খুলনা

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড

বিশ্বের বৃহত্তম সাবমেরিন ফ্যান অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে যা বেঙ্গল ফ্যান বা গঙ্গা ফ্যান নামে পরিচিত। এখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে সাবমেরিন ফ্যান আসলে কি? সাবমেরিন ফ্যান হলো সমুদ্রতলদেশে একটি ভূমিরুপ যা নদীবাহিত পলি দ্বারা ক্রমসঞ্চিত হয়ে তলদেশে শিরা উপশিরা মিলে জালের মতো বেষ্টনী তৈরি করে। বঙ্গোপসাগরে তেমনি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও তাদের বিভিন্ন শাখা নদীর বাহিত পলি দ্বারা বেঙ্গল ফ্যানের সৃষ্টি করেছে। বেঙ্গল ফ্যানের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০০ কিমি এবং প্রস্থ ১৪৩০ কিমি। এটি সর্বোচ্চ ১৬.৫ কিমি পুরো বা স্থুলো। এর নিকটেই বঙ্গোপসাগরের উত্তরাংশে বাংলাদেশ সমুদ্র সীমারেখায় অবস্থিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড (Swatch of No Ground) নামক গভীর সমুদ্র খাদ। একে আন্ডার ওয়াটার ক্যানিয়নও বলা হয়। এই খাদটি এতই গভীর যে এখানে সূর্যালোক ঠিক মতো প্রবেশ না করতে পারায় সমুদ্রের জল গাড় বর্ণের দেখায়।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড কি?

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড পৃথিবীর ১১তম গভীর সমুদ্রখাদ। সমুদ্রবিজ্ঞানীদের মতে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড একটি সামুদ্রিক অভয়ারণ্য বা Marine Protected Area. বঙ্গোপসাগরের অন্যতম মত্স্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে নানা জাতের সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি বিশাল তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর, কচ্ছপ আর বিরল প্রজাতির কিছু জলজপ্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। এই বিস্তীর্ণ এলাকাটি বিরল জীববৈচিত্র্য যেমন তিমি, পপাস ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন, ইমপ্লাইস ডলফিন ইত্যাদির নিরাপদ প্রজনন কেন্দ্র। বিজ্ঞানীদের মতে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে ডলফিন, পরপাস ও তিমি—এই তিন প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী একসঙ্গে দেখা যায়। এই সামুদ্রিক অঞ্চলে সী-গালসহ দশ প্রজাতির পাখি, ত্রিশ প্রজাতির মাছ, ব্রিড তিমি এবং মিল্কি তিমিসহ অসংখ্য জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড দেশের সম্ভবনাময় ব্লু ইকোনমির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। এখানকার পানির গুণগতমান শ্রীলংকা, ভারত, মিয়ানমার ও মালদ্বীপের চেয়েও উন্নত। বিশেষ করে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সুন্দরবন অঞ্চলের জন্য ইকোলজিক্যাল ফিল্টার হিসেবে কাজ করছে।

নামকরণের ইতিহাস

কথিত রয়েছে ১৮৬৩ সালে গ্যাডফ্লাই নামে ২১২ টন ওজন বিশিষ্ট গানবোট ভারত থেকে ইংল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন নিয়ে যাওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া সেই ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের খোঁজে এসেছিল দেশটির আরো কয়েকটি জাহাজ। তাদের সঙ্গে ছিল এক জরিপকারী দল। শেষ পর্যন্ত ডুবে যাওয়া জাহাজের হদিস না পেয়ে এই অঞ্চলটির নাম দেওয়া হয় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড অর্থাৎ যার কোনো তল বা সীমা নেই। স্থানীয় জেলেরা অঞ্চলটিকে বলে ‘নাই বাম’। কারণ জেলেরা ফুট বা মিটারে সমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ না করে বাম হিসেবে যেমন দশ বাম, বিশ বাম এভাবে পরিমাপ করে থাকে। এই অঞ্চলটি এতোটাই গভীর যার কোনো বাম পাওয়া যায় না, সেজন্য জেলেরা ‘নাই বাম’ বলে থাকে।

ডলফিন কখন দেখা যায়

সি-গাল (Segal) পাখির অবস্থানের উপর নির্ভর করে অনেক সময় ডলফিন বা তিমির অবস্থান বোঝা যায়। যদি সি-গাল পাখিকে সমুদ্রের পানির কাছাকাছি চক্কর দিতে দেখেন তাহলে তার আশাপাশে ডলফিনের অবস্থান রয়েছে বলে ধারনা করতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে সেখানটায় ডলফিনের দেখা মিলবার সম্ভাবনাও প্রচুর। 

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়ার উপায়

সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড মংলা/ সুন্দরবন এর দুবলার চর/সোনারচর থেকে প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ঢাকা থেকে সরাসরি মংলা চলে যেতে পারেন। মংলা থেকে প্রতিদিনই মাছ ধরার ট্রলার যায় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে। জেলেদের সঙ্গে কথা বলে উঠে পড়বেন যেকোনো একটি ট্রলারে। রাতে মাছ ধরার জন্য ট্রলারগুলো সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে।

এছাড়া মংলা বন্দরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবেন, যদি জাহাজে করে যাওয়ার সৌভাগ্য এবং সুযোগ মিলে কিনা। অবশ্যই আবহাওয়া জেনে বুঝে তবেই মাঝ সমুদ্রে ভ্রমণ করা উচিত।

এছাড়া কুয়াকাটা থেকে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড প্রায় ৯০ কি মি দূরে। কুয়াকাটা থেকে সরাসরি যাওয়া যায় কিনা সে ব্যাপারটা নির্ভর করে ট্রলার পাওয়ার উপর।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ swatch