গাজীপুর

ভাওয়াল রাজবাড়ী

ভাওয়াল রাজবাড়ীটি (Bhawal Rajbari) গাজীপুর জেলার প্রাচীন নিদর্শন গুলোর মধ্যে অন্যতম যা প্রায় ৫ একর জায়গার উপর জয়দেবপুর মৌজায় অবস্থিত। পরিসংখ্যান মতে ভাওয়াল রাজবাড়ীটিই বাংলাদেশর সবচেয়ে বড় রাজবাড়ী। এর কক্ষ সংখ্যা ৩৬৫ টি।বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজবাড়ী হওয়া সত্ত্বেও এটা সংরক্ষণ করা হয়নি সেভাবে যা সত্যিই কষ্টের। রাজবাড়ীর মূল ফটকে গেলেই আপনার ভুল ভাঙবে কারন এটা এখন আর রাজবাড়ী নেই। সামনের সুন্দর ভবনটা এখন গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং বাকী সব ভবনগুলো জেলা জাজ কোর্টের প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে।

ভাওয়াল রাজবাড়ী নির্মাণ শুরু করেন লোক নারায়ণ রায় আর সমাপ্তি টানেন রাজা কালী নারায়ণ রায়। এ রাজবাড়ীর পশ্চিম পাশে রয়েছে বিশাল একটি দীঘি এবং সামনে রয়েছে বিশাল সমতল মাঠ। রাজবাড়ীটির পুরো এলাকাই সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সীমানা প্রাচীরেও কারুকার্য খচিত, বেশ উঁচু। প্রধান ফটক থেকে প্রায় অর্ধ বৃত্তাকারের দুটো পথের যে কোনো একটা ধরে অগ্রসর হলেই মূল রাজপ্রাসাদ।

রাজবাড়ীর প্রবেশমুখে প্রশস্ত বারান্দা, এরপর একটি হলঘর। ওপরে ওঠার জন্য আগে শাল কাঠের প্রশস্ত সিঁড়ি ছিল, যা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। নাটমন্দির রয়েছে বাড়ির মধ্যখানে। এটি লম্বালম্বি বড় টিনের ঘর। টিনের ঘরের ঠিক মাঝখানে মঞ্চটির অবস্থান। এখানে বাইজিদের নাচ-গানের আয়োজন করা হতো। আবার এ ঘরেই সব ধরনের অনুষ্ঠান হতো। জমিদার শিকারে গেলে যদি কাউকে মনে ধরত হাতি পাঠাতেন তাকে উঠিয়ে আনার জন্য। পশ্চিমের দোতলা ভবনে তার জন্য ঘর বরাদ্দ করতেন।

রাজবিলাস নামের একটি কামরা ছিল, যা জমিদারের মনোরঞ্জনের জন্য বরাদ্দ থাকত। এ ছাড়া রাজার বিশ্রামাগার হাওয়ামহলও ছিল একই ভবনের নিচতলায়। দক্ষিণ দিকের খিলানযুক্ত উন্মুক্ত কক্ষটি হচ্ছে ’পদ্মনাভি’। মাঝের বড় ঘরটির নাম ‘রানীমহল’। ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৩৬৫টি কক্ষের ইতিহাস এ জমিদারবাড়ীটির।

ভাওয়াল রাজবাড়ীর কাহিনী অবলম্বনে একটি সিনেমাও তৈরী করা হয়েছিল “সন্ন্যাসী রাজা” নামে যাতে উত্তম কুমার অভিনয় করেছিলেন।

ভাওয়াল রাজার ইতিহাস

ভাওয়াল পরগনার রাজা ভাওয়ালের মেজো রাজকুমার রমেন্দ্রনারায়ন কে ঘিরে যে চাঞ্চল্যকর মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলছিল যা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা নামে পরিচিত। যার শুরু হয়েছিল ১৯৩০ সালে এবং শেষ হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। ১৬ বছর যাবত এ মামলার ফলাফল জানার জন্য সারা দেশের মানুষ শেষ দিন পর্যন্ত উদগ্রীব ছিল। এই মামলার নায়ক ছিলেন ভাওয়াল পরগনার জমিদার বংশের মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ন রায়। তিনি যখন ১৯০৯ সালে দার্জিলিং এ ছিলেন তখন তিনি মারা জান বলে গুজব ছরিয়ে ছিল তাকে ঘিরেই এই মামলা। দীর্ঘ ১২ বছর পর একজন সাধু পরিচয়ে তিনি যখন ঢাকা এলেন, পরে ১৯২১ সালের ৪ মে তিনি নিজেকে কুমার রমেন্দ্রনারায়ন বলে ঘোষণা করলেন, সেই থেকে শুরু হল চাঞ্চল্যকর কাহিনী। ভাওয়াল রাজবংশের ইতিহাসঃ প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পন্ন পূর্ববঙ্গের ভাওয়াল পরগনার বিস্ত্রিতি ছিল ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার দুটি অঞ্চল জুরে।

ভাওয়ালে বহু প্রাচীন মন্দির,প্রাসাদ, গড়, সরোবর ও মূর্তির ভগ্নাবশেষ আছে। ভাওয়াল রাজবংশীয় ইতিহাস একটি সুদীর্ঘ ও অবছিন্ন ধারাবাহিক ঘটনা। সুদুর অতীতে এই ভাওয়াল অঞ্চল যে সেন বংশীয় রাজাদের অধিকারভুক্ত ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সেন বংশ এদেশে পুরব্বং সহ ভারতীয় বেশ কিছু এলাকা নিয়ে রাজত্ব করত এবং এই রাজত্ব কাল প্রায় ১২০ বছর ছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী তে পূর্ববঙ্গ মুসলমানদের অধিকারে আসে।তাদের কতৃত্ব ছিল পূর্বে ব্রহ্মপুত্র, উত্তরে আড়িয়াল খাঁ ও দক্ষিন-পশ্চিম এ শিতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত। ভাওয়াল পরগনাও তাদের অধিকারে চলে আসে। এই পূর্ব বঙ্গ পূর্বে সেন বংশীয় মধু সেন ও অনুজ মাধবের অধিকার ভুক্ত ছিল এবং সেন বংশের পতনের পরেও সেনবংশিয় সেনাপতি প্রতাপ রায় ও প্রসন্ন রায় কিছুদিনের জন্য রাজবাড়ীতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এদের পতনের পর ভাওয়ালের বারভূঁইয়াদের অন্যতম ফজল গাজীর অধিনে আসে। তারা কালীগঞ্জ ও মাধবপুরে বাস করেন। তিনি মাধবপুর কে গাজীবাড়ি নামে পরিবর্তন করেন। ফজল গাজীর পর দৌলত গাজী ভাওয়ালের অধিপতি হন ও তার সময়েই নানা কারনে সম্পত্তি নিলাম হয়ে যায়।

রাজ্যের সীমানা নিয়ে ঢাকার নবাব্দের সঙ্গে বিরোধ হয় এবং মামলা চলে। বিক্রমপুরের কেশব পন্দিতের রামচন্দ্র চক্রবর্তী নামে এক পুত্র ছিল যিনি বিদ্যাশিক্ষার জন্য মুর্শিদাবাদের নিকটস্থ গোকর্ণ গ্রামের জনৈক অধ্যাপকের সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তীতে অই অধ্যাপকের কন্যার সাথে রামচন্দ্রের বিয়ে হয় এবং মুরশিদাবাদেই তারা অবস্থান করেন। কিছুদিন পরে রুদ্রচক্রবর্তী ও নারায়ন চক্রবর্তী নামে রামচন্দ্রের দুই ছেলের জন্ম হয়। তারাও বিদ্যা শিক্ষায় আগ্রহী ছিল। উকিল কুশদ্ধজ রায় নারায়ন চক্রবর্তীর ছেলে ছিলেন। তিনি বিদ্যাশিক্ষায় বেশি অগ্রসর না হয়ে মুর্শিদাবাদের উকিল পদে নিযুক্ত হন এবং নবাব সরকার তাকে ‘রায়নারায়ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন।রুদ্র চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর তার ছেলেদের সাথে কুশদ্ধজ রায়ের বিবাদ হলে তিনি দৌলত গাজীর নিকট আবাসন প্রার্থনা করেন। দৌলত গাজী তার উপর পূর্ব সন্তুষ্টির কারনে জয়দেবপুরের নিকটস্থ ‘চান্দনা’ গ্রামে একটি বাড়ি ও কিছু জমি প্রদান করেন। কুশদ্ধজ রায়ের মারা জাবার পর তার ছেলে বলরাম রায় দেওয়ানী পদে নিযুক্ত হন।

ভাওয়াল রাজবাড়ী যাওয়ার উপায়

ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই সড়কপথে ও রেলপথে গাজীপুর যাওয়া যায়। সড়কপথে ভাওয়াল রাজবাড়ী যেতে চাইলে দেশের যেকোন স্থান হতে প্রথমে গাজীপুর চৌরাস্তা আসতে হবে। ঢাকা থেকে বাস বা নিজস্ব পরিবহনে গাজীপুর চৌরাস্তা চলে আসুন। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ডানে মোড় নিয়ে শিবপুর মোড় হয়ে জয়দেবপুর-রাজবাড়ী সড়ক ধরে পুর্ব দিকে এগিয়ে গেলে ভাওয়াল রাজবাড়ী পৌঁছে যাবেন। আর তার ১০ মিনিট দুরত্বেই রয়েছে শ্মশানঘাট।

রেলপথে যেতে চাইলে ঢাকার এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে জয়দেবপুর গামী ট্রেনে চেপে বসুন। জ্যাম এরিয়ে স্বল্প সময়েই জয়দেবপুর স্টেশন পৌঁছে যেতে পারবেন। ট্রেনে চড়ার পূর্বে কোন ট্রেন জয়দেবপুর স্টেশন থামবে জেনে নিবেন।স্টেশনে নেমে রিকশা নিয়ে সোজা ভাওয়াল রাজবাড়ী বা জেলা জজ কোর্ট পৌছানো যাবে।

গাজীপুরে কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে ভাওয়াল রাজবাড়ী সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার মধ্যেই আবার ঢাকায় ফিরে আসা যায়। তবে প্রয়োজনে রাত্রি যাপনের জন্য ছুটি, সারাহ, নক্ষত্র বাড়ি, গ্রিন ভিউ রিসোর্ট, সোহাগ পল্লী, স্প্রিং ভ্যালী, রাঙামাটি ওয়াটার ফ্রন্ট, জল ও জঙ্গলের কাব্য সহ এমন অনেক রিসোর্ট পাবেন। যেখান থেকে আপনি পছন্দমতো আপনারটা বেছে নিতে পারেন।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ bhawalgazipurjoydebpurPalace