জঙ্গলবাড়ি দূর্গ (Jangalbari Fort) বাংলার বারো ভূঁইয়াদের প্রধান মসনদে-আলা বীর ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী। কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়ি গ্রামে নরসুন্দা নদীর তীরে এই মধ্যযুগীয় জঙ্গলবাড়ি দূর্গটি অবস্থিত। স্থানীয়দের লোকমুখে জানা যায় যে, মহাবীর ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ২০০৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঘোষণা করে এবং পরবর্তিকালে ২০১৩ সালে বাড়িটির সামনে পুরাকীর্তি সংরক্ষণের সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে দূর্গের ভেতরে থাকা পুরাকীর্তির সংরক্ষণ করেছে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
মহাবীর ঈশা খাঁ ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ১৫৯৯ পর্যন্ত জঙ্গলবাড়িতে অবস্থান করেন এবং ১৫৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর দুর্গে ইন্তেকাল করেন। সেখানেই তাঁর সমাধিস্থল। তিনি ছিলেন বাংলার বারো ভুঁইয়া বা প্রতাপশালী বারোজন জমিদারদের প্রধান। ঈসা-খাঁ এবং বারো জন জমিদার একসাথে বাংলায় স্বাধীনভাবে জমিদারী স্থাপন করে। ১৫৪৫ সালে শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করার পর ঈশা খার বাবা সুলাইমান খাঁ দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করলে কৌশলে তাঁকে হত্যা করে তাঁর দুই নাবালক পুত্র ঈসা খাঁ এবং ইসমাইল খাঁকে একদল তুরানী বণিকের নিকট বিক্রি করা হয়। ১৫৬৩ সালে ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ রাজকার্যে নিযুক্তি লাভ করে বহু অনুসন্ধানের পর সুদূর তুরান দেশের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ২ ভ্রাতুস্পুত্রকে উদ্ধার করেন। এ সময় ঈসা খাঁর বয়স মাত্র ২৭ বছর। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম হলেও ঈশা খাঁর আদি নিবাস আফগানিস্তান।
মুঘল ও ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাংলার জমিদারগণ তাকে গোয়েন্দা মারফতে বাংলায় আসার সংবাদ পাঠালে তিনি ১৪০০ ঘোড়সওয়ার, ২১টি নৌবিহার ও গোলাবারুদ নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছান। ১৫৮৫ সালে তৎকালীন কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা ও রাম হাজরাকে পরাজিত করে জঙ্গলবাড়ি দূর্গ দখল করেন। কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা বা ঈশা খাঁর কেউ এই দুর্গের স্থপতি নয়। ধারনা করা হয়, এটি প্রাক-মুসলিম যুগে নির্মিত। তবে ঈশা খাঁ জঙ্গলবাড়ি দূর্গ দখল করার পর এর ভিতরে কিছু স্থাপনা নির্মাণ করেন। এই দুর্গ থেকে পরে তিনি একে একে তিনি সোনারগাঁওসহ মোট ২২টি পরগণা দখল করেন। ১৫৯৭ সালে তিনি পাকুন্দিয়ার এগারসিন্দুরে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংকে পরাজিত করেন।
জঙ্গলবাড়ি দূর্গটিতে বর্তমানে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ইটের পাঁচিল দিয়ে ভাগ করা দুটি চত্বর রয়েছে। স্থানীয়রা পাঁচিলটি পরিচিত ‘প্রাসাদ প্রাচীর’ নামে। দক্ষিণ দিকে একটি তোরণ আছে। তোরণটির সামনের দিকে ‘করাচি’ নামে একটি পূর্বমূখী একতলা ভবন রয়েছে।
তোরণের পিছনে ‘অন্দর মহল’ নামে এক তলা দক্ষিণ মুখী একটি ভবন রয়েছে। পুরো ইটের দেওয়াল চুনকামসহ লেপন দিয়ে ঢাকা। দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে গভীর পরিখা খনন করা আছে। পরিখাটিকে পূর্বদিকে নরসুন্দা নদীর সাথে সংযুক্ত করা হয়। বাড়ির সামনে ঈশা খাঁর সময়ের খনন করা একটি দীঘি আছে।
জঙ্গলবাড়ি দূর্গ এর কাছের দিঘীর পাশেই আছে একটি তিনগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, ঈশা খাঁই মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। মসজিদটিতে রয়েছে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর ছাপ। মসজিদের পাশেই ঈশা খাঁর বংশধরদের বাঁধানো কবর রয়েছে যদিও ঈশা খার সমাধি এখানে নেই।
২০০৫ সালের ১২ জুন দুর্গের ভিতরের দরবারগৃহটি সংস্কার করে স্থানীয় প্রশাসন ‘ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার’ স্থাপন করে। এই জাদুঘরে ঈশা খাঁর বিভিন্ন ছবি, তার বংশধরদের তালিকা এবং বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে।
ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রতি ঘণ্টায় কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। তাদের মধ্যে ঈঁশাখা সার্ভিস এর বাস অন্যতম। এছাড়া ঢাকার মহাখালী থেকে কিশোরগঞ্জ ট্রভেলস, অনন্যা, ডিজিটাল অনন্যা, এগারসিন্দুর, হাওড় বিলাস নামের বেশ কিছু বাস ছেড়ে যায়।
এছাড়া যারা ট্রেনে কিশোরগঞ্জ যেতে চান তাদের জন্যেও রয়েছে সেই সুবিধা। ঢাকা কমলাপুর রেলষ্টশন থেকে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসে কিশোরগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেনে যেতে চাইলে শ্রেণীভেদে ভাড়া গুনতে হবে ১২৫ টাকা থেকে ২৫০ টাকা।
কিশোরগঞ্জ পৌছে অটোরিক্সা বা ইজিবাইক নিয়ে চলে যেতে হবে শহরের ভিতরের দিকে একরামপুর মোড়, ভাড়া পড়বে ৫-৮ টাকা। এই একরামপুর মোড় থেকেই জঙ্গলবাড়ি যাওয়ার অটো মিলবে। শেয়ারে গেলে ভাড়া পড়বে ২০ টাকা আর যদি গ্রুপের জন্যে রিজার্ভ নিতে চান তাহলে গুনতে হবে ৩০০-৩৫০ টাকা।
জঙ্গলবাড়ি বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামের মতোই একটি গ্রাম, তাই দুর্গের আশেপাশে থাকার কোন প্রকার ব্যবস্থা নেই। আর কিশোরগঞ্জ শহর থেকে যেহেতু কাছেই তাই রাতে থাকতে চাইলে আপনি খুব সহজেই শহরে ফিরে এখানকার হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। কিশোরগঞ্জ শহরের স্টেশন রোড এলাকায় রিভার ভিউ, শেরাটন, ঈশা খা রোডে অবস্থিত হোটেল নিরালা, গৌরাঙ্গ বাজার রোডের উজানভাটি, রয়াল প্যালেস এবং বড় বাজারে অবস্থিত ক্যাসেল সালাম নামে বেশ কিছু ভাল মানের আবাসিক হোটেল রয়েছ। এছাড়া আপনি যদি অনুমতি আদায় করতে পারেন সেক্ষেত্রে আপনি কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি ডাকবাংলোতে থাকতে পারবেন।
কিশোরগঞ্জ শহরের মাছরাঙ্গা, ধানসিঁড়ি, ইস্টিকুটুম, দারুচিনি, গাংচিল ইত্যাদি রেস্টুরেন্টের খাবারের স্থানীয়ভাবে বেশ নাম ডাক রয়েছে।
Leave a Comment