মাগুরা

রাজা সীতারাম রায়ের বসতবাটি

রাজা সীতারাম রায়ের বসতবাটি (Raja Sitaram Rajprasad) বাংলাদেশের মাগুরা সদর উপজেলা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মধুমতী নদীর তীরের একটি প্রত্নস্থান যা স্থানীয়ভাবে রাজবাড়ী পরিচিত, যা সপ্তদশ-অষ্টদশ শতাব্দীতে এখানে পত্তন হওয়া উন্নত এক জনপদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের একজন আমলা সীতারাম রায় এ প্রাসাদ-দুর্গটি নির্মাণ করেছেন, যিনি আমলা থেকে জমিদারি এবং পরে স্বীয় প্রতিভাবলে রাজা উপাধি লাভ করেন।

রাজা সীতারাম রায় (১৬৫৮–১৭১৪) বাংলার মুঘল সাম্রাজ্যের একজন সামন্ত, যিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে একটি স্বল্পস্থায়ী হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজত্বকালের স্মৃতিবিজড়িত মহম্মদপুরে অবস্থিত রাজবাড়িটি আজও ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করে।

রাজবাড়ির ইতিহাস এবং স্থাপত্য

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় অবস্থিত রাজা সীতারাম রায়ের বাড়ি একসময় তাঁর জমিদারির কেন্দ্র ছিল। তিনি ১৬৯৭-৯৮ সালের দিকে মহম্মদপুরে জমিদারির পত্তন করেন। তাঁর জমিদারি ছিল পাবনা থেকে বঙ্গোপসাগর এবং বরিশাল থেকে নদীয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।

রাজা সীতারাম একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন, যা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়। তাঁর আমলে নির্মিত হয়েছিল একাধিক মন্দির, দিঘি এবং প্রাসাদ। এই স্থাপনাগুলো এখনও ইতিহাসের এক উজ্জ্বল সাক্ষী। উল্লেখযোগ্য দিঘিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • কৃষ্ণসাগর এবং রামসাগর: সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে খনন করা হয়েছিল।
  • দুধসাগর দিঘি: জনশ্রুতি অনুযায়ী, এর তলদেশ পাকা এবং এটি ধনাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
  • চুনাপুকুর এবং পদ্মপুকুর: দুর্গ এলাকায় অবস্থিত এই পুকুরগুলো সাধারণ মানুষের পানীয় জলের কষ্ট দূর করেছিল।

তিনি স্থাপন করেন ধুলজোড়া দেবালয় (১৬৮৮), দশভুজার মন্দির (১৬৯৯), এবং লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির (১৭০৪)। এছাড়া রাজবাড়ির পাশে দুধসাগরের পাড়ে দোল মঞ্চ ও রামচন্দ্র মন্দিরও অবস্থিত।

রাজবাড়ির স্থাপত্যশৈলী

রাজবাড়ির প্রধান ফটকে দুই হাতির শুঁড়খচিত কারুকাজ দেখা যায়। দেয়ালে খোদাই করা বিভিন্ন নকশা এবং রাজবাড়ির অভ্যন্তরের কারুকাজপ্রবণ কক্ষগুলো রাজা সীতারামের ঐতিহ্যের সাক্ষী। রাজবাড়ির পেছনে বিশাল দিঘি দুধসাগর এবং দূরে আরও একটি দিঘি রয়েছে।

রাজা সীতারাম রায়ের বসতবাটিতে দ্রষ্টব্য

  1. রাজবাড়ি এবং দিঘি: দুধসাগরসহ রাজা সীতারামের খনন করা দিঘিগুলোর পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ মুগ্ধ করবে।
  2. মন্দিরগুলো: ধুলজোড়া দেবালয়, দশভুজার মন্দির, এবং লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের কারুকাজ দেখার মতো।
  3. দোল মঞ্চ: তিন স্তরের এই স্থাপনা রাজকীয় অনুষ্ঠানের স্মৃতি বহন করে।
  4. দুর্গ এলাকা: দুর্গের ভগ্নাবশেষ এবং এর আশপাশের পুকুরগুলো।

রাজা সীতারামের বসতবাটি যাওয়ার উপায়

মাগুরা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে মহম্মদপুর উপজেলার রাজাবাড়িতে রাজা সীতারাম রায়ের বসতভিটা অবস্থিত।

  • মাগুরা থেকে: মহম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বাসে আসুন। সেখান থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ি।
  • যোগাযোগ মাধ্যম: রাজাবাড়ি পৌঁছাতে রিকশা, ভ্যান বা হেঁটে যাওয়া সবচেয়ে সহজ।

কোথায় থাকবেন

মাগুরা সদর এলাকায় বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। ভ্রমণ পরিকল্পনার জন্য মাগুরা শহরে থাকা একটি ভালো বিকল্প। উন্নত মানের থাকার জন্য মাগুরার পাশের বড় শহরগুলোতে যাওয়া যেতে পারে।

রাজা সীতারাম রায়ের বসতভিটা কেবলমাত্র একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নয়; এটি বাংলার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যের এক মহৎ নিদর্শন। ইতিহাস এবং স্থাপত্যপ্রেমীদের জন্য এটি অবশ্যই ভ্রমণের একটি অনন্য গন্তব্য। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় ভরা এই স্থান ভ্রমণে আপনাকে অতীতের এক সমৃদ্ধ যুগের অনুভূতি এনে দেবে।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ PalaceRaja Sitaram