তুরস্কের ক্যাপাডোসিয়া (Cappadocia) একটি ঐতিহাসিক স্থান যা তুরস্কের কেন্দ্রিয় এনাটোলিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। ক্যাপাডোসিয়া তার বিস্ময়কর ভূখণ্ড, গুহা বসতি, এবং হট এয়ার বেলুন সাফারির জন্য পর্যটকদের কাছে বিখ্যাত। এর প্রাচীন সভ্যতা ও অপূর্ব প্রাকৃতিক গঠন সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে। ফরাসি ভাষায় “কাপ্পাডোসিয়া” শব্দের অর্থ হল “সুন্দর অশ্বের ভূমি”, তবে বাস্তবে বর্তমান সময়ে এখানে খুব বেশি ঘোড়ার দেখা মিলবে না।
বিশ্বে এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে আপনি একটি গুহার মধ্যে নিশ্চিন্তে রাত্রিতে নিদ্রাযাপন করতে পারেন এবং তুরস্কের কাপ্পাদশিয়া হলো এগুলির মধ্যে অন্যতম। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় হল একটি হট এয়্যার বেলুনে চড়ে উপভোগ করা। হট-এয়্যার বেলুন রাইড ছাড়াও, অন্যান্য এক্টিভিটির মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক গুহা গির্জা পরিদর্শন, উপত্যকায় হাইকিং এবং সঙ্গীতানুষ্ঠান উপভোগ করা। কাপ্পাদশিয়ার ফেয়্যারী (পরী) চিমনিগুলি মানুষের দ্বারা নির্মিত এক অন্যতম আশ্চর্য বিস্ময়। এই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসীরা বিশ্বাস করতেন যে, পরীরা মাটির নীচে বসবাস করে। এই কারণেই, অনন্য উপত্যকা ও অস্বাভাবিক শিলা গঠনগুলি ফেয়্যারী চিমনি বা ধূম্র পরী নামে পরিচিত। এই পরিকাঠামোগুলি ৪০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতার হতে পারে এবং এগুলি আকৃতিতে শঙ্কুর ন্যায়। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো (ইউ.এন.ই.এস.সি.ও), জেরোম জাতীয় উদ্যানের সঙ্গ বরাবর কাপ্পাদশিয়ার এই প্রস্তরময় স্থানটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ঘোষণা করেন।
ক্যাপাডোসিয়া এর দর্শনীয় স্থানগুলো
ক্যাপাডোসিয়ার ভূখণ্ডের বৈশিষ্ট্য হল তার অদ্ভুত ও আকর্ষনীয় রক ফরমেশন। এই অঞ্চলটি হাজার হাজার বছর ধরে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং বায়ুক্ষয়ের ফলে গঠিত হয়েছে। এখানকার বিখ্যাত এবং উল্লেখযোগ্য জিনিসগুলো হলো –
- ফেয়ারি চিমনিস: উঁচু, সরু পাথরের স্তম্ভ। পূর্ববর্তী খ্রীস্টানদের জন্য একটি লুকানোর জায়গা ছিল, যারা রোমানদের নিপীড়ন এবং পরবর্তীকালে মুসলিমদের লুন্ঠন-উপদ্রব থেকে পালিয়ে এখানে লুকিয়ে থাকতো।
- গুহা বসতি: প্রাচীনকালে স্থানীয় জনগণ পাথরের মধ্যে বসতি স্থাপন করেছিল।
- আন্ডার গ্রাউন্ড সিটি: ক্যাপাডোসিয়ার ভূগর্ভস্থ শহরগুলো, যেমন ডেরিঙ্কুয়ু (Derinkuyu) এবং কাইমাকলি (Kaymaklı), যেখানে মানুষ শত্রুদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বসবাস করত।
- যেহেতু এই অঞ্চলটি প্রধান আঙুর উৎপাদিত এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম, তাই কাপ্পাদশিয়ায় অনেক আঙুরের ক্ষেত ও ওয়াইনারী (মদ্য নির্মাণের কারখানা) রয়েছে।
- ক্যাপাডোসিয়া খ্রিস্টান ধর্মের প্রাথমিক যুগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এখানে অসংখ্য গির্জা এবং মঠ রয়েছে, যা পাথরের মধ্যে খোদাই করা হয়েছে।
- গোরেম জাতীয় উদ্যান: এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং বিখ্যাত পাথর কাটা গির্জার জন্য পরিচিত।
- ইহতি গুহা চিত্র: গুহার দেয়ালে মধ্যযুগের ধর্মীয় চিত্রকর্ম দেখা যায়।
- উচহিসার ক্যাসল: একটি পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত প্রাকৃতিক দুর্গ।
- পাসাবাগ (Pasabag) এবং ডেভরেন্ট ভ্যালি: রক ফরমেশনের জন্য বিখ্যাত।
- অভানোস (Avanos): মৃৎশিল্প এবং কাচের কাজের জন্য পরিচিত একটি শহর।
হট এয়ার বেলুন সাফারি
ক্যাপাডোসিয়া হট এয়ার বেলুন রাইডের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। সকালে সূর্যোদয়ের সময় রঙিন বেলুনে উড়ে পুরো অঞ্চলটির সৌন্দর্য উপভোগ করা একটি অভিজ্ঞতা, যা পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এ সময় পুরো এলাকায় অসংখ্য বেলুনের দেখা মিলে।
কাপ্পাদশিয়া ভ্রমণের সেরা সময়
- ক্যাপাডোসিয়া ভ্রমণের জন্য বসন্ত (এপ্রিল-জুন) এবং শরৎ (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) আদর্শ। এ সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং পর্যটকদের ভিড়ও তুলনামূলকভাবে কম।
- জুলাই ও সেপ্টেম্বর বাস্তবিকভাবে গরম ও সেইসঙ্গে ব্যস্তময় থাকে এবং প্রধান পর্যটন স্থলগুলি জনাকীর্ণ এবং ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে।
- ডিসেম্বর থেকে মার্চের গোড়ার দিকে কাপ্পাদশিয়ায় শীতকাল থাকে। তাই শীতের মৌসুমে ভ্রমণে গেলে অবশ্যই স্কিং অন্তর্ভূক্ত করুন, কারণ এই সময় মাউন্ট এরসিয়েস এর স্কি ঢালগুলি এই কার্যক্রমের জন্য আদর্শ থাকে।
ক্যাপাডোসিয়া যাওয়ার উপায়
ক্যাপাডোসিয়া তুরস্কের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি ইস্তানবুল বা তুরস্কের অন্যান্য প্রধান শহর থেকে ক্যাপাডোসিয়ার বিভিন্ন স্থান, যেমন নেভশেহির, গোরেমে, উরগুপ, বা কায়সেরি পৌঁছাতে পারেন। নিচে ক্যাপাডোসিয়া যাওয়ার প্রধান উপায়গুলো উল্লেখ করা হলো:
বিমানে যেতে চাইলে
সবচেয়ে দ্রুত এবং আরামদায়ক উপায় হলো বিমান মাধ্যম।
- নেভশেহির-কাপাডোকিয়া বিমানবন্দর (NAV): ক্যাপাডোসিয়ার নিকটবর্তী বিমানবন্দর, প্রায় ৩০ কিমি দূরে।
- কায়সেরি এরকিলেট বিমানবন্দর (ASR): আরও বড় বিমানবন্দর, প্রায় ৭০ কিমি দূরে।
ইস্তানবুল থেকে ফ্লাইট
- ইস্তানবুলের ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট (IST) বা সাবিহা গকচেন এয়ারপোর্ট (SAW) থেকে সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে।
- ফ্লাইটের সময়কাল: প্রায় ১.৫ ঘণ্টা।
- টিকিটের খরচ: ১,০০০-২,০০০ তুর্কি লিরা (বুকিংয়ের সময় ও সিজনের উপর নির্ভর করে)।
বিমানবন্দর থেকে ক্যাপাডোসিয়া স্থানান্তর
- শাটল বাস: ৫০-১০০ তুর্কি লিরা।
- ট্যাক্সি বা প্রাইভেট ট্রান্সফার: ৩০০-৫০০ তুর্কি লিরা।
বাসে যেতে চাইলে
খরচ-বান্ধব এবং দর্শনীয় ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম হলো বাস।
ইস্তানবুল থেকে সরাসরি বাস
- বিভিন্ন বাস কোম্পানি (Metro, Nevşehir Seyahat, Kamil Koç) ইস্তানবুল থেকে ক্যাপাডোসিয়ার (গোরেমে বা নেভশেহির) জন্য পরিষেবা দেয়।
- সময়কাল: প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা।
- টিকিটের মূল্য: ৩০০-৪৫০ তুর্কি লিরা।
- বাসগুলিতে আরামদায়ক আসন, ওয়াইফাই, এবং রিফ্রেশমেন্ট সেবা থাকে।
অন্যান্য শহর থেকে বাস
- আঙ্কারা থেকে: প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা।
- ইজমির থেকে: প্রায় ১১-১২ ঘণ্টা।
ট্রেন ও বাস সংমিশ্রণ
ক্যাপাডোসিয়ার নিকটবর্তী বড় শহর কায়সেরি পর্যন্ত ট্রেনে পৌঁছে সেখান থেকে বাস বা ট্যাক্সিতে গোরেমে বা উরগুপ যেতে পারেন।
ট্রেন স্টেশন
- ইস্তানবুল বা আঙ্কারা থেকে কায়সেরি পর্যন্ত ট্রেন।
- সময়কাল: প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা।
- খরচ: ট্রেনের ক্লাস অনুযায়ী ২০০-৪০০ তুর্কি লিরা।
ব্যক্তিগত গাড়ি বা ভাড়া করা গাড়ি
যাদের নিজেরা গাড়ি ভাড়া করে এবং মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ভ্রমণ করতে চাআন তাঁদের জন্যে সেরা অপশন হলো ভাড়া গাড়ি।
ড্রাইভিং রুট
- ইস্তানবুল থেকে মোটরওয়ে D750 বা D300 ব্যবহার করে।
- দূরত্ব: প্রায় ৭৫০ কিমি।
- সময়কাল: ৮-৯ ঘণ্টা।
খরচ
- গাড়ি ভাড়া: দৈনিক ৫০০-৭০০ তুর্কি লিরা।
- জ্বালানি ও টোল: প্রায় ৮০০-১,০০০ তুর্কি লিরা।
ট্যুর প্যাকেজ
তুরস্কের বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা ক্যাপাডোসিয়ার জন্য প্যাকেজ ট্যুর অফার করে। এতে ফ্লাইট, হোটেল, স্থানান্তর, এবং গাইডেড ট্যুর অন্তর্ভুক্ত থাকে।
- খরচ: ৫,০০০-১০,০০০ তুর্কি লিরা (প্যাকেজের ওপর নির্ভর করে)।
যদি দ্রুত এবং আরামদায়ক যাত্রা চান, তবে ফ্লাইট এবং শাটল বাস ব্যবহার করুন। যদি বাজেট-বান্ধব উপায় চান, তবে বাস সেরা। স্বাধীনভাবে ঘোরার জন্য গাড়ি ভাড়া ভালো উপায়।
Leave a Comment