় ৭ মিলিয়নের ও বেশি পর্যটক আইফেল টাওয়ার দেখতে প্যারিসে ভ্রমণ করে। প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু এই স্থাপনাটি সত্যিই ভালো লাগার মতো। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে মধ্য রাত্রি পর্যন্ত এই টাওয়ারটি প্রতি ঘন্টায় ৫ মিনিটের জন্য একবার করে আলোক-সজ্জায় ঝলমল করে উঠে। রাতের আঁধারে আলোক ঝলমলে এই টাওয়ারটির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবে যে কেউ। অসম্ভব চমকপ্রদ এই টাওয়ারটি নিয়ে লেখা হয়েছে নানান ভ্রমণ গল্প, রচিত হয়েছে অসংখ্য ছন্দ ও কবিতা। তাছাড়াও এই আইফেল টাওয়ার নিয়ে লেখালেখি করেছেন স্বনামধন্য বহু কবি-সাহিত্যিক, অনেকেই আবার প্রকাশ করেছেন তাদের আবেগ-ঘন অনুভূতির কথা। সব মিলিয়ে আইফেল টাওয়ার সত্যিই বিস্ময়কর একটি স্থাপনা। ১৯৯১ সালে আইফেল টাওয়ার বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহ্যপূর্ণ শীর্ষ স্থাপনা হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। সুউচ্চ বিশাল আকৃতির এই টাওয়ারটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ফরাসি বিপ্লবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত ফরাসি বিপ্লবকে কেন্দ্র করেই এই টাওয়ারটির উত্থান। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলার উদ্দেশ্যেই নির্মাণ করা হয়েছিল আইফেল টাওয়ারটি। এই টাওয়ারটির সাথে জড়িত আছে শত বছরের ইতিহাস , লুকিয়ে আছে হাজারো স্মৃতি।
আইফেল টাওয়ারের আরেক নাম “ট্যুর আইফেল”। ফরাসি ভাষায় এই টাওয়ারটিকে ট্যুর আইফেল নাম অভিহিত করা হয়েছে। তাছাড়াও ফ্রান্সের মানুষের কাছে এই টাওয়ারটি মূলত ট্যুর আইফেল নামেই ব্যাপক পরিচিত। বিশাল আকৃতির সুউচ্চ এই টাওয়ারটির নির্মাতা গুস্তাভো আইফেল। তিনিই এই টাওয়ারটির নকশা নির্মাণ করেন। গুস্তাভো আইফেল পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। রেল সেতুর নকশা নির্মাণ করাই ছিল তার প্রধান পেশা। গুস্তাভো আইফেল এই টাওয়ারটির ছাড়াও “স্ট্যাচু অব লিবার্টি” এর নির্মাণ পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নকারী। একসময় আইফেল টাওয়ার ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পরিকাঠামো। কিন্তু পরবর্তীতে ক্রাইসলার ভবনটি নির্মাণের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের (তৎকালীন) সবচেয়ে উঁচু স্থাপনার তালিকায় আইফেল টাওয়ারের পরিসমাপ্তি ঘটে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপনার তালিকায় জায়গা করে নেয় ক্রাইসলার ভবনটি। তবে তাই বলে কিন্তু আইফেল টাওয়ারের জনপ্রিয়তা কোনো অংশেই কমে যায় নি। কেননা প্রতিটি প্রাচীন নিদর্শনেরই রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র, রয়েছে কিছু নিজস্ব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও। ১৯৩০ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ক্রাইসলার ভবনটি নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ আইফেল টাওয়ারই ছিল পৃথিবীর একমাত্র সুউচ্চ পরিকাঠামো।
কথিত আছে, আইফেল টাওয়ার নির্মাণে ১৮,০৩৮ টি ধাতব খন্ডকে একত্রে সংযুক্ত করণের জন্য ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২ কোটি ৫০ লক্ষ নাট ব্যবহৃত হয়েছিল। আর এই কাজে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ৩০০ জন দক্ষ কর্মীকে। বিশাল আকৃতির এই টাওয়ারটি সম্পূর্ণ নির্মাণ করতে মোট সময় লেগেছিল ২ বছর ২ মাস ৫ দিন। অনেকেই বলে থাকেন আইফেল টাওয়ারের মোট উচ্চতা ৩২৪ মিটার। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন , আসলে মূল আইফেল টাওয়ারটির উচ্চতা ৩০০ মিটার আর বাকি চার মিটার হচ্ছে আইফেল টাওয়ারের উপর নির্মিত এন্টেনার উচ্চতা। অর্থাৎ ৩০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট আইফেল টাওয়ারের উপর রয়েছে ৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট একটি এন্টেনা। আর এই এন্টিনাসহ টাওয়ারটির মোট উচ্চতাকেই মূলত সবাই (বেশিরভাগ লোকজন) আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এছাড়া টাওয়ারটিকে আলোক-সজ্জায় চমৎকার ভাবে উপস্থাপনের জন্য টাওয়ারটিতে ৩৩৬ টি প্রজেক্টর সহ ২০,০০০ টি বাতি সংযুক্ত করা হয়েছে। আর রাতের আঁধারে সু-সজ্জিত এই বাতি গুলোর দীপ্তমান আলোর কারণেই টাওয়ারটির এত জনপ্রিয়। আইফেল টাওয়ার নির্মাণে ব্যবহৃত ধাতব কাঠামো সমূহের ওজন ৭,৩০০ টন , আর অন্যান্য সব মিলিয়ে টাওয়ারটির মোট ওজন ১০,১০০ টন। প্রতি ৭ বছর পর পর এই টাওয়ারটিকে একবার করে রং করা হয়। সম্পূর্ণ এই টাওয়ারটি রং করতে প্রতিবার ৬০ টন রঙের প্রয়োজন হয়। রং করা সহ টাওয়ারটির সংস্করণ মূলক বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কাজেই কর্তৃপক্ষকে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। ফ্রান্স ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯ টিরও বেশি প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে এই টাওয়ারটির। তবে এই প্রতিকৃতি গুলোর মধ্যে নেভাদা , মেক্সিকো ও শেনঝেনে স্থাপিত প্রতিকৃতি গুলো সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। তবে আসল আইফেল টাওয়ারের সাথে কিন্তু এগুলোর কোনোটিরই তুলনা চলে না। মূল আইফেল টাওয়ারটিতে মোট ১২০ টি তরঙ্গায়িত এন্টেনার উপস্থিতি রয়েছে। তাছাড়াও বিশাল আকৃতির চমকপ্রদ এই স্থাপনাটি তৈরী করতে প্রায় ৭,৮০০,০০০ গোল্ড ফ্রাঙ্কস ব্যয় হয়েছিল।
এই টাওয়ারটি কখনো কখনো প্রকৃত উচ্চতার চেয়েও আরো বেশি লম্বা দেখায়। এই ঘটনাটি ঘটে মূলত লোহার দৈর্ঘ্য সম্প্রসারণের ফলে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে , কোনো কঠিন পদার্থকে তাপ প্রদান করা হলে তা আয়তনে বৃদ্ধি পায়। আর ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটে আইফেল টাওয়ারের ক্ষেত্রে। তবে তা কিভাবে ? চলুন জেনে নিই – গ্রীষ্মকালে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে টাওয়ারটির ধাতব কাঠামো সমূহের ধাতব সম্প্রসারণ ঘটে। অর্থাৎ টাওয়ারটিতে ব্যবহৃত লোহার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। আর এই কারণেই টাওয়ারটিকে কখনো কখনো প্রকৃত উচ্চতার চেয়েও কিছুটা বেশি উঁচু মনে হয়। এছাড়াও টাওয়ারটি মাঝে মাঝে সূর্যের তাপে লৌহ সম্প্রসারণের কারণে কিছুটা হেলে পড়ে। ফলে আইফেল টাওয়ার কখনো কখনো আবার বিদীর্ণ রূপও ধারণ করে বটে।
টাওয়ারটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই সহজ। তবে পর্যটন মৌসুম গুলোতে ট্রাফিক জ্যামের কারণে সেখানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কিছুটা বিরক্তি অনুভূত হতে পারে। কেননা ফ্রান্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে বেশির ভাগই প্যারিসে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে অনেক পর্যটক ভীড় জমায়। আর এ কারণেই পর্যটন মৌসুমে অন্যান্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি ট্রাফিক জ্যাম লক্ষ্য করা যায় এই শহরে। তাই বিশেষ করে পর্যটন মৌসুমে প্যারিস ভ্রমণের উদ্দেশ্য থাকলে কিছুটা বেশি সময় বিবেচনা করে ট্যুর প্ল্যান তৈরী করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আইফেল টাওয়ারের সবচেয়ে নিকটবর্তী স্টেশনের নাম ” দ্য চ্যাম্প্ ডি মার্শ ট্যূর আইফেল মেট্রো স্টেশন্ “। আইফেল টাওয়ার থেকে এই স্টেশনে হেঁটে যেতে সময় লাগে ১৫-২০ মিনিটের মত।
আইফেল টাওয়ার সম্পর্কে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
আইফেল টাওয়ার কখনো বন্ধ থাকে না। বছরের পুরো সময় জুড়েই মুখরিত থাকে আইফেল টাওয়ার নগরী। তবে আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নির্দেশনা ও নির্দিষ্ট সময়সূচী রয়েছে। নিম্নরূপ তা সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো –
নির্দেশনাঃ
আইফেল টাওয়ারে আলোকসজ্জা প্রদর্শনের সময় বিনা অনুমতিতে ছবি ধারণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
আইফেল টাওয়ারের টিকেট দুটি উপায়ে সংগ্রহ করা যায়। প্রথম পদ্ধতিটি হলো সরাসরি আইফেল টাওয়ার থেকে টিকেট সংগ্রহ করা। অন্যথায় দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো অনলাইনের মাধ্যমে আইফেল টাওয়ারের টিকেট সংগ্রহ করা। মূলত এই দুটি পদ্ধতিই আইফেল টাওয়ারের টিকেট সংগ্রহ করণের বর্তমান কার্যকর উপায়। আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের জন্য কোনো নির্ধারিত ধার্যমূল্য নেই। বরং আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় টিকেটের ধার্যমূল্য নির্ধারিত হয় পরিদর্শনকারীর বয়সের হিসাব অনুযায়ী। তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় হচ্ছে চার বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের ক্ষেত্রে কোনো প্রবেশমূল্য পরিশোধ করতে হয় না। নিচে কিছু টিকেটের ধার্যমূল্য উল্লেখ করা হলো –
সিঁড়ির সাহায্যে আইফেল টাওয়ারের নিচ তলা থেকে দ্বিতীয় তলায় উড্ডয়নের ক্ষেত্রে :
লিফটের সাহায্যে আইফেল টাওয়ারের নিচ তলা থেকে দ্বিতীয় তলায় উড্ডয়নের ক্ষেত্রে :
লিফটের সাহায্যে আইফেল টাওয়ারের নিচ তলা থেকে সর্বোচ্চ তলায় উড্ডয়নের ক্ষেত্রে :
অনলাইনে টিকেট সংগ্রহ করতে: https://www.toureiffel.paris/fr
বিঃদ্রঃ বয়সভেদে টিকেটের এই ধার্যমূল্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দেশনা অনুযায়ী যেকোনো সময় পরিবর্তীত হতে পারে।
আসলে বছরের পুরো সময় জুড়েই আইফেল টাওয়ার পরিদর্শন করতে আসে বহু পর্যটক। ভোরের আলো ফুটার পর থেকে দিনের পুরোটা সময় জুড়েই যেন পর্যটকদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো রূপ নেয় এই আইফেল টাওয়ার নগরীতে। তবে আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের সবচেয়ে সেরা সময় হচ্ছে কৃস্টমাস-ডে উপলক্ষ্য ছুটির দিন গুলো। কৃস্টমাস-ডে ছাড়াও শরৎকাল ও বসন্তকালকেও আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর তাই সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী এই সময়টাতেই ভীড় জমায় আইফেল টাওয়ার দেখতে। আসলে রোমান্টিক এই শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থাপনাটির সৌন্দর্য লিখে কিংবা বলে বোঝানো কোনোভাবেই সম্ভব নয় , প্রকৃত এই সৌন্দর্যকে সত্যিকার অর্থে জানার ইচ্ছে থাকলে একবার যেতে হবে একবার যেতে হবে সেই স্বপ্নের নগরীতে। আর তাই তো বছরের পুরোটা সময় জুড়েই অসংখ্য ভ্রমণ পিপাসু দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে আইফেল টাওয়ার নগরী।
লেখকঃ তানভীর রহমান সাইম
Leave a Comment